লালন ফকিরের দশটি জনপ্রিয় গান

প্রকাশিত : অক্টোবর ১৭, ২০১৯

মহাত্মা লালন ফকিরের আজ মৃত্যুদিন। মহাত্মা লালন ফকিরের আজ মৃত্যুদিন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর মরমী এ দার্শনিক দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১১৬ বছর। মহাত্মা এই দার্শনিকের মৃত্যুদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার জনপ্রিয় দশটি গান পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এক.
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়ে।

আট কুঠুরী নয়
দরজা আটা মধ্যে মধ্যে
ঝরকা কাঁটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়ে।

কপালের ফের নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখিয়ামার কোন খানে পালায়।

মন তুই রইলি খাঁচার আসে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশের
কোন দিন খাঁচা পড়বে খসে
ফকির লালন কেঁদে কয়।

দুই.
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ও হে দয়াময়,
পারে লয়ে যাও আমায়।।
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে-
(আমি) তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায়।।
নাই আমার ভজন-সাধন
চিরদিন কুপথে গমন-
নাম শুনেছি পতিত-পাবন
তাইতে দিই দোহাই।।
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামে রবে অখ্যাতি-
লালন কয়, অকুলের পতি
কে বলবে তোমায়।।

তিন.
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবি দেখি তা না-না-না।।
আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে,
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বল না।।
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
এক জলেই সব হয় গো শুচি,
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাকেও ছাড়বে না।।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়,
তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়।
লালন বলে জাত কারে কয়
এ ভ্রম তো গেল না।।

চার.
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।
লালন কয় জাতের কী রূপ
আমি দেখলাম না দুই নজরে।
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।

কেউ মালা’য় কেউ তছবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়
জাতের চিহ্ন রয় কার রে
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।

যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীর তবে কি হয় বিধান,
বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ,
বামণি চিনে কিসে রে
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।

জগত্ বেড়ে জেতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথা তথা
লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে’
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।

পাঁচ.
সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধন হবে না

জানো না মন খালে বিলে
থাকে না মিল জল শুকালে ।।
কি হবে আর বাঁধা দিলে
মোহনা শুকনা থাকে, মোহনা শুকনা থাকে,
সময় গেলে সাধন হবে না
সময় গেলে সাধন হবে না

অসময়ে কৃষি কইরে মিছা মিছি খেইটে মরে
গাছ যদি হয় বীজের জোরে ফল ধরে না
তাতে ফল ধরে না,
সময় গেলে সাধন হবে না ।।

অমাবস্যায় পূর্নিমা হয়
মহা জোগ সে দিনের উদয় ।।
লালোন বলে তাহার সময়
দনডোমো রয় না, দনডোমো রয় না,দনডোমো রয় না
সময় গেলে সাধন হবে না

দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধোন হবে না

ছয়.
তিন পাগলে হলো মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে ।।

একটা পাগলামি করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে
ধূলার মাঝে ।।

একটা নারকেলের মালা
তাতে জল তোলা ফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি
বুঝবি শেষে ।।

পাগলের নামটি এমন
বলিতে অধীন লালন হয় তরাসে
চৈতে নিতে অদ্বৈ পাগল
নাম ধরে সে ।।

তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে….. !!

সাত.
গুরু গো.. ও ও ও …

বেধ বিধির পথ শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার
এসব দেখি কানার হাট বাজার

এক কানা কয় আর এক কান।রে
চল এবার ভব পারে।।
নিজে কানা
পথ চেনে না
পরকে ডাকে বারং বার
এসব দেখি কানার হাট বাজার

পণ্ডিত কানা অহংকারে
সাধু কানা অন্-বিচারে
মোড়ল কানা চুগলখোরে
আন্দাজে এক খুটি গেরে।।
জানেনা সীমানা কার
এসব দেখি কানার হাট বাজার।।

কানায় কানায় হোলা মেলায়
বোবাতে খায় রস গোল্লা গো
আবার লালন বলে মদনা কানা
ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার
এসব দেখি কানার হাটবাজার

আট.
সব সৃষ্টি করলো যে জন

তারে সৃষ্টি কে করেছে।
সৃষ্টি ছাড়া কি রূপে সে
সৃষ্টিকর্তা নাম ধরেছে।।

সৃষ্টিকর্তা বলছো যারে
লা শরিক হয় কেমন করে।
ভেবে দেখো পূর্বাপরে
সৃষ্টি করলেই শরিক আছে।।

চন্দ্র সূর্য যে গঠেছে
তার খবর কে করেছে।
নীরেতে নিরঞ্জন আছে
নীরের জন্ম কে দিয়েছে।।

স্বরূপ শক্তি হয় যে জনা
কে জানে তার ঠিক ঠিকানা।
জাহের বাতেন যে জানেনা
তার মনেতে প্যাঁচ পড়েছে।।

আপনার শক্তির জোরে
নিজশক্তির রূপ প্রকাশ করে।
সিরাজ সাঁই কয় লালন তোরে
নিতান্তই ভূতে পেয়েছে।।

নয়.
শুনিলে প্রাণ চমকে উঠে
দেখতে যেমন ভুজঙ্গনা ।।
যেখানে সাঁইর বারামখানা

যা ছুঁইলে প্রাণে মরি
এ জগতে তাইতে তরী
বুঝেও তা বুঝতে নারী
কীর্তিকর্মার কি কারখানা ।

আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে
দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে
কুবৃক্ষে সুফল পেয়েছে
আমার মনের ঘোর গেল না ।।

যে ধনে উৎপত্তি প্রাণধন
সে ধনের হল না যতন
অকালের ফল পাকায় লালন
দেখে শুনে জ্ঞান হল না ।।

দশ.
বাড়ির কাছে আরশিনগর

সেথা এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে।।

গেরাম বেড়ে অগাধ পানি
নাই কিনারা নাই তরণী পারে।
মনে বাঞ্ছা করি দেখব তারে
কেমনে সে গাঁয় যাই রে।।

কি বলবো সেই পড়শির কথা
তার হস্তপদ স্কন্ধমাথা নাইরে।
ক্ষণেক থাকে শূন্যের উপর
ক্ষণেক ভাসে নীরে।।

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
যম যাতনা সকল যেতো দূরে।
সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।।