সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা

প্রকাশিত : অক্টোবর ৩০, ২০১৯

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের আজ জন্মদিন। ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার হাতিবাগানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মায়ের নাম ইন্দুমতি বসুমল্লিক। কবির জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার তিনটে কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

নাম

চাই চাই আজো চাই তোমারে কেবলি।
আজো বলি,
জনশূণ্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি আজো বলি—
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যত বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ।
নিরাশ অসীমে আজো নিরেপক্ষ তব আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দী ক’রে রেখেছে, প্রেয়সী,
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে।
আমার জাগর স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারি স্মরণ।

তবু মোর মন
চাহে নাই মোহের আশ্রয়।
জানি তুমি মরীচিকা ; তোমা সনে প্রাণ বিনিময়
কোনোদিন হবে না আমার।
আমার পাতালমুখী বসুধার ভার,
জানি, কেহ পারিবে না ভাগ ক’রে নিতে ;
আমারে নিঃশেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে
এক দিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম।।
জানি ব্যর্থ., ব্যর্থ সেই সন্ধ্যা নিরুপম
যবে মোর আননে নেহারি
অগাধ নয়নে তব ফলদা স্বাতীর পূণ্য বারি
উঠেছিল সহসা উচ্ছলি।
জানি সেই বনপথে, চিরাভ্যস্ত প্রেম নিবেদনে
আপনারে ছলি,
পশিনি তোমার মর্মে, নিজের গহনে
জমিয়েছিলাম শুধু মিথ্যার জঞ্জাল।

জানি, কত তরুণীর গাল
অমনি অধৈর্যভরে শতবার দিয়েছি রাঙায়ে;
অনুপূর্ব পথিকার পারে
বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত
ক্ষণিক পুষ্পের লোভে। ক্রমাগত
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে, ঝড়ে;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও জানি, সেই মতো হারাবে ধুলায়।
তবু চায়, প্রাণ মোর তোমারেই চায়।
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম—
নাম—শুধু নাম—শুধু নাম।

উটপাখী

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ-ধূ করে মরুভূমি;
ক্ষ`য়ে-ক্ষ`য়ে ছায়া ম`রে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম`জে নেই;
তুমি বিনা তার সমুহ সর্বনাশ।
কোথায় পলাবে? ছুটবে বা আর কত?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা।
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা।

ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদ্‌প্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার, চলো
যে-কোনো নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে।

কল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ`ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা।
ভূমিতে ছড়ালে অকারী পালকগুলি
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে;
উধাও তাহার উড্ডীন পদধূলি
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজবো না অমারাতে।
তোমার নিবিদে বাজাবো না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে;
সে-পাড়া-জুড়নো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় যে ঊন্‌তিরিশে।

আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশীদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের `পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হ`লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক`রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি।

শাশ্বতী

শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি:
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।
কুহেলীকলুষ, দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।
মিলনোত্সবে সেও তো পড়েনি বাকী,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা:
পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।
সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে।
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে;
অমল আকাশে মুকুরিত তার হৃদি
স্বাতি মণিময় তারই প্রত্যভিষেকে।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম;
সে-রোমরাজির কোমলতা ঘাসে-ঘাসে;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।
স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা:
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।