মারিয়া সালাম

মারিয়া সালাম

অজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত সবচেয়ে বড় নরক, আমরা সেই নরকে আছি

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২৪

সুখি থাকার মাপকাঠিতে বাংলাদেশ এবছর পিছিয়েছে ১১ ধাপ। মানে হচ্ছে, তালিকার তলানিতে থাকা ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পড়ে আছে। এদেশে সবচেয়ে অসুখি ৩০-৫৯ বছর বয়েসিরা। ত্রিশের নিচে আর ৬০ এর ওপরে সবাই মোটামুটি ঠিকঠাকভাবে সুখি।

এটা পরিসংখ্যান। এর বাইরে গেলে দেখা যাবে, যাদের ঘাড়ে সংসারের দায়িত্ব পড়ে গেছে তারাই অসুখি হয়ে উঠছে। খুব গভীরে গিয়ে বলতে গেলে, যারা সবসময় অন্যদের কথা ভেবে জীবনের ঘানি টানছে, আর নিজেরদের মতো করে নিজের ইচ্ছায় কোনো কিছু করতে পারছে না, তারাই অসুখি।

এ এক পরাধীন অবস্থা। মাঝবয়েসি এই মানুষগুলো নিজের ইচ্ছেমতো কিছুই করতে পারে না। কেউ সন্তানকে তিনবেলা খাবার দিতে পারছে না। আবার কেউ সন্তানকে বিলাসবহুল জীবন দিতে ব্যর্থ। একটার সাথে আরেকটার তুলনা করলে বিলাসবহুল জীবন নিশ্চিত করার বিষয়টা অ্যাবসার্ড শোনালেও এটাও কারো কারো দুঃখের কারণ।

আবার কারো কারো এসব কোনো প্যারা নেই। কিন্তু সন্তানদের জন্য আরও লাগবে আরও লাগবে করে যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, সেও প্রকৃতপ্রস্তাবে অসুখি। আপাতদৃষ্টিতে একটু কৌতুকের মতো শোনালেও এটা কিন্তু ভয়াবহ একটি অবস্থা। আমাদের বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা মূলত দূর্নীতির রাজনীতি এ অবস্থার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।

একটা শ্রেণি সব সুবিধা ভোগ করার জন্য এমনভাবে অন্যদের অধিকার হরণ করতে নেমে গেছে যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সুযোগ-সুবিধা আর নিয়ম-কানুনের বণ্টন ও প্রয়োগ খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক। যার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা গিয়ে লাগছে মধ্যবয়েসি মানুষগুলোর ওপর। যারা পরিবারের জন্য উপার্জন করে। তারা পরিবার আর নিজের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতেই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের পাশাপাশি স্মার্ট ফোন ব্যবহার, এমনকি মধ্যবিত্তের জন্য নিয়মিতভাবে রেস্টুরেন্টে খাওয়াও মৌলিক চাহিদা। যে বাবা বা মা সন্তানকে তার চাহিদামতো সুখ দিতে পারছে না, তারচেয়ে বড় অসুখি মানুষ আর কে হতে পারে!

নির্ভরশীল মানুষগুলো বা শিশুরা মনে করে, আরেকজন পেলে আমি কেন পাব না? কিন্তু সেটা অর্জন করতে পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটাকে কতকিছু করতে হয়, সে খবর কেউ আর রাখছে না। এখানে শিক্ষার অভাব, সহানুভূতির অভাব আর পারিবারিক সহমর্মিতারও ঘাটতি। এ এক লেজেগোবরে অবস্থা!

সবচেয়ে বড় সমস্যা অজ্ঞতা। এই যে সামাজিক বৈষম্যমূলক অবস্থান এবং এই বৈষম্যের ধাপগুলোর মধ্যে যে বিশাল ফারাক, সেটা যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রে থাকতে পারে না, সেটা বেশিরভাগই মানুষই জানে না। যারা জানে বা বোঝে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এটা জানে না যে, এই ফারাক মিটাতে হলে তার ভূমিকা কী হতে পারে!

যারা সেটাও জানে তারা ঝামেলা এড়াতে মুখ বন্ধ রাখে বা নিজের মতো করে সুবিধা নিতে ব্যস্ত। এর পরিণতি সামগ্রিকভাবে কী হবে বা সে নিজে কিভাবে এই জালে জড়িয়ে যেতে পারে বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছে, সেটা তারা বুঝছে না। এটাও অনেক বড় অজ্ঞতা। ধর্মে আছে, অজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত আছে সবচেয়ে বড় নরক, আমরা এখন সেই নরকেই আছি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সংবাদকর্মী