অনুভূতির স্পর্শময় ব্যগ্রতা `ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি`

কাজী নাসির মামুন

প্রকাশিত : অক্টোবর ২২, ২০২০

মেঘ অদিতির `ও অদৃশ্যতা হে অনিশ্চিতি` কাব্যগ্রন্থটি  অতি সম্প্রতি পাঠ করলাম। নামকরণের মধ্যেই এই গ্রন্থের ভাববস্তু ইঙ্গিতময় হয়েছে। তার কবিতা মূলত আবছায়াময়, মগ্ন আত্মার সঞ্চরণ নিয়ে সুরেলা আবহ তৈরি করে। ফলে পাঠক হিসেবে তার ভাষার চেয়ে বিরহ ক্লান্ত একটা হৃদয়জ অনুভবে আমার ঝোঁক বেড়েছিল বেশি। সেই অনুভব সুতোর মতো মিহিন। টানটান তারের মতো দৃঢ়তাময়। চৈতন্যে থির থির ঢেউ তোলে বিষণ্ণতার। কথার চেয়ে অভিব্যক্তিই তার কবিতার মৌল ব্যঞ্জনা। সেই দিকে ইশারা করেই তিনি হয়তো বলেন, `ভাষা ভুলে বসে আছি অন্ধকারে`।

কেউ ছিল, আজ দূরে গেছে; কিছু ছিল, আজ নেই। এই কাছে বা দূরে, থাকা আর না থাকার মাঝখানে তার অনুভূতি একটা স্পর্শময় ব্যগ্রতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই ব্যগ্রতা এলায়িত নয়, একটা পরিশীলিত ভব্যতা নিয়ে বেশ জমাট। তার জীবন যেন অন্তর্গহনে অপূর্ব এক নির্বাণপ্রিয়তা টিকিয়ে রেখেছে। তাই জাগতিক পরিপার্শ্ব তার কবিতায় অভিব্যক্তির প্রয়োজনমাফিক। এর বেশি জীবন সংশ্লিষ্ট হয়ে জেঁকে বসেনি। তাই তার কবিতাকে কেউ হয়তো আত্মকেন্দ্রিক ঘরানায় সীমাবদ্ধ ভাবতে পারে। একটা ধ্যানস্থ আবহ তার কবিতায় নিমজ্জমান বলে এমনটা ভাবা স্বাভাবিক। তবে একথা নিশ্চিত, শিল্পঘনিষ্ঠতায় তার কবিতাকে সবসময় বিমূর্তও ভাবা যায় না। আত্মস্থ মগ্ন পরিবেশকে তিনি বাস্তবে মিলাতে চান, এমন আগ্রহও তার কবিতায় পরিলক্ষিত হয়।

হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, ক্রমশ আলোকময়তা তার কবিতাকে স্পষ্টতার দিকে নিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। এটি তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। আমার ভালো লাগবার কারণ হলো, এ গ্রন্থের কোথাও তার আড়ষ্টতা নাই। শব্দের অপচয় কম। সুষমা-সমন্বত একটা শান্ত ভাষাময়তা তার কবিতাকে স্নিগ্ধ করে তুলেছে। বেশ কয়েকটা কবিতায় অক্ষরবৃত্ত অনায়াসে স্ফূর্ত। শিল্পচৈতন্যে তার অনেক কবিতা পরিপক্ক; নান্দনিক লালিত্য নিয়ে মুগ্ধতায় আগ্রহী করে তোলে পাঠককে। সেই নিহিত মুগ্ধতাকে জানান দিতে তিনটি কবিতা নিচে দিলাম। সেই সঙ্গে টানা গদ্যের দু`একটা অতিবাক্যব্যয়ের কবিতার প্রতি সামান্য অমুগ্ধতাকেও জানিয়ে রাখলাম। হা হা হা।

স্মৃতিবিন্দু

যা কিছু গভীর তার সবটুকু দিয়েছি তোমাকে
মাছরাঙা নাভিতল নিভৃতের হরিতকি বন
তবু খোঁজো স্মৃতিবিন্দু, সঙ্গোপনে দেরাজে যখন
হৃদয় আগলে রাখি অর্থহীন অপার বিষাদে
নিজেকে সরিয়ে ভাবি এই বেশ লুকেচুরি খেলা
হেঁড়াখোঁড়া ধারাপাতে থেকে যাব এমন ভ্রমণে
এ তাে সেই তুমি নও, যাকে আমি অনিরুদ্ধ জানি
চেতনার কেন স্তরে ভালোবাসা নিজেকে চেনায়?
উত্তর অজ্ঞাত তাই লক্ষ্যভেদী সে শিকার আমি
তুমি যাকে প্রেম বলো তাকে আমি স্পর্শ বলে জানি...

প্রস্থান ১

সরে যায় ছায়া দূর বাতাসের নরম বিকেলে
মিলন দুরূহ জেনে সরে যায় নিদ্রাহরা চোখ
নীহারস্তূপের নিচে অবিমিশ্র বুনোগন্ধ মেখে
আদিম কেশর ওড়ে। দেখো, দূরে মোহ রাত্রিকাল
গোপন ভাস্কর্য খুঁড়ে উড়ে যায় তোমার শরীরে
মগ্নশিসে ভরা এই রাতে কী ভীষণ সুন্দরে
পোড়ে মোম, রেখাময় নম্রতার শ্রাবণ প্লাবনে
আলোতারা দেশে মায়া উৎসব শেষে, নীলচোখ
উড়ুক্কু মাছেরা ওই অনায়াস উড়ে যায় জলে

ওমপাখি

জ্বর এলে ভাবি কেউ আছে
সে এসে নির্জনে শোনাবে এস্রাজ
জ্বর সেরে গেলে পৌরাণিক গানে
সান্ধ্য-ভ্রমণে ভেসে যায় তার সাথে...
জ্বর এলে একা হয়ে যাই খুব
তখন কেন যে অত শিউলি ফুল...
পাথরশরীর খুলে মোহক যায় উড়ে
জ্বর আসে বহুবার, সে আসে না...
গান গায় ওমপাখি উত্তরের বনে...

একুশে বইমেলা ২০১৮