আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ১

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২৪

যার ভর ও আয়তন আছে এবং স্থির কিংবা গতিশীল অবস্থায় বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলকে বাধা দেয়, তাকে পদার্থ বলে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অণু একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় পদার্থ। আবার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতগুলো পরমাণু একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় পরমাণু। পরমাণুর মাঝের অংশ বা কেন্দ্রকে বলে নিউক্লিয়াস বা কেন্দ্রীণ। পরমাণুর তিনটি ক্ষুদ্রতম কণা রয়েছে। এগুলো হলো: ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এসব কণা কিভাবে পদার্থের অণুর সাথে যুক্ত থাকে এবং বিক্রিয়ার সময় এরা কী ধরনের আচরণ করে, রসায়নে সেসব আলোচনা করা হয়।

পদার্থের গঠন, ধর্ম ও পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানের যে শাখা আলোচনা করে সেই শাখাকে রসায়ন বলে। কয়লা আমাদের খুব পরিচিত পদার্থ। মৌলিক পদার্থ কার্বন দিয়ে কয়লা তৈরি। কয়লার ভেতর কার্বন পরমাণুগুলো কিভাবে সাজানো থাকে, আগুনে কয়লা পোড়ালে কয়লা কিভাবে বাতাসের বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাপ উৎপন্ন করে— রসায়নে সেই আলোচনা করা হয়। সহজ কথায় বলা যায়, বিজ্ঞানের যে শাখায় পদার্থের গঠন, ধর্ম ও পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয় সেই শাখাকে রসায়ন বলে।

পদার্থ যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি, সেসব উপাদান নিয়ে রসায়নের কারবার। এসব উপাদানের আচরণ কেমন, অন্য উপাদানের সংস্পর্শে তাদের প্রতিক্রিয়া কী রকম হয়— রসায়নে তা ব্যাখ্যা করা হয়। মানুষ প্রথম যেদিন পাথরে-পাথরে ঘষে আগুন জ্বালাতে শিখলো সেদিন থেকেই আসলে নিজেরই অগোচরে মানুষ রসায়নের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলো। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ ধাতু নিষ্কাশন, মাটি পুড়িয়ে নানা রকম মৃৎপাত্র তৈরি, ওষুধি গাছের ব্যবহারের মধ্যদিয়ে মানুষ রসায়ন চর্চা করে আসছে।

তবে সত্যি যে, কয়েকটি ওষুধ ও প্রতিদিনের দরকারি কয়েকটি জিনিস তৈরির প্রণালি ছাড়া আগের দিনের মানুষের রসায়নের আর কোনো জ্ঞান ছিল না। কী ধরনের রাসায়নিক নিয়মে ওইসব ওষুধ ও জিনিস তৈরি হতো, সে বিষয়েও তারা কিছুই জানতো না। মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ সম্পর্কেও তাদের কোনোই জ্ঞান ছিল না। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮০ অব্দে গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস বলেন, প্রত্যেক পদার্থকে ভাঙতে থাকলে শেষ পর্যায়ে এমন একটি ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যাবে যাকে আর ভাঙা সম্ভব নয়। তিনি এ কণার নাম দেন অ্যাটম। অ্যাটম মানে যা আর ভাঙা যায় না।

অ্যাটমের বাংলা পরমাণু। কিন্তু এখন আমরা জানি, পরমাণুকে ভেঙে আরও কতগুলো কণা পাওয়া যায়। পরমাণুর ধারণা দীর্ঘদিন পর্যন্ত মানুষ মেনে নেয়নি। কারণ, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে আরেক গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল পদার্থের গঠন ও ধর্ম নিয়ে আরেকটি মতবাদ দেন। তার মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবীর সকল পদার্থ মাটি, জল, আগুন ও বায়ু দিয়ে তৈরি। মাটি হচ্ছে পদার্থের শুষ্কতা ও আর্দ্রতা গুণ, জল পদার্থের আর্দ্রতা ও রসগুণ, আগুন পদার্থের শুষ্কতা ও তেজগুণ এবং বায়ু পদার্থের রস ও তেজগুণ। এই চারটি পদার্থ দিয়ে জগতের আরসব পদার্থের গুণাগুণ বিচার করা হতো।

অ্যারিস্টটলের মতবাদ অনুযায়ী, সকল পদার্থ ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে শুষ্কতা, আর্দ্রতা, রস ও তেজ গুণগুলোর কমবেশির কারণে। এরকম মনে করার পেছনে কারণও ছিল। সে সময়ের মানুষ দেখতেন, তাপ পেয়ে জল বাষ্পে পরিণত হচ্ছে আবার বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জলে পরিণত হচ্ছে। এসব দেখে তারা মনে করতেন, এক বস্তুকে আরেক বস্তুতে পরিণত করা সম্ভব। তারা আরও মনে করতেন, সকল ধাতুকেই সোনায় পরিণত করা সম্ভব। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে কাপড়কে আকর্ষণীয় করতে রঙের ব্যবহার শুরু হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ভারতের দাক্ষিণাত্যে লোহাকে কার্বনে পরিণত করে ইস্পাত তৈরি করা হতো।

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাচীন সভ্যতায় রসায়নের এমন সব গবেষণা শুরু হয়েছিল, যা একটা পর্যায়ে এসে রসায়নের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সৃষ্টি করে। এসব গবেষণার ফলে সেই সময়ে আবিষ্কার করা হয় আগুন। আসলে আগুন আবিষ্কারের পর থেকেই মানব সভ্যতার সাথে এগোতে শুরু করে রসায়ন। পশু শিকার, ফসল ফলানো ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহসহ দরকারি নানা কাজে এক রকম অস্ত্র ব্যবহার করতো সেই সময়ের মানুষ। কপার ও টিনকে একসাথে গলিয়ে তারা সেই মিশ্রণকে ঠাণ্ডা করে কঠিন সংকর ধাতুতে পরিণত করতো। এই ধাতুই হচ্ছে ব্রোঞ্জ। ব্রোঞ্জ দিয়ে খুব ভালো অস্ত্র তৈরি করা যেত।

সেই সময়ে ব্রোঞ্জ আবিষ্কার ছিল মানবজাতির জন্য খুবই দরকারি একটি জিনিস। ব্রোঞ্জ আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে দেয়। ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিস্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে আগুনে মাটি গরম করা থেকে মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ঘটে। আগুনে পুড়িয়ে কঠিন মাটিকে নানা আকৃতি দিয়ে সেই সময়ের মানুষ তাদের দরকারি পাত্র তৈরি করতো। খ্রিস্টের জন্মের দুই হাজার বছর আগে মানুষ বালি, চুনাপাথর ও সোডা উত্তপ্ত করে একসাথে মিশিয়ে এক ধরনের স্বচ্ছ জিনিস তৈরি করতো, যাকে এখন আমরা কাচ বলি। খনি থেকে এইস সময়ে আহরণ করা হতো ধাতু। ওষুধ ও সুগন্ধির জন্য গাছপালা থেকে সেই সময়ের মানুষরা রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করতেন।

রসায়নের অগ্রযাত্রা মূলত শুরু হয় প্রাচীন মিশরে। সেখানকার ধর্মজাযকরা রসায়ন চর্চা করতেন। তবে এ বিষয়ে তারা আর কাউকে জানতে দিতে চাইতেন না। মিশরীয় রাজাদেরকে ফিরাউন বলা হতো। ফিরাউন ও তাদের স্ত্রীদের মৃতদেহ মমি করে সংরক্ষণ করতে সে সময়ে তৈরি করা হয়েছিল পিরামিড। পিরামিডে এখনো মমি অবস্থায় সেসব মৃতদেহ অক্ষত অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। দুটি কৌশলে মৃতদেহকে মমি করা হতো। ক. ভেতরের কৌশল। খ. বাইরের কৌশল। সবার আগে মৃতদেহের নাড়িভুড়িসহ কিডনি, ব্রেন, যকৃত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বের করে নেয়া হতো। দেহের ভেতরের অঙ্গ বলতে শুধু হৃদপিণ্ডকে রেখে দেয়া হতো।

মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, হৃদপিণ্ডে আত্মার অবস্থান। তাই হৃদপিণ্ড রেখে মৃতদেহের ভেতর পচনরোধক বিশেষ মশলা মাখানো হতো। এরপর মৃতদেহের বাইরের অংশে পচনরোধক মশলা মাখিয়ে ১.৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে দেয়া হতো। এরপর লাইলেন দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মৃতদেহকে পিরামিডে রাখা হতো। আজ থেকে ৪,৫০০ বছর আগে কোনো যন্ত্র ছাড়াই কিভাবে মিশরের পিরামিডগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল, ভাবতে অবাক হতে হয়। পিরামিড নির্মাণে কিভাবেই বা তারা পাথর কেটে নির্দিষ্ট আকৃতি দিয়েছিল, তা বিস্ময়কর। সবচেয়ে বিস্ময়কর যা তা হচ্ছে, মৃতদেহের ভেতরে ও বাইরে তারা পচনরোধক যে মশলা মেশাতেন। এখানে রসায়নের বিস্ময়কর ব্যবহার দেখা যায়।

মিশরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭৫টি পিরামিড রয়েছে। সবচেয়ে বড় পিরামিড হচ্ছে খুফু পিরামিড। এটি তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। এর উচ্চতা ৪৮১ ফুট। ৭৫৫ বর্গফুট জমির ওপর এটি অবস্থিত। মিশরের পিরামিডের নির্মাণ, কাজ ও কৌশল এতটাই রহস্যময় যে, পিরামিডকে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য বলা হয়। জানা যায়, ১ লাখ শ্রমিক ২০ বছর ধরে এটি নির্মাণ করে। চলবে