জাবির ইবনে হাইয়ান

জাবির ইবনে হাইয়ান

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ২

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২৪

৬৪০ খ্রিস্টাব্দে আরবরা মিশর আক্রমণ করে। এই সময় থেকে আরবেরাও রসায়ন বিষয়ে অল্পকিছু জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করে। মধ্যযুগীয় আরবীয় রসায়ন চর্চাকে বলা হতো আলকেমি, রসায়নবিদদের বলা হতো আলকেমিস্ট। আলকেমি শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ আল কিমিয়া থেকে। কিমিয়া শব্দটি এসেছে কেমি থেকে। কেমি থেকেই ইংরেজি কেমিস্টি শব্দের উৎপত্তি, যার বাংলা রসায়ন। কপার, টিন ও সীসাসহ বিভিন্ন কমদামি ধাতু থেকে আলকেমিরা মূল্যবান ধাতু সোনা তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

একইসঙ্গে তারা এমন একটি মহাওষুধ তৈরি করতে চেষ্টা করেছিলেন যে ওষুধ সেবনে মানুষ অমরত্ব লাভ করবে। এসব চেষ্টায় তারা অবশ্য সফল হননি। তবে তাদের এসব চেষ্টা ও নানা রকম পরীক্ষা-নীরিক্ষার ফলে রসায়নের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। বিভিন্ন ধাতুর সংমিশ্রণে তারা সোনার মতো দেখতে নানা রকম সংকর ধাতু তৈরি করেছিলেন। এবং এসব গবেষণার সূত্র লিখে রেখেছিলেন। তাদের এসব গবেষণাকে রসায়নের ইতিহাসে প্রথম পদ্ধতিগত রসায়নের গবেষণা বলা যেতে পারে।

জাবির ইবনে হাইয়ান
জাবির ইবনে হাইয়ান ৭২২ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন খ্যাতিমান চিকিৎসক। উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়। বাবার মতোই চিকিংসাকে জাবির ইবনে হাইয়ান পেশা হিসেবে নেন। সে সময়ের নামকরা পণ্ডিত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা শুরু করেন। অল্প সময়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি নতুন নতুন তথ্য ও পদার্থ আবিষ্কার করতে থাকেন।

খুবই অল্প সময়ে রসায়নবিদ হিসেবে তার খ্যাতি বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে নাদিমের মতে, জাবির ইবনে হাইয়ান দুই হাজারের বেশি বই লেখেন। এসব বইয়ের গড় পৃষ্ঠাসংখ্যা ৮-১০। রসায়ন বিষয়ে তিনি ২৬৭টি বই লেখেন। বইগুলো ল্যাতিন ভাষায় ভাষান্তরিত হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এসব বইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, কী কী উপায়ে বিভিন্ন ধাতুকে সোনায় পরিণত করা যেতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়াও বইগুলোতে আলোচনা করা হয়েছিল।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিডের সংশ্লেষণ, পরিশ্রাবণ, পাতন, কেলাসীকরণ ও ঊর্ধ্বপাতন। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেসব নতুন পদার্থ জাবির তৈরি করেন সেসব পদার্থের বিবরণ তিনি বইতে আলোচনা করেন। ফিটকিরি, হিরাকস, সোরা ও অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের ব্যবহার তিনি জানতেন। এমনকি নাইট্রিক অ্যাসিড কিভাবে তৈরি করতে হয়, সেই প্রণালিও তিনি জানতেন। তিনিই সবার আগে ইস্পাত তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। চামড়া ও কাপড়ে রং    করার প্রণালি, ইস্পাত প্রস্তুত করার প্রণালি, লোহা ও ওয়াটার প্রæফ কাপড়ে বার্নিশ করার প্রণালি, সোনার জলে বইতে নাম লেখার কৌশল এবং চুলের কলপ, কাচ ও লেখার কালি তৈরির কৌশল ও ব্যবহার সম্পর্কে জাবির ইবনে হাইয়ান আলোচনা করেন।

এজন্য তাকে রসায়ন শাস্ত্রের জনক বলা হয়। তামার সাথে দস্তা মিশিয়ে সোনার মতো হলুদ বর্ণের ধাতু তৈরি করেন জাবির। এই ধাতুই হচ্ছে এখনকার পিতল। তিনি দেখলেন, পারদ ও সীসাকে একসাথে মিশ্রিত করলে টিনের মতো এক রকম শাদাটে ধাতু পাওয়া যায়। এই সময়ে কেউ-ই জানতো না যে, ধাতু থেকেই লবণ উৎপন্ন হয়। আরও জানতো না, তামা থেকেই তুঁত তৈরি হয়। তুঁত ও জলের মিশ্রণে একখণ্ড পরিষ্কার লোহা ডোবালে লোহার ওপর তামা লেগে যায়। এটা দেখে ওই সময়ের মানুষ ভাবতো, লোহাকে তামায় পরিণত করা যায়। এর ফলে পরশ পাথর বিষয়ে তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হতে লাগলো।

জাবির মনে করতেন, পারদ ও গন্ধক একসাথে মিলিত হয়ে সকল ধাতু তৈরি হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধাতুতে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে পারদ ও গন্ধক রয়েছে। এ কারণে ধাতুকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আমরা দেখতে পাই। জাবির ইবনে হাইয়ান আরও মনে করতেন, সোনা ও রূপাসহ উৎকৃষ্ট ধাতুতে কেবল পারদই থাকে। কারণ, তাপ প্রয়োগ করলে সোনা ও রূপা রূপান্তরিত হয় না। কিন্তু নিকৃষ্ট ধাতুতে গন্ধকের পরিমাণ এত বেশি যে, সামান্য তাপ পেলে এসব ধাতু রূপান্তরিত হয়ে যায়। পারদ ও গন্ধকের বিভিন্নতাই যে কেবল ধাতুর বিভিন্নতার প্রধান কারণ, তা নয়। এর আরও একটি কারণ আছে, সেটি পারদের বিশুদ্ধ বা অবিশুদ্ধ অবস্থা। সোনা ও রূপার বর্ণের পার্থক্য দেখে জাবির সিদ্ধান্তে এলেন, সোনা ও রূপায় বিশুদ্ধ পারদ ছাড়াও সোনায় লোহিত গন্ধক আর রূপায় সাদা গন্ধক রয়েছে। এ কারণে সোনা ও রূপা একসঙ্গে গলালে দুটি ধাতুই একসাথে মিশে যায়। ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে জাবির ইবনে হাইয়ান মারা যান।

১২ ও ১৩ শতাব্দিতে ইউরোপে যেসব রসায়নবিদ ছিলেন তারা প্রত্যেকেই আরবদের কাছ থেকে রসায়ন শেখেন। ফরাসি রসায়নবিদ রেমন্ড লুলি (১২৩২-১৩১৫) আলকেমিস্ট হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ইংল্যান্ডের রাজার জন্য তিনি প্রচুর পরিমাণে সোনা তৈরি করেছিলেন। এছাড়া আলকেমির ওপর গবেষণা করতে গিয়ে তিনি রসায়নের অনেক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ফরাসি রসায়নবিস আর্নল্ড ভিলানোভা (১২৩৫-১৩৩১) আলকেমি চর্চা করতেন। ওষুধ হিসেবে তিনিই সবার আগে অ্যালকোহল ব্যবহার করেন। আলকেমির ওপর ভিলানোভা বেশ কয়েকটি বই লেখেন। জার্মান রসায়নবিদ অ্যালবার্টাস ম্যাগনাস (১২০০-১২৮০) নানা রকম ধাতু ও ধাতুর উৎপত্তিসহ রসায়নের অনেক রহস্য উদ্ঘাটন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, পাথরের গোপন শক্তি রয়েছে। চলবে