প্যারাসেলসাস

প্যারাসেলসাস

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : এপ্রিল ০২, ২০২৪

প্যারাসেলসাস
জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক ও রসায়নবিদ প্যারাসেলসাস ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের আইনসিডেলন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার কাছ থেকে তিনি চিকিৎসা ও ভেষজবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। ওষুধে রাসায়নিক বা খনিজ পদার্থের ব্যবহার চালু করেছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি রসায়নের সঙ্গে ভেষজের যোগসূত্র তৈরি করে দেন। সালফার, লবণ ও পারদের ওপর নির্ভর করে তিনি পদার্থের গঠন তত্ত্ব প্রদান করেন। তিনি লেখেন, “যেসব জিনিস ধোঁয়া ও বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে উড়ে যায় সেসব জিনিস পারদ গিয়ে তৈরি। যেসব জিনিস আগুনে পুড়ে যায় এবং খাওয়া হয় সেসব জিনিস সালফার দিয়ে তৈরি। আগুনের পোড়ানোর পর যেসব জিনিস ছাই হিসেবে পড়ে থাকে সেসব জিনিস লবণ দিয়ে তৈরি।”

প্যারাসেলসাস মনে করতেন, ওষুধের বিষাক্ততা ও কার্যকারিতা নির্ভর করে মাত্রার ওপর। বিভিন্ন রোগের সঠিক চিকিৎসা খুঁজতে তিনি বই পড়ার চেয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ পছন্দ করতেন। বিভিন্ন রোগের ওষুধ ও ক্ষত নিরাময়ের কৌশল শিখতে প্যারাসেলসাস গোটা ইউরোপ ভ্রমণ করেন। অস্ট্রেলিয়ার রূপার খনিতে কাজ করার সময় তিনি রসায়ন ও বিষবিদ্যা বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, পারদ ও আর্সেনিক ধোঁয়া নিশ্বাসের সাথে শ্রমিকরা টেনে নিচ্ছে। ফলে তারা আক্রান্ত হচ্ছে সিলিকোসিস রোগে। সালফার, রূপা, সোনা, তামা, সীসা ও অ্যান্টিমনিসহ বিভিন্ন খনিজ ওষুধ প্রস্তুত করতে ব্যবহার করতেন প্যারাসেলসাস। সিফিলিস রোগের চিকিৎসায় অজৈব যৌগিক হিসেবে ব্যবহার করতেন।

হজমের সমস্যার জন্য তিনি আয়রন, অ্যান্টিমনি ও জিঙ্ক অক্সাইড মলম ব্যবহার করেন। তিনিই প্রথম জিঙ্ক শব্দটি ব্যবহার করেন। পারদের সাথে ধাতু মেশানো এবং অ্যালুমিনিয়াম ও গ্যাসের ব্যবহার প্যারাসেলসাস পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন। স্পেন থেকে নেদারল্যান্ডস ও মিশর পর্যন্ত তিনি চিকিৎসক ও আলকেমিস্টদের সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি লিখেছিলেন, “বিষ নয়, এমন কি আছে? সবই বিষ, বিষ ছাড়া জগতে আর কিছুই নেই। কেবলমাত্রা মাত্রা নির্ধারণ করে যে, কোনো জিনিসের কতটুকু বিষ নয়।” ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে প্যারাসেলসাস মারা যান।

বেসিল ভ্যালেন্টাইন
পরশ পাথরের খোঁজ করতে গিয়ে ১৫ শতকের জার্মান আলকেমিস্ট বাসিল ভ্যালেন্টাইন অনেকগুলো উৎকৃষ্ট ওষুধ প্রস্তুত প্রণালি আবিষ্কার করেন। রসায়ন সম্পর্কে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইডের ওপর ক্ষারের ক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া পাওয়া যায়। সোডিয়াম ক্লোরাইডকে অম্লীকরণ করে তিনি হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড উৎপন্ন করেন। ইথাইল ক্লোরাইড ও সালফিউরিক অ্যাসিডও তিনি উৎপাদন করেন। ‘বারো চাবি’ শিরোনামে তিনি রসায়নের একটি বই লেখেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে বইটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া আলকেমির ওপর তার লেখা অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়। এগুলো ইংরেজি, ফরাসি ও রুশসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় ভাষান্তরিত হয়। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বাসিল ভ্যালেন্টাইন মৌলিক পদার্থ অ্যান্টিমনি আবিষ্কার করেন।

ভ্যান হেলমন্ট
ব্রাসেলসের রসায়নবিদ ও চিকিৎসক ভ্যান হেলমন্ট। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি তার জন্ম। বায়ু বিষয়ক রসায়নের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় তাকে। কারণ, তিনিই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন বায়ুমণ্ডলীয় বায়ু থেকে আলাদা রকমের গ্যাস রয়েছে। তিনিই প্রথম গ্রিক শব্দ থেকে গ্যাস শব্দটি সৃষ্টি করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কাঠকয়লা পোড়ানোর সময় যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় সেটা একই রকম ছিল যখন গাঁজন প্রক্রিয়ায় তা উৎপাদিত হয়েছিল। বায়ু ও জলকে তিনি আদিম উপাদান মনে করতেন। তবে আগুনকে তিনি একক উপাদান মনে করতেন না। বায়ুকে মৌলিক পদার্থ বলে বিশ্বাস করলেও তিনি মনে করতেন, বায়ু অনেক রকম হয়ে থাকে। ভ্যান জানান, যে ধাতুকে কোনো একটি অ্যাসিডের সঙ্গে মিলিত করলে যদিও ওই ধাতু নষ্ট হয়ে যায়, এরপরও ওই ধাতুকে বিশেষ কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ধার করা যায়।

হেলমন্ট আরও মনে করতেন, পদার্থের ভর অপরিবর্তীয়। উদ্ভিদ কিভাবে ভর লাভ করে, সে বিষয়ে তিনি পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। উদ্ভিদ কিভাবে পুষ্টি গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে সে বিষয়ে তিনি পরীক্ষা চালান। এজন্য তিনি ২০০ পাউন্ড মাটি ও ৫ পাউন্ড ওজনের একটি উইলো গাছের শাখা নেন। এরপর শুধুমাত্র বৃষ্টির জল দিয়ে তিনি গাছটিকে বড় করে তোলেন। পাঁচ বছর পর উইলোর ওজন হলো ১৬৪ পাউন্ড, আর মাটির ওজন হয় ১৯৮ পাউন্ড। একটি বইতে হেলমন্ট লেখেন, খাদ্য শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপের মাধ্যমে পরিপাক হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন, তাহলে শীতল রক্তের প্রাণীদের খাবার হজম হয় কিভাবে? তিনি মতামত দেন, হজম হচ্ছে পেটের ভেতর রাসায়নিক বিক্রিয়া। মানবদেহের ক্ষত, প্রদাহ ও আঁচিল ছাটাই করতে হেলমন্ট সিলভার নাইট্রেট ব্যবহার করেন। রসায়নের অনেক আবিষ্কার করেন তিনি। রাসায়নিকভাবে তিনি সকল রোগের জন্য একটি প্রতিকার খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতির অনেক ঘটনার সূত্রপাত হয়। ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। চলবে