রবার্ট বয়েল

রবার্ট বয়েল

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ৪

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৩, ২০২৪

জোহান রুডল্ফ গ্লবার
১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির ব্যাভেরিয়ায় খুবই গরিব পরিবারে রসায়নবিদ জোহান রুডল্ফ গ্লবারের জন্ম। তার পিতা পেশায় ছিলেন নাপিত। টাকার অভাবে গ্লবার স্কুলে পড়তে পারেননি। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার ভেতর অজানাকে জানার আগ্রহ ছিল তীব্র। ঘরে বসেই তিনি বই যোগাড় করে পড়াশোনা করেন। রসায়ন নিয়ে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন। রসায়ন বিষয়ে যেখানে যে বই পেতেন, যোগাড় করে পড়ে ফেলতেন। একইসঙ্গে যা পড়তেন সেসব হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখতেন।

যখন তিনি টাকার মালিক হলেন তখন রসায়ন ও আলকেমি শিখতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন তিনি। এখানে বসেই একটার পর একটা বই লিখতে শুরু করেন। মার্বাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ওষুধবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাসায়নিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য গ্লবার বিভিন্ন ধরনের চুল্লি তৈরি করেন। বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ওপর তিনি গবেষণা করেন। যেমন: লবণ, ধাতু ও খনিজ।

রাসায়নিক বিক্রিয়া ও রাসায়নিক পদার্থের বৈশিষ্ট্যগুলো তিনি পরীক্ষা করেন। তিনি অ্যাকোয়া রিজিয়া আবিষ্কার করেন। হলুদ-কমলা কিংবা কখনো কখনো লাল রঙের ধূমায়িত তরল অ্যাকোয়া রিজিয়া। এক ভাগ নাইট্রিক অ্যাসিড ও তিন ভাগ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড একসাথে মিলিত হয়ে তৈরি হয় অ্যাকোয়া রিজিয়া। বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি প্রস্তুত করেন তিনি। গ্লবার একটি রাসায়নিক বাগান তৈরি করেছিলেন। প্রস্রবণের জলে তিনি অজৈব যৌগ সোদক সোডিয়াম সালফেট আবিষ্কার করেন।

তার নাম অনুসারে এটি গ্লবার লবণ হিসেবে পরিচিত। এই লবণে ওষুধের গুণ থাকায় তিনি এর নাম দিয়েছিলেন অলৌকিক লবণ। ঊনিশ শতক পর্যন্ত জোলাপ হিসেবে সোদক সোডিয়াম সালফেটের স্ফটিক ব্যবহৃত হতো। সালফিউরিক অ্যাসিডসহ বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থ গ্লবার আবিষ্কার করেন। তার আবিষ্কৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হতো। যেমন: কাচ, ওষুধ ও রঞ্জক তৈরিতে। বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটিয়েছিলেন গ্লবার।

সোডিয়াম সালফেট ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড উৎপাদনের জন্য তিনি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তার উদ্ভাবনগুলো রাসায়নিক পদার্থের উৎপাদন সহজ ও সাশ্রয়ী করে তোলে। রসায়নের ওপর তার লেখা বইগুলো রসায়নের জ্ঞানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তার মাধ্যমেই মূলত রসায়ন বিদ্যা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডামে গ্লবার মারা যান।

রবার্ট বয়েল
অ্যাংলো-আইরিশ রসায়নবিদ রবার্ট বয়েল আয়ারল্যান্ডের মানস্টার প্রদেশের লিসমোর ক্যাসেলে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুযারি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রিচার্ড বয়েল ছিলেন প্রথম আর্ল অব কর্ক এবং প্রচুর জমির মালিক। ৮ বছর বয়সে রবার্ট বয়েলকে পাঠানো হয় ইটনের এক স্কুলে। এরপর ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরও ভালো স্কুলে পড়াশোনার জন্য তাকে পাঠানো হয় ইতালির জেনেভা শহরে। সেখানে একজন গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে বয়েল পড়াশোনা করেন।

এ সময় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ল্যালিলি জীবিত। তবে তখন আর তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারেন না। গৃহশিক্ষকের কাছে বয়েল গ্যালিলিওর গবেষণা ও আবিষ্কার বিষয়ে পড়াশোনা করেন। পিতার মৃত্যুও খবর পেয়ে তিনি ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাড়ি ফিরে এলেন। পিতার মৃত্যুর পর তাদের পারিবারিক প্রতিপত্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব কমে গেল। ডরসেটশায়ারের স্টলব্রিজে তাদের একটি কৃষিখামার ছিল। দশ বছর এই খামারে কাটিয়ে দেন বয়েল। এরই মধ্যে শুরু হলো রাজনৈতিক উত্থান-পতন।

এসব ভালো লাগতো না তার। তিনি চাইতেন, নিরিবিলি কোথাও গিয়ে পড়াশোনা ও বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করতে। ১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে স্টলব্রিজ থেকে বয়েল চলে এলেন অক্সফোর্ডে। এখানে তিনি তৈরি করলেন বিজ্ঞান গবেষণাগার। এরপর শুরু করলেন গবেষণা। বছরখানেক কাটলো এভাবে। এরপর ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন রবার্ট হুককে। এই গবেষণাগারে রবার্ট বয়েল উদ্ভাবন করেন ভ্যাকুয়াম বা বায়ুশূন্য পাম্প।

তার গবেষণাগারে সেই সময়ের অনেক বিজ্ঞানীর সমাবেশ ঘটেছিল। এসময় যাদের সাথে বয়েলের হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে তারা হলেন: জন লক, রবার্ট হুক, ক্রিস্টোফার রেন, উইলিয়াম পেটি, জন উইলকিন্স ও উইলিয়াম ওয়ালিস। এদেরকে সাথে বয়েল বিজ্ঞানভিত্তিক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। পরে এই সংগঠনের নাম হয় রয়্যাল সোসাইটি। ব্রিটিশ সরকারের বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা ছিল রয়্যাল সোসাইটি।

১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে অক্সফোর্ড ছেড়ে রবার্ট বয়েল চলে আসেন লন্ডনের পালমলে তার বোন ক্যাথরিনের বাড়িতে। এখানে থাকতেই তিনি বিজ্ঞানের ওপর লেখালেখি শুরু করেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন ও বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তি স্যামুয়েল পেপির সঙ্গে এসময় বয়েলের সখ্য গড়ে ওঠে। এছাড়া তিনি রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রাজদরবারে যাবার আমন্ত্রণ পান। রাজা বয়েলকে রাজসভার সম্মানীত একটি পদে আসীন হতে অনুরোধ করেন। কিন্তু বয়েল বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে তিনি বলেন, “আমি যদি দায়িত্বপূর্ণ রাজকীয় পদে কর্মরত থাকি তাহলে আমার বিজ্ঞান গবেষণা পিছিয়ে পড়বে। আমার জীবনের সাধনা বিজ্ঞান, রাজকীয় মর্যাদা নয়।” বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি বয়েল ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। খ্রিস্টান ধর্মকে তিনি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন। ধর্মীয় রীতিনীতিও তিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। তার সময়ে তিনি ছিলেন লন্ডনের শ্রেষ্ঠ বাইবেল বিশেষজ্ঞ। তিনি মনে করতেন, ধর্মকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান হয় না। বিজ্ঞান কখনো ধর্মবিরোধী নয়। ধর্ম ও বিজ্ঞান একটি আরেকটির সম্পূরক।

১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবিষ্কার করেন, সমান তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন চাপের ফলে কম বা বেশি হতে পারে। এই আবিষ্কার বয়েলের সূত্র নামে পরিচিত। গবেষণায় তিনি লক্ষ্য করেন, স্থির তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণ কোনো গ্যাসের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে ওই গ্যাসের আয়তন সঙ্কুচিত হয়ে যায়। মানে, স্থির তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট গ্যাসের আয়তন ওই গ্যাসের ওপর প্রযুক্ত চাপের সঙ্গে ব্যস্ত অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। এর কারণ, গ্যাসের অণুগুলোর ভেতর আণবিক বন্ধন না থাকায় অণুগুলোর মধ্যে প্রচুর ফাঁকা স্থান থাকে। গ্যাসের সবগুলো অণু যদি একসঙ্গে জড়ো করা যায় তাহলে তা ওই গ্যাসের মূল আয়তনের কয়েক হাজার ভাগের ১ ভাগ হবে। যেমন: ১৮ গ্রাম জলের আয়তন ১৮ ঘন সেন্টিমিটার। কিন্তু ওই জলকে বাষ্পে পরিণত করলে বাষ্পের আয়তন হবে ২২৪০০ ঘন সেন্টিমিটার।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, জলীয় বাষ্পের ২২৪০০ ভাগের মধ্যে ২২৩৮২ ভাগই ফাঁকা স্থান। চাপ দিলে গ্যাসের অণুগুলো বাড়তি চাপের সাথে ভারসাম্য রাখতে ওই ফাঁকা স্থান দখল করে। ফলে ফাঁকা স্থানের আয়তন কমে আসে। একইসঙ্গে গ্যাসের আয়তনও কমে যায়। রসায়ন, গ্যাস ও ধাতব পদার্থের বিভিন্ন সূত্র রবার্ট বয়েল আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন ধাতুর ভস্মীকরণ, দহন প্রক্রিয়া ও অ্যাসিডের ধর্ম সম্পর্কে তিনি গবেষণা করেন। বয়েলের বিশেষ কৃতিত্ব হলো, তিনিই প্রথম আলকেমি থেকে রসায়ন শাস্ত্রকে আলাদা করে বিজ্ঞানের বিশেষ একটি শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেন।

বয়েলই প্রথম বলেছিলেন, যা কিছুই আমরা দেখি না কেন সবই তৈরি হয়েছে ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। যাকে এখন আমরা পরমাণু বলি। ঊনিশ শতকের শেষদিকে পরমাণু তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। অথচ কয়েকশো বছর আগে পরমাণুর ধারণা বয়েল দিয়ে গিয়েছিলেন। বয়েল আরও বলেছিলেন, বায়ু কয়েকটি অতিক্ষুদ্র অণু দিয়ে তৈরি। অণুগুলো একটির সাথে আরেকটি জড়ানো। অণুগুলোর কুণ্ডলির একটি নকশা তৈরি কওে দেখিয়েছিলেন। বয়েলের বলেছিলেন, কোনো বাহন বা মাধ্যম ছাড়া শব্দ চলতে পারে না। বায়বীয় পথে শব্দ চলতে পারে না।

তার আরেকটি আবিষ্কার হলো, জীবনধারণের জন্য সকল প্রাণীরই বায়ুর দরকার হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া কোনো প্রাণীই বাঁচতে পারে না। তিনি তখনো বায়ুর প্রধান উপাদান অক্সিজেন সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারেননি। কারণ, অক্সিজেন আবিষ্কার হয় তার অনেক পরে, ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে। বিজ্ঞানী প্রিস্টলি অক্সিজেন আবিষ্কার করেন। অনেক ধাতব পদার্থের যন্ত্রিক ব্যবহার নিয়েও বয়েল আলোচনা করেন। তাকে প্রথম আধুনিক রসায়নবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনিই প্রথম মৌলিক পদার্থের ধারণা দেন। যৌগিক ও মিশ্র পদার্থের পার্থক্য তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন। আগুন জ্বালানোর জন্য দরকারি বায়ু তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন। ১৬৯১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর লন্ডনে রবার্ট বয়েল মারা যান। চলবে