
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষাধারা
পর্ব ২
রাহামান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২৫
মুখস্থবিদ্যা ও পাঠক্রম নিয়ে নানাসময়ে কথা উঠেছিল। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান সম্পর্কে নানা সমালোচনা ছিল। কলা, আইন, বিজ্ঞান সব পাঠ্যক্রম নিয়ে নানারকম প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে বিজ্ঞান পাঠ নিয়ে। শিক্ষা ও ধর্ম যে এক বিষয় নয় সে কথারই প্রতিফলন ঘটেছিল জেনারেল অ্যাসেমব্লি ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড ডক্টর জার্ডিনের লেখা একটি চিঠিতে। মানুষটি নিজে পাদ্রী ছিলেন। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মশিক্ষাকে বিষয় নির্ভর শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেননি। ফাইন আর্টস পরীক্ষায় মনোবিদ্যার একটি পাঠ্যবই ছিল, সে বইটা জার্ডিনের পছন্দ হয়নি। তিনি বলেন, সে বইটি এমনভাবে লেখা যেখানে সত্যিকারের মনোবিজ্ঞানের ধারণার চেয়ে ‘মানব-মন’ সম্পর্কে খ্রিস্টানধর্মের যেসব ধর্মতত্ত্ব বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল তা সত্য হতে পারে আবার নাও হতে পারে। দর্শনের নামে কিছুতেই এইরকমভাবে ধর্মতত্ত্ব পড়ানো চলতে পারে না।
তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, মনোবিদ্যা চর্চায় ধর্মীয় এইসব প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। সনদপত্র লাভের জন্য পরীক্ষা নিয়ে সকলের যত উৎসাহ ছিল, মুখস্থবিদ্যার প্রতি সবাই যত যত্নবান ছিলেন, জ্ঞান অর্জন বা বই পড়ার প্রতি সে উৎসাহ খুব কম মানুষের ছিল। যখন উচ্চমান সম্পন্ন কিছু বই লেখা হয়েছে তার পাঠক পাওয়া যায়নি। ছাত্রদের পড়ার সময় কোথায়? সবাই তাই সস্তা পাঠ্যবই বা নোট কিনছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দেখা গেছে, বিভিন্ন পাঠ্য বইয়ের বাইরে উচ্চমানের লেখা বইগুলো কেউ পড়তে চাইছে না। কিছু উচ্চমানের বই বের হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেগুলো পোকায় কাটছে। পাঠক নেই তার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পড়ুয়া বাড়ছে, কিন্তু তা পাঠ্যবইয়ের। পাঠ্যবই লিখলে পয়সা পাওয়া যায়, উচ্চমানের বই লিখে পাঠক বা টাকা কিছুই পাওয়া যায় না। মুখস্থবিদ্যার স্বার্থে ব্যাপক পাঠ্যবই বিক্রি হলেও, জ্ঞানচর্চার বই লেখা হচ্ছে না। কারণ সেসব বই বিক্রি হয় না।
মুখস্থবিদ্যার কুফল আসলে এড়িয়ে যাওয়ার আর সুযোগ ছিল না। সেই কারণে ১৮৭৬ সালের সমাবর্তনে উপাচার্য আর্থার হবহাউস মুখস্থবিদ্যার অভিযোগ একপ্রকার স্বীকার করেই নিলেন। তিনি সমাবর্তনে উপাচার্যের বক্তব্যে বললেন, সবাই বলছে, শিক্ষার্থীরা যা শিখছে তা অগভীর, যান্ত্রিক ও ভুলে ভরা। নিজে থেকে কিছু ভাবতে না শিখে বা শেখা জিনিস কিভাবে আত্মস্থ করতে হয় তা না জেনেই তারা পরীক্ষার জন্য শুধু মুখস্থ করে যাচ্ছে। ঠিক তার অনেক বছর পর ১৮৯১ সালের সমাবর্তনে প্রথম বাঙালী উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার বক্তৃতায় বললেন, আমার আশঙ্কা, পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নির্বিচারে ও বুদ্ধিহীনভাবে মুখস্থ করে ফেলার ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক রেওয়াজ আমাদের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে।
কিন্তু গুরুদাস ছাত্রদের অভিযুক্ত করেননি। তিনি শাসকদেরও দায়ী করতে সাহস পাননি। তিনি বলেন, পরীক্ষার অত্যধিক দীর্ঘ বিষয়সমূহ ও বেখাপ্পা রকমের কঠিন প্রশ্নপত্রই এর জন্য দায়ী। পরীক্ষার হলে ভেবেচিন্তে লেখার মতন সময় যদি ছাত্রদের না দেওয়া হয়, কিংবা এমন মননশীলতা দাবি করা হতে থাকে যা তাদের ক্ষমতার বাইরে, তাহলে এই রকম কোনো অভিযোগ তোলাই চলে না যে তারা স্মরণশক্তির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল কিংবা বুঝতে চেষ্টা না করেই অন্যের মতামত ধার করে।
তিনি সমস্যা সমাধানের ভার শিক্ষাদপ্তর বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে নয়, শেষ পর্যন্ত শিক্ষক-অধ্যাপকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষকদের উদ্দেশ্যেই বলেছিলেন, সবসময় স্মরণ রাখতে হবে, পরীক্ষার জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষার জন্য পরীক্ষা। ছাত্রদের এমনভাবে উৎসাহিত করতে হবে যাতে নিয়মিত পড়াশোনার সময় যেন কোনো আসন্ন ভূত তাদের তাড়া করে না ফেরে। তারা যেন পাঠ্যবিষয়, তা সে যাই হোক, বুঝেসুঝে পড়ে এবং এই কথা ভেবে খুশি থাকে যে এর মধ্যে দিয়েই তারা হয় তাদের মনকে তৈরি করছে, না হয় প্রয়োজনীয় জ্ঞান সঞ্চয় করছে। সন্দেহ নেই, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শিক্ষাব্যবস্থার কতকগুলো সঙ্কট ঠিকভাবেই শনাক্ত করেছিলেন।
শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ও করেছেন। স্মরণ রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করা হতো না। পাঠদান করা হতো বিভিন্ন কলেজ এবং ইন্সটিটিউশনগুলোতে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ করতো। ভূদেবের লেখায় সেই কলেজ শিক্ষার সমালোচনা দেখা যায়। তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন কলেজগুলিতে যে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় তা শিক্ষার্থীর মনে বিজ্ঞানচেতনা সৃষ্টিতে সহায়তা করে না। বাংলার কলেজগুলিতে ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে যারা অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হন, তারা অধিকাংশই বিজ্ঞানবিদ্যায় তেমন বিদ্বান নন। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ গণিতবিদ্যায় মন্দ নন, কিন্তু বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে তারা পটু নন। হাতে কলমে পরীক্ষানিরীক্ষা ব্যতিরেকে বিজ্ঞানের শিক্ষা বিড়ম্বনামাত্র।
বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা এরূপ হওয়াতে শিক্ষার্থীর মনে অধীত ইউরোপীয় বিজ্ঞানের সূত্রগুলি বার্ষিক পরীক্ষার সময় পর্যন্ত কণ্ঠস্থ থাকতে পারে, নিশ্চয় তাতে বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি জন্মাতে পারে না। বিশেষত এদেশে বিজ্ঞান-প্রসূত শিল্প-কলকারখানা নাই বললেই চলে। সুতরাং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ব্যবহারিক প্রয়োগ বাস্তবে কি কলেজে কি কলেজের বাইরে কোথাও হয় না-পুস্তকে পঠিত বৈজ্ঞানিক কথাগুলি যথাসাধ্য অনুভব করে বুঝে নিতে হয় এবং কণ্ঠস্থ রাখতে হয়। বস্তুত, ইউরোপীয় পুস্তক এবং ইউরোপীয় শিক্ষকদের কাছে শোনা বক্তৃতার উপর নির্ভর করে এদেশীয় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষা ঘটে। ফলও তদ্রুপ হয়। শিক্ষার্থীদের ভিতরে বিজ্ঞান অনুশীলনের যে প্রভাব থাকার কথা তা খুব অল্পমাত্রায় দেখতে পাওয়া যায়। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেই শুধু মাত্র তারা পারদর্শিতা লাভ করে।
ইতিহাস ও ভূগোল পাঠের ভিতর দিয়ে সেসম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান লাভ করলেও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কোনো ফল হয় না। ইউরোপীয় বিজ্ঞানচর্চার যেগুলো ভিত্তি এখানকার ইংরেজি শিক্ষায় বিজ্ঞানের সেই ভিত্তিগুলোর অভাব। এরূপ শিক্ষায় বিজ্ঞানমনস্কতা জন্মাবে কী করে? ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে যে এদেশে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনা প্রবেশ করতে পারেনি সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিজ্ঞান শুধু পাঠক্রম আর পরীক্ষার বিষয় হয়ে থেকেছে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা ব্রিটিশ শাসকদের শিক্ষানীতি প্রথম থেকেই জ্ঞানচর্চাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছিল। চাকরি লাভের উপায় হিসেবে দেখা হয়েছিল শিক্ষাকে। শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো হয় প্রলোভন এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা বলে। সংকীর্ণ মানসিকতা ও উদ্দেশ্য নিয়েই সাম্রাজ্যবাদীদের তথাকথিত আধুনিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সংকীর্ণতা ছিল শাসক এবং ভদ্রলোক শাসিত উভয় পক্ষের মধ্যেই। মুষ্টিমেয়কে শিক্ষিত করে, ইংরেজি জানা মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী করে শাসক ইংরেজ স্বভাবতই শিক্ষাকেও শাসনযন্ত্রের প্রয়োজনের মধ্যেই বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। সবার জন্য শিক্ষা নয়, শিক্ষা অতএব সেই উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মানুষদের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট রাখা হলো, যাদের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে ইংরেজ শাসকদের উপযুক্ত দেশীয় প্রতিনিধি বা দালালরা। বাকি দেশবাসীর উপর যাদের থাকবে ব্যাপক প্রভাব। পুরো দেশবাসী যাদের জীবনের রমরমা দেখে নিজেরাও তাদের অনুসরণ করার স্বপ্ন দেখবে।
পুলক চন্দ মন্তব্য করেছিলেন, শত বাঙালি ছেলের নিরানব্বই জনের কাছেই শিক্ষা এক নিছক ব্যবসায়িক বিনিয়োগের ক্ষেত্র, যার মুনাফা প্রথমে আসে স্কলারশীপ বা বৃত্তি আকারে এবং তারপরে দ্বিতীয়বার আসে সরকারী চাকুরি হিসেবে। ভিন্ন কিছু নয়, কোনো রকমে সামান্য কিছু ইংরেজি বুলি শিখে পরীক্ষার সিঁড়ি বেয়ে অন্যান্য সবাইকে ডিঙিয়ে একটি চাকরি হস্তগত করাই ছিল ছাত্রদের একমাত্র লক্ষ্য। ফলে পশ্চিমের উদারনৈতিক জ্ঞানবিজ্ঞান যখন এদেশের নতুন সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডলে শিক্ষার উপাদান হিসেবে এলো তখন তা যাবতীয় তাৎপর্য হারিয়ে নিছক পরীক্ষার জন্য, চাকরির জন্য মুখস্থ করবার কিছু বিষয় মাত্র হয়ে দাঁড়ালো।
বিদ্যালয় পরিদর্শক প্র্যাট লিখেছিলেন, গ্রাম যতই গরিব হোক না কেন সেখানকার মানুষ যা চায় তা হলো ইংরেজি শিক্ষা। কারণ লোকে দেখছে, ইংরেজি শিক্ষার দৌলতে স্বদেশবাসীর অনেকে আজ বড় ও লাভজনক চাকরির অধিকারী। ফলে সাধারণ মানুষরাও মনে করছে, যদি তাদের ছেলেরা সামান্য ইংরেজি শিখে নিতে পারে তাহলে ভবিষ্যতে তারাও নিশ্চয় একইরকম সৌভাগ্যবান হতে পারবে। কিন্তু চাকরি যে অফুরন্ত নয়, সেখানেও প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু ছাত্ররা তবুও পরীক্ষার বাইরে চাকরি ছাড়া গভীর বা ব্যাপক কিছু ভাবতে রাজি ছিল না। শাসকই এই ধরনের শিক্ষাকে চিরকাল মদত যুগিয়েছে। শাসক ছাত্রদের ভাবনাচিন্তার পায়ে শিকল পরিয়ে তাকে ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির মধ্যে আবদ্ধ রেখে এক সংকীর্ণ মানসিকতার সৃষ্টি করেছে।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে প্রকৃত জ্ঞান পৌঁছে দেয়ার চেয়ে তাদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি তৈরি করেছিল। শিক্ষালাভ মূল লক্ষ্য নয়, পরীক্ষায় অংংশগ্রহণ মূল চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভারতীয় শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে নানা বিতর্ক ছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসকদের স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা নিয়ে সকলেই একমত ছিলেন যে, এ শিক্ষা যথার্থ শিক্ষা নয়। শিক্ষা যেমনটি হওয়া উচিত এ শিক্ষা তেমন শিক্ষা নয়। কয়েকজন বিদেশি মনীষীসহ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষা না দেওয়ার কারণেই এটা ঘটেছে। মাতৃভাষা ছাড়া বিরাট এক জনগোষ্ঠীর জ্ঞানলাভের শিক্ষা কার্যকর ফল পেতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত শিক্ষার্থীদের জ্ঞানবিজ্ঞান অর্জনে উৎসাহ দেওয়া, মুখস্থ বিদ্যায় নয়। নবজাগৃতির পর ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে মাতৃভাষায় জ্ঞাবিজ্ঞানের চর্চা করেছে, ভারতেও তাই করা দরকার ছিল। মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উচ্চশিক্ষা আরম্ভ করা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেয়েছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে একটি সনদপত্র ধরিয়ে দিতে যারা হবে ইংরেজি শিক্ষা এবং ইংরেজ শাসকদের বশংবদ। জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির দরকার নেই, তাদের দিয়ে ইরেজ শাসকদের কাজ চললেই হলো। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকায় নবীনচন্দ্র সেন ‘আমার জীবন’ রচনায় লিখেছিলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে যমালয় বলে জানি। কারণ কী? তিনি মনে করেন, ‘পরীক্ষা বৈতরণী’ পার হওয়াটাই শিক্ষার মূল কথা। নবীনচন্দ্রের ভাষ্যমতে বহু প্রাজ্ঞজন মনে করেন, পরীক্ষা আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থার কোনো অনুষঙ্গ নয়, বরং পরীক্ষাব্যবস্থাই এখানে প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থা। ১৯০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে মত ব্যক্ত করেছিল, ‘এ এক সন্দেহাতীত সত্য যে ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ভয়ঙ্কর রোগে ভুগছে এবং তা হলো, পরীক্ষা শিক্ষার কাছে নয়, শিক্ষাই পরীক্ষার কাছে পদানত হয়ে রয়েছে।
ঠিক এর কয়েক বছর পর ১৯১৭-১৯১৯ সালে ২১৩ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের পরীক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে মতামত আহ্বান করেছিল কমিশন। সেখানে ১৬৯ জনই একবাক্যে রায় দিয়েছিলেন প্রচলিত ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে। শাসকরা ও বিশ্বিবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তবুও তাদের চিন্তাভাবনা পাল্টালেন না। পুরানো ধারাই বজায় রাখলেন। বরং পাঠ্যক্রমে যুক্ত হলো আরও বেশি হিন্দুদের পৌরাণিক বিষয়। লক্ষণীয় যে, পরীক্ষাব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি এটা এক অপরিহার্য রোগ যা শিক্ষাগ্রহণকে স্বাচ্ছন্দ্য হতে দেয় না। ‘পড়া ভালোবেসে পড়ার বা জানার আগ্রহ কোনো শিক্ষার্থীর নেই’ সরকারের বিভিন্ন দলিলপত্রে বারবার কথাটা বলা হয়েছে। বহুসময়ে বহু কমিশন তার বিকল্প খুঁজতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীকে যাচাইয়ের জন্য দরকার ছিল প্রতিনিয়ত তার উপর শিক্ষকের পর্যবেক্ষণ। সেই ক্ষেত্রে ঠিক একইভাবে এসে যায় সেই কথাটি-তার জন্য দরকার যোগ্য শিক্ষক।
প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় কজন সেরকম শিক্ষক পাওয়া সম্ভব ছিল? বরং দুঃখের সঙ্গে বলা যায়, শিক্ষকদের বড় একটি অংশ ছিলেন ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া এবং সাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন। বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা এবং যুক্তির অভাব ছিল তাঁদের বেশিরভাগের মধ্যে। চলবে