হেনরি ক্যাভেন্ডিশ

হেনরি ক্যাভেন্ডিশ

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ৫

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৪, ২০২৪

জর্জ আর্নস্ট স্ট্যাহল
জার্মান রসায়নবিদ জর্জ আর্নস্ট স্ট্যাহল ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নির্জীব বলতে কিছুই নেই। পৃথিবীর সকল জিনিসের ভেতরই জীবন রয়েছে। তবে তারা নির্দিষ্ট মাত্রায় জীবিত। নির্জীব জিনিসগুলো সবসময় স্থিতিশীল থাকে। দ্রুত এদের পরিবর্তন হয় না। আর জীবিত জিনিসগুলো পরিবর্তনশীল। এদের ভেতর পচনের প্রবণতা রয়েছে। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে স্ট্যাহল গাঁজন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি মনে করতেন, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হচ্ছে: রক্ত সঞ্চালন, মলত্যাগ ও নিঃসরণ। তার এই বিশ্বাসগুলো তিনি চিকিৎসা বিদ্যায় কাজে লাগান।

স্ট্যাহলের সমসাময়িক আরেক জার্মান রসায়নবিদ জোহান জোয়াকিম বেচার বলেছিলেন, সকল রকম দাহ্য পদার্থে দুটি প্রধান পদার্থ থাকে। আগুনের মিলনে একটি পদার্থ বের হয়ে উড়ে যায়, আরেকটি পদার্থ ছাই হিসেবে পড়ে থাকে। উড়ে যাওয়া পদার্থের তিনি নাম রাখলেন ফ্লজিস্টন। ফ্লজিস্টন তত্ত্বকে পরীক্ষামূলক ভিত্তি দিতে স্ট্যাহল বিভিন্ন ধাতু ও অন্যান্য পদার্থের ওপর পরীক্ষা করেন। এরপর বলেন, ফ্লজিস্টন সকল পদার্থেই অল্প পরিমাণে রয়েছে, কিন্তু তেলে সবচেয়ে বেশি রয়েছে। ফ্লজিস্টন বায়ু থেকে পৃথক করে গাছপালা নিজেদের শরীর পুষ্ট করতে গ্রহণ করে। কোনো জিনিস পচে যাওয়া মানে ওই জিনিস থেকে ফ্লজিস্টন ধীরে-ধীরে বের হয়ে যাওয়া। কার্বন মনোক্সাইড যে ক্ষতিকর, স্ট্যাহল এটি আবিষ্কার করেন। ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তিনি মারা যান।

জোসেফ ব্ল্যাক
স্কটল্যান্ডের রসায়নবিদ জোসেফ ব্ল্যাক ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ম্যাগনেসিয়াম, সুপ্ততাপ, আপেক্ষিক তাপ ও কার্বন ডাই-অক্সাইড আবিষ্কার করেন। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানাটমি ও রসায়ন বিভাগে দশ বছর তিনি শিক্ষকতা করেন। এরপর এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ ও রসায়ন বিভাগে ৩০ বছর শিক্ষকতা করেন। স্থির ক্ষারের ওপর জোসেফ ব্ল্যাক গবেষণা করেন। এই গবেষণার মধ্যদিয়ে তিনি পরিমাণ সংক্রান্ত রসায়ন শাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তার সময় পর্যন্ত সকলেই জানতো, কার্বোনেটেড ক্ষারকে দাহ্য ক্ষার থেকে তুলনামূলকভাবে সরল যৌগিক পদার্থ। তারা আরও জানতো, কার্বোনেটেড ক্ষারকে পুড়িয়ে চুনের সাথে মেশালে দাহ্য ক্ষার তৈরি হয়। ব্ল্যাক পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করলেন, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট আগুনে পেড়ালে সেটার ঘনত্ব কমে যায়। এতে তখন কোনো অ্যাসিড মেশালেও সেটা আর স্ফুটনশীল হয় না। এই ঘনত্ব কমার কারণ, ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট আগুনে পোড়ালে সেটা থেকে একপ্রকার বায়ু উড়ে চলে যায়। এ কারণে ম্যাগনেসিয়াম কার্বোনেট আগের চেয়ে হালকা হয়ে পড়ে। এই বায়ুর নাম তিনি দেন স্থির বায়ু।

জোসেফ প্রিস্টলি
১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ ইংল্যান্ডের লিডসে জন্মগ্রহণ করেন রসায়নবিদ জোসেফ প্রিস্টলি। গ্যাসীয় মৌলিক পদার্থগুলোর পরীক্ষামূল রসায়নে তার নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। প্রিস্টলি পরীক্ষা করে দেখতে পান, বাতি জ্বাললে সেটা থেকে একপ্রকার গ্যাস জন্মায়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রমাণ করলেন, বাতি জ্বালালে যে গ্যাস জন্ম নেয় সেই গ্যাসে কোনো প্রাণী বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না। জীবের নিশ্বাস ছাড়ার সময় ওই একই গ্যাস উৎপন্ন হয়। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট প্রিস্টলি অক্সিজেন আবিষ্কার করেন। পরে তিনি আরও অনেক গ্যাসীয় পদার্থ আবিষ্কার করেন। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রমাণ করেন, অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন একসাথে মিলিত হয়ে জল তৈরি করে। প্রিস্টলির আগে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, বায়ু কেবলমাত্র কার্বন ডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি।

প্রিস্টলি বায়ুতে আরও ১০টি গ্যাসীয় পদার্থের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। যার মধ্যে রয়েছে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রাস অক্সাইড। কাগজে পেনসিলের দাগ ঘষে তোলার জন্য তিনি রবারের ইরেজার ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের বুদবুদসমৃদ্ধ ঝাঁঝালো পানীয় (সোডাপানি) উদ্ভাবন করেন। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর প্রিস্টলি কার্বন মনোক্সাইড তৈরি করেন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রæয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়াতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

হেনরি ক্যাভেন্ডিশ
১৭৩১ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর ব্রিটিশ রসায়নবিদ হেনরি ক্যাভেন্ডিশ জন্মগ্রহণ করেন।  ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ক্যাভেন্ডিস পরীক্ষা করে দেখেন, বিশুদ্ধ বায়ুতে শতকরা ২০.৮ ভাগ অক্সিজেন এবং শতকরা ৭৯.২ ভাগ নাইট্রোজেন রয়েছে। এছাড়া তিনি বায়ু থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেন পৃথক করেন। তিনি বলেন, হাইড্রোজেন দাহ্য পদার্থ। তিনিই প্রথম বলেন, জল কোনো মৌলিক পদার্থ নয়। জল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দিয়ে তৈরি যৌগিক পদার্থ। আর্সেনিক নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন। অ্যাসিডে ধাতু কী রকম বিক্রিয়া করে তা দেখতে তিনি ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে গবেষণা করেছিলেন। এ গবেষণা করতে গিয়ে তিনি নাইট্রিক অ্যাসিড আবিষ্কার করেন। তিনিই প্রথম বলেছিলেন, বিভিন্ন পদার্থের ঘনত্ব পরিমাপ করতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পদার্থ নিতে হয়।

বায়ুমণ্ডলীয় বায়ুর গঠন, বিভিন্ন গ্যাসের বৈশিষ্ট্য, বৈদ্যুতিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণ এবং তাপের যান্ত্রিক তত্ত্ব ও গণনা পদ্ধতি ক্যাভেন্ডিশ উদ্ভাবন করেন। তিনি পৃথিবীর ঘনত্ব পরিমাপ করেছিলেন। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রæয়ারি তিনি মারা যান। চলবে