অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে

অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

পর্ব ৬

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৫, ২০২৪

কার্ল উইলহেম শেলি
জার্মান রসায়নবিদ কার্ল উইলহেম শেলি ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বায়ুর উপাদান পরীক্ষা করতে গিয়ে অক্সিজেন আবিষ্কার করেন। গবেষণায় তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, ফ্লজিস্টনের সাথে মিলিত হলে বায়ুর পরিমাণ কমে যায়। সুতরাং, বায়ুর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে সেটুকু নিশ্চয়ই আগের বায়ু থেকে ভারি হবে। বিষয়টি পরীক্ষা করে তিনি বিপরীত ফল পেলেন। বায়ুর যে অংশ বিলুপ্ত হলো সেই অংশের খোঁজে তিনি ফসফরাসসহ কয়েকটি ধাতু ও আরও কয়েকটি জিনিসকে বদ্ধ একটি পাত্রে রেখে পাত্রে আগুনের তাপ দিতে লাগলেন। এতেও সেই একই ফল পেলেন। শেষমেষ তিনি এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, বায়ুর একটি উপাদানের সাথে মিলিত হয়ে ফ্লজিস্টন যে একটি যৌগিক পদার্থ তৈরি করে, সেটি তাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই তাপ পাত্রের ভেতর থেকে অবশ্যই বের হয়ে যায়।

ফ্লজিস্টনের সাথে মিলিত হবার পর বায়ুর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে সেটুকু বায়ুর নাম তিনি দিলেন অগ্নিবায়ু। তার মতে, পারদ ভস্মকে আগুনে পোড়ালে আগুনের ফ্লজিস্টনটুকু পারদ ভস্মের সাথে মিলিত হয়ে পারদ তৈরি করে এবং অগ্নিবায়ু বের হয়ে যায়। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে শেলি মৌলিক পদার্থ ক্লোরিন আবিষ্কার করেন। কিছু দিন পরে তিনি মলিবডিক ও টংস্টিক অ্যাসিডের ভিন্ন অবস্থার প্রমাণ করেন। প্রæশিয়ান বøু সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি এটা থেকে হাইড্রোসায়ানিক অ্যাসিড পৃথক করেন। উদ্ভিত ও জীব সম্পর্কে তিনি রসায়ন শাস্ত্রে বিশেষভাবে আলোচনা করেন। টারটারিক, অক্জালিক, সাইট্রিক, ম্যালিক, গ্যালিক, ইউরিক, ল্যাকটিক ও মিউসিকসহ কয়েক কার্বোনেটেড অ্যাসিড তিনি প্রস্তুত করেন। গিøসারিন তার আবিষ্কার। তার বেশিরভাগ রাসায়নিক আবিষ্কারের কৃতিত্ব অন্য কেউ পেয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বায়ু ও আগুন সম্বন্ধে রাসায়নিক বই শিরোনামে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি বই লেখেন। কিন্তু প্রকাশকের দোষে বইটি ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই বইতে প্রিস্টলির চেয়েও তিনি অক্সিজেনের নিখুঁত বর্ণনা দেন। প্রিস্টলির অক্সিজেনের আবিষ্কারের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে কার্ল উইলহেম শেলি মৃত্যুবরণ করেন।

অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে
ফরাসি রসায়নবিদ অ্যান্টনি ল্যাভয়সিয়ে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ফরাসি পার্লামেন্টের অ্যাটর্নি। পিতার ইচ্ছে, ল্যাভয়সিয়ে বড় হয়ে আইনজীবি হবেন। ১১ বছর বয়সে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। স্কুল শেষ করে ভর্তি হলেন কলেজে। কিন্তু পিতার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে ভর্তি হতে হলো আইনের ক্লাসে। আইনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও আইন চর্চায় ল্যাভয়সিয়ের কোনোই আকর্ষণ ছিল না। তার বেশিরভাগ সময় কাটতো বিজ্ঞানচর্চায়। বাড়িতেই ছোট একটি গবেষণাগার গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক একটি রচনা জমা দেন। তাতে মৌলিক তথ্য না থাকলেও তার এই চেষ্টায় সকলে প্রশংসা করেন। পরের বছর ফরাসি একাডেমির পক্ষ থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতায় ল্যাভয়সিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

এসময় অনেক জ্ঞানী মানুষের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ জিন গুটার্ড। সেসময় তিনি ফরাসি দেশের ভূতত্ত্ব বিষয়ক মানচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ল্যাভয়সিয়ে তার সাথে বেরিয়ে পড়লেন। কয়েক মাস পর তিনি প্যারিসে ফিরে বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হতে আবেদন করেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হন। জীবদেহের ওপর চুম্বকত্বের প্রভাব, অভিকর্ষ জল সরবরাহ, রঙতত্ত¡, বাঁধাকপির বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন, চিনি তৈরি এবং কয়লা থেকে পিচ তৈরি করতে তিনি গবেষণা করেন। এসময় তিনি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পারেন গবেষনা চালিয়ে যেতে প্রচুর অর্থ দরকার। দু’বছর চাকরি করার পর উঁচু পদের এক কর্মকর্তার সুনজরে পড়েন ল্যাভয়সিয়ে। কর্মকর্তা তার মেয়ে মেরি অ্যার্নির সাথে ল্যাভয়সিয়ের বিয়ে দেন। মেরির বয়স তখন ১৪ বছর।

রসায়ন বিজ্ঞান যখন মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনায় সীমাবদ্ধ সেই সময়ে ল্যাভয়সিয়ে তার গবেষণার মাধ্যমে রসায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। সবার সামনে তিনি পরীক্ষা করে দেখালেন, একটি বস্তুকে আরেকটি বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়। একটি পাত্রে জল নিয়ে পাত্রের মুখ ঢেকে তিনি জল ফোটাতে শুরু করলেন। পুরোটা জল বাষ্প হয়ে উড়ে যাবার পর  দেখা গেল, পাত্রের নিচে খানিকটা মাটি পড়ে আছে। ল্যাভয়সিয়ে বললেন, এর থেকেই প্রমাণ হয় জল থেকে মাটি তৈরি হয়।

পরবর্তীতে গুঁড়ো পদার্থ দিয়ে নানা উপায়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখতে পান, পাত্রের ভেতর পড়ে থাকা গুঁড়ো মাটি নয়, পাত্রের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ। তিনি এবার জল ফোটানোর আগে জলসহ পাত্রটিকে ওজন করলেন। জল পুরোপুরি বাষ্পে পরিণত হওয়ার পর পাত্র ওজন করে দেখতে পেলেন, পাত্রের ওজন কমে গেছে। যেটুকু ওজন আছে সেই ওজন গুঁড়ো পদার্থের সমান। এই পরীক্ষা থেকে ল্যাভয়সিয়ে সিদ্ধান্তে এলেন, জল ফোটানোর জন্যই পাত্রের ক্ষয় হচ্ছে এবং জল থেকে কোনো মাটি তৈরি হচ্ছে না। তার উদ্ঘাটিত এই সত্য আলকেমি তত্ত¡কে ভুল প্রমাণিত করলো। তিনি আরও প্রমাণ করলেন, ফ্লজিস্টনের অনুমান ভুল। জল পরিবর্তিত হয়ে গাছের জন্ম দেয়, এই ধারণাও ভুল। গাছ আসলে বিভিন্ন পদার্থের সংমিশ্রণ। এসব পদার্থ গাছ গ্রহণ করে মাটি, জল আর বায়ু থেকে।

এই পরীক্ষার পর ল্যাভয়সিয়ে আগ্রহী হলেন বায়ুর উপাদান বিষয়ে। তখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, বায়ুর নানা প্রকার আছে। ল্যাভয়সিয়ে প্রথম বললেন, বায়ুর দুটি উপাদান। একটি শ্বাসযোগ্য, আরেকটি বিষাক্ত। গ্রিক শব্দ অক্সিস থেকে তিনি শ্বাসযোগ্য বায়ুর নাম দিলেন অক্সিজেন। অক্সিস মানে উৎপাদন করা। কেবল অক্সিজেন নয়, রসায়নে ব্যবহৃত অনেক শব্দের সংজ্ঞা তিনি নিরুপণ করলেন। তার আন্তরিক চেষ্টায় গড়ে উঠলো আধুনিক রসায়নের ভিত্তি। তিনি রসায়নের অভিধান প্রণয়ন করেন। তার প্রচলিত বহু শব্দ আজও পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সে সময়ের বেসরকারি একটি সংস্থা নানা রকম যুদ্ধাস্ত্র ও কামানের গোলাবারুদ তৈরি করে ফরাসি সরকারের কাছে বেচতো। কিন্তু ধীরে-ধীরে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের গুণগত মান খারাপ হচ্ছিল। এ অবস্থায় ল্যাভয়সিয়েকে প্রধান করে বিজ্ঞান একাডেমি কমিটি গঠন করলো। কমিটির ওপর দায়িত্ব দেয়া হলো, কিভাবে ওইসব দ্রব্যেও গুণগত মান ও পরিমাণ বাড়ানো যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া। গবেষণার দরকারে ল্যাভয়সিয়েকে বিরাট বাসস্থান দেয়া হলো। সেই সঙ্গে চাহিদামতো গবেষণার উপকরণ। ১৭ বছর তিনি এই গবেষণায় কাটিয়ে দেন। গোলাবারুদের কার্যকারিতা তিনি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেন এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহজ করে তোলেন। এই সময়ে তিনি নিজস্ব গবেষণাও চালিয়ে যান।

নির্দিষ্ট অনুপাতের অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তার মধ্যে বিদ্যুৎ চালনা করে ল্যাভয়সিয়ে জল উৎপাদন করলেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ফরাসি বিপ্লব। এই বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। শাসনভার গ্রহণ করে বিপ্লবী ট্রাইবুন্যাল। বিপ্লবে যারা সমর্থন দেয়নি তাদেরকে ট্রাইবুন্যাল গিলোটিন নামের যন্ত্র দিয়ে শিরোশ্চেদ করতো। ল্যাভয়সিয়ে এসব রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন। গবেষণায় ডুবে থাকতেন সারাক্ষণ। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি বিপ্লবী দলের সংবাদপত্রে তার একটি প্রবন্ধ ছাপা হলো। এক বিপ্লবী নেতা তাকে সরিয়ে নিজেই বিজ্ঞানজগতে বিখ্যাত হতে ল্যাভয়সিয়ের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে মামলা ঠুকে দিলেন যে, ল্যাভয়সিয়ে রাজতন্ত্রের সমর্থক। বিচারে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে গিলোটিন দিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। চলবে