জন ডাল্টন

জন ডাল্টন

আবু তাহের সরফরাজের প্রবন্ধ ‘রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশ’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২৪

জন ডাল্টন
পারমাণবিক তত্ত্বের জনক জন ডাল্টন ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ইগলসফিল্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়সে ডাল্টন স্কুলে ভর্তি হন। তবে স্কুলে নয়, তিনি বাড়িতে বসেই নিজের চেষ্টায় বিজ্ঞান ও গণিতে দক্ষতা অর্জন করেন। ১৫ বছর বয়সে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি কলেজে গণিত ও প্রাকৃতিক দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কলেজের গবেষণাগারে শুরু হয় তার গবেষণা। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ছাড়লেন কলেজের চাকরি। গণিত ও রসায়নের গৃহশিক্ষক হিসেবে জীবিকা শুরু করলেন।

এ সময়ে তিনি তাপের পরিবহন, তাপ দ্বারা গ্যাসের প্রসারণ, আলোর ধর্ম ও আবহাওয়ার ওপর গবেষণা করেন। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে গ্যাস ও তরলের প্রসারণ সম্পর্কে তিনি একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। গবেষণার দুটি সিদ্ধান্ত ছিল: ক. সকল গ্যাসকেই খুবই নিম্ন তাপমাত্রায় এবং খুব বেশি চাপে তরলে পরিণত করা যায়। খ. কোনো আবদ্ধ পাত্রে স্থায়ী আয়তনে গ্যাসের চাপের ওঠানামা গ্যাসের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে ডাল্টটন গ্যাসের আংশিক চাপের সূত্র প্রকাশ করেন। এই সূত্র এখনো পর্যন্ত প্রতিটি রসায়ন গবেষণাগারে গবেষকরা অনুসরণ করেন।

সূত্রটি হচ্ছে, একটি আরেকটির সাথে বিক্রিয়া করে না এ রকম একের বেশি গ্যাসীয় পদার্থ একসাথে মোট যে চাপ দেয় সেই চাপ এবং এক-একটি গ্যাসীয় পদার্থ এককভাবে যে চাপ দেয় সেই চাপের যোগফল পরস্পর সমান। ডাল্টন ভাবতেন, গ্যাসীয় পদার্থের ওজন ক্ষুদ্র যে বস্তুর কারণে পরিমাপ করা যায় না সেই বস্তুটি কী হতে পারে! এসময় তার মনে পড়লো গ্রিক বিজ্ঞানী ডেমোক্রিটাসের কথা। যিনি বলেছিলেন, সকল বস্তুই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি। যার নাম পরমাণু। এই পরমাণু ভাঙা যায় না। এই পরমাণু নিয়ে গবেষণা করতে করতে ডাল্টন একটি সূত্র আবিষ্কার করলেন, যা ডাল্টন সূত্র নামে পরিচিত।

সূত্রটি হচ্ছে, দুটি মৌলিক পদার্থের বিক্রিয়ায় একের বেশি যৌগিক পদার্থ তৈরি হলে যৌগিক পদার্থগুলোয় প্রথম মৌলিক পদার্থের একটি নির্দিষ্ট ভরের সাথে দ্বিতীয় মৌলিক পদার্থটি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে মিলিত হবে। যেমন: ১২ গ্রাম কার্বনের সাথে ১৬ গ্রাম অক্সিজেন বিক্রিয়া করে যৌগিক পদার্থ কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। আবার, একই পরিমাণ কার্বনের সাথে ৩২ গ্রাম অক্সিজেন বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। দুই ক্ষেত্রে কার্বনের পরিমাণ এক হলেও অক্সিজেনের পরিমাণ আলাদা আলাদা। এর অনুপাত ১২:১৬ বা ৩:৪। মানে, পূর্ণ সংখ্যার অনুপাত।

ডাল্টনের সবচেয়ে বিস্ময়কর তত্ত্ব হচ্ছে পারমাণবিক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী:
১. সকল মৌলিক পদার্থ খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু দিয়ে তৈরি। এসব পরমাণু চোখে দেখা যায় না।
২. একই মৌলিক পদার্থের প্রতিটি পরমাণুর ভর ও ধর্ম একই।
৩. আলাদা আলাদা মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম আলাদা আলাদা।
৪. পরমাণুকে ধ্বংস বা সৃষ্টি করা যায় না। পরমাণুকে ভাঙাও যায় না।
৫. রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একের বেশি পরমাণু একটার সাথে আরেকটা মিলিত হয় কিংবা একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন হয়।
৬. পরমাণু সাধারণত পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে একটার সাথে আরেকটা মিলিত হয়ে যৌগিক পদার্থ তৈরি করে।

পারমাণবিক তত্ত্বে ডাল্টন বলেছেন, পরমাণুকে ভাঙা যায় না। কিন্তু এখন আমরা জানি, পরমাণুকে ভাঙা যায়। ডাল্টন আরও বলেছেন, একই মৌলিক পদার্থের পরমাণু একই ভরের। কিন্তু এখন আমরা জানি, একই মৌলিক পদার্থে বিভিন্ন ভরের পরমাণু থাকতে পারে। এসব পরমাণুকে আইসোটোপ বলে। যেমন: হাইড্রোজেন পরমাণু তিন রকম। ক. সাধারণ হাইড্রোজেন বা প্রোটিয়াম। খ. ভারি হাইড্রোজেন বা ডিউটেরিয়াম। গ. তেজস্ক্রিয় হাইড্রোজেন বা ট্রিটিয়াম। প্রোটিয়াম পরমাণুতে একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রোটন রয়েছে, কোনো নিউট্রন নেই। তাই প্রোটিয়ামের ভরসংখ্যা ১।

ডিউটেরিয়াম পরমাণুতে একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রোটন ছাড়াও অতিরিক্ত একটি নিউট্রন রয়েছে, তাই এর ভরসংখ্যা ২। ট্রিটিয়াম পরমাণুতে একটি ইলেকট্রন ও একটি প্রোটন ছাড়াও অতিরিক্ত দুটি নিউট্রন রয়েছে, তাই এর ভরসংখ্যা ৩। উল্লিখিত তিনটি পরমাণু হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ।

ডাল্টনের পারমাণবিক তত্ত্বে আরও একটি ভুল হচ্ছে, তিনি বলেছেন, আলাদা আলাদা মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম আলাদা আলাদা। কিন্তু আধুনিক রসায়ন প্রমাণ করছে, আলাদা আলাদা মৌলিক পদার্থের একের বেশি আইসোটোপের ভর একই হতে পারে। যেমন: দস্তা, তামা ও নিকেলের আইসোটোপের ভর ৬৪ একক।

সারা জীবন খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করে গেছেন জন ডাল্টন। জীবনকে উৎসর্গ করেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ধর্মের প্রতি। আজকে রসায়নের যে উন্নতি তার দরজা খুলে দেন ডাল্টন। তার তত্ত্বগুলো বিশ্লেষণ করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক রসায়ন। সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজকের সময় পর্যন্ত রসায়নের যে অগ্রযাত্রা, সেই যাত্রায় রসায়নকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন অসংখ্য রসায়নবিদ। তাদের প্রত্যেকের নিরলস পরিশ্রম ও নিবিড় পর্যবেক্ষণে রসায়নে নতুন নতুন আবিষ্কার সংযোজন হয়েছে। সেই ইতিহাস বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধে করা হয়নি। খুবই ছোট্ট আকারে রসায়নের সূচনা ও ক্রমবিকাশের ধারা এখানে উল্লেখ করা হয়েছে।

উদ্দেশ্য হচ্ছে, রসায়নের মতো বিজ্ঞানের রোমাঞ্চকর একটি শাখার সাথে ছোটদের পরিচিত করে তোলা। এই পরিচয়ের মধ্যদিয়ে তারা রসায়নের গভীরে ঢোকার আগ্রহবোধ করবে। রসায়নের রথি-মহারথিদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কেও তাদের আগ্রহ জন্মাবে। সেই আগ্রহ থেকে তারা পাঠ করবে রসায়নের ওপর লেখা বিভিন্ন বই। এই প্রবন্ধে আমি কেবল তাদেরকে একটি ধাক্কা দিয়ে দিলাম।