আবুল হাশিমের প্রবন্ধ ‘জ্ঞান পিপাসা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০২০

একজন নিরক্ষর আরব হযরত মুহম্মদ (স.) অনুপ্রাণিত অবস্থায় যা উচ্চারণ করেছিলেন, মরুভূমির নিরক্ষর সন্তানদের তা পরিণত করেছিল তৎকালীন জগতের শিক্ষাগুরুতে। বিরাট আধ্যাত্মিক ও নৈতিক রূপান্তর আরবকে মহান করে তুলল। কলেমা তাকে এ জ্ঞান দান করল যে, সে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করবে না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্যও চাবে না। সে সৃষ্টির সেরা, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং সৃষ্টির আরসব কিছু তার অধীন করে দেয়া হয়েছে। সে জানে, সে যখন স্রষ্টার সামনে মাথা নত করে তখন সৃষ্টির আরসব কিছুও স্রষ্টার সামনে মাথা নত করে এবং বেহেস্ত থেকে আল্লাহর আশির্বাদ তার ওপর আকাশের বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। মহান আরব চারদিকে তাকায়ং সৃষ্টি জগতের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয় আর গভীর কৃতজ্ঞতাভরে আল্লাহর গুণকীর্তন করে। আকাশের অসংখ্য তারকা, চন্দ্র ও সূর্য, পৃথিবীর নানা রঙের বৃক্ষ, লতাপাতা, জীবজন্তু, পাহাড়-পর্বত, নদনদী ও সাগর-মহাসাগর তাকে তার ভাগ্য সম্বন্ধে সচেতন করে তোলে।

তার কানে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয় সৃষ্টিকর্তার উদাত্ত বাণী, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহম্মদ আল্লাহর রাসূল।’ মাত্র গতকাল সে ছিল বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দাস, তার সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল কীভাবে এসব শক্তির ক্রোধকে প্রশমিত করা যায়। আজ সে তাদের প্রভু আর ওরা দাস। কলেমা প্রকৃতির সম্পদ সম্বন্ধে তার মনোভাবের এই পরিবর্তন ঘটালো। তার সুখশান্তি বাড়াতে ও জীবনসংগ্রামে আনন্দ লাভের জন্য এখন তাকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলো কাজে লাগাতে হবে। সে ভাবে এবং চিন্তামগ্ন হয়।

প্রকৃতির শক্তিগুলোকে মানুষের উপকারে ব্যবহার করতে হলে এর একমাত্র উপায় এসব শক্তির রহস্য উদ্ঘাটন করা এবং তাদের ফিতরত বা প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করা। এ কথা বোঝার জন্যে কি খুব বেশি স্বজ্ঞা বা সহজাত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়? উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষের উপকারে বৈদ্যুতিক শক্তি ব্যবহার করতে হলে বৈদ্যুতিক শক্তির ফিতরত সম্বন্ধে সূক্ষ্ম ও প্রণালিবদ্ধ জ্ঞানের কি প্রয়োজন হয় না? সুতরাং জ্ঞান আহরণ করা কলেমায় বিশ্বাসের অন্যতম অঙ্গ। অন্ধকারের কাছে আলো যা, অজ্ঞতার ক কলেমায় বিশ্বাসও তা। তাই কলেমা ক্রমবর্ধমান জ্ঞান-পিপাসা সৃষ্টি করে। যে জ্ঞান আহরণে অমনোযোগী সে কলেমার শিক্ষার প্রতি অমনোযোগী। যে সমাজ বা রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে জ্ঞান আহরণ করার অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা দেয় না, সে সমাজ বা রাষ্ট্র মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্র নয়।

রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, “জ্ঞান আহরণ প্রত্যেক নর-নারীর জন্য বাধ্যতামূলক।” তিনি নির্দেশ দেন, “জ্ঞান আহরণের জন্যে প্রয়োজন হলে চীন দেশে যাও।” তাঁর অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবকে প্রসারিত করতে তিনি আরো বলেন, “পৃথিবী পরিভ্রমণ করো।” ইসলামের বিদ্বান ধর্মবিদরা নিজেদের অভ্যাসগত অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার কারণে মুক্ত জ্ঞান আহরণের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন; সম্ভবত তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাধারণ মানুষের বিশ্বাস প্রবণতার সুযোগ নিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধশালী করে তোলা। তারা ভুলে যান যে, জ্ঞান আহরণ করার জন্যে মহানবি (স.) যখন তাঁর অনুসারীদের চীন দেশে যাওয়ার পরামর্শ দেন তখন ইসলামি ধর্মতত্ত্ব শিক্ষাদানের কোনো বিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান চীনে ছিল না। ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিতদের এই মনোভাবই আধুনিক বিশ্বের তথাকথিত মুসলিম জাতিগুলোর শিক্ষাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাৎপদতার কারণ।

প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কাছে কলেমা একটি মুখের বুলি ছিল না। তাদের কাছে কলেমা ছিল নিঃশ্বাসের মতো বেঁচে থাকার বাস্তব উপায়। কলেমা শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরবরা জ্ঞান আহরণের জন্যে সর্বাত্মক অভিযান ও প্রচেষ্টা চালায়। জ্ঞানার্জনে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। জ্ঞানান্বেষণে আরবরা পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারা পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর ও দক্ষিণে গেল, সমুদ্রের ঢেউ জয় করল, শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদান করার জন্য তাদের নৌকা ও জাহাজ তাদেরকে নিয়ে গেল নতুন নতুন দেশে ও নতুন নতুন জাতির কাছে। তাদের মুক্তবুদ্ধি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করল। তারা সব কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে দিল। তারা গ্রিকদের লুপ্ত জ্ঞানভাণ্ডার উদ্ধার করল, যেভাবে ইউরোপের শাদা জাতিগুলো উদ্ধার করেছে প্রাচীন ভারতের দর্শন, শিল্প, বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পদ। আরবরা সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটলদের গ্রন্থাদি তাদের নিজের ভাষায় তরজমা করে গ্রিকদের সঞ্চিত জ্ঞানভাণ্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিল। তারা নিজেরা জ্ঞানলাভ করেই সন্তুষ্ট হলো না, অন্যদেরকে জ্ঞানলাভে সাহায্য করা তারা কর্তব্য বলে মনে করল। এভাবে তারা মহৎ প্রতভা সৃষ্টি করে দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও ঐতিহাসিকদের এক বিরাট সমাবেশ ঘটালো। তারা তাদের কলমের শক্তিতে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি ও কর্মে আমূল পরিবর্তন সাধন করল। তারা অনেক কিছু উদ্ধাবন ও আবিষ্কার করে। শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি জ্ঞানের প্রত্যেক বিভাগে মৌলিক অবদান রাখে। এসবের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুউচ্চ সৌধ।

আবুল হাশিমের ‘ইসলামের মর্মকথা’ বই থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো