আশুরা: বাস্তবতা ও পালনীয়-বর্জনীয় বিষয়সমূহ

পর্ব ১

তারিকুজ্জামান তারেক

প্রকাশিত : আগস্ট ২৭, ২০২০

হিজরি বছরের প্রথম মাস হলো মুহাররম। আর মাসটির দশম তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা দিবস’। কুরআন-সুন্নাহয় এ মাস ও দিবসের কিছু ফজিলত ও গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। বিশেষত আশুরা দিবসটি এতে সবিশেষ গুরুত্ব রাখে। কিন্তু আমাদের সমাজে এ দিবসকে কেন্দ্র করে ইসলামের নামে যা ঘটে, তার সিংহভাগই ইসলাম-সমর্থিত নয়। বিভিন্ন মিথ্যা ঘটনাবলীর বর্ণনা ও কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালিত হয় এ দিবস। অধিকাংশ মানুষই জানে না, এ দিবসের পালনীয় বিষয়গুলো কী এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো কী? জানে না তারা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময়ে এ দিবস কীভাবে পালিত হতো? তাই আমরা গুরুত্বপূর্ণ এ প্রবন্ধে দলিল-প্রমাণের আলোকে আশুরা দিবসের পালনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরব এবং সাথে এসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন রুসুম-রেওয়াজ ও মিথ্যা কল্প-কাহিনীর বিবরণও সবিস্তরে আলোচনা করব। আল্লাহ-ই আমাদের সাহায্যকারী এবং তিনিই তাওফিকদাতা।
আলোচনার সুবিধার্থে আমরা প্রবন্ধটিকে দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত করব। প্রথম অধ্যায়ে আমরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল নিয়ে আলোচনা করব। যাতে মানুষ এ অনুসারে নিজেদের আকিদা ও আমল ঠিক করে নিতে পারে। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে আশুরা দিবসকে উপলক্ষ করে নানা বিদআত, কুসংস্কার, ভ্রান্ত আকিদা ও মিথ্যা কল্পকাহিনীর বিবরণ তুলে ধরব। যেন মানুষ এগুলো যথাযথভাবে জেনে এসব কর্ম ও বিশ্বাস থেকে নিবৃত্ত থাকতে পারে।

প্রথম অধ্যায়
এ অধ্যায়ে আমরা মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল নিয়ে মোট সাতটি ভাগে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। আশা করা যায়, এ অধ্যায়ের পুরো আলোচনা ভালো করে পড়লে মুহাররম মাস ও আশুরা দিবসের পালনীয় সকল বিষয়ে আমাদের সম্যক জ্ঞান অর্জন হবে।

মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট অত্যন্ত সম্মানিত মাসগুলোর একটি। বান্দার জন্য এ সম্মানিত মাসগুলোর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা কর্তব্য। এসব মাসে অধিক পরিমাণে ইবাদত করার চেষ্টা করবে এবং গুনাহ থেকে বিশেষভাবে বেঁচে থাকবে। কেননা, এ মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহ অন্যান্য মাসগুলোতে কৃত ইবাদত ও গুনাহর চেয়ে অধিক গুরুত্ব রাখে।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর বিধানে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা হলো বারোটি। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কাজেই এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না।’ (সুরা আত-তাওবা : ৩৬)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত মাস বলে অভিহিত করেছেন। আর সে চারটি মাস হলো, রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে :

আবু বাকরা রা. সূত্রে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আল্লাহ যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে সময় যেভাবে আবর্তিত হচ্ছিল আজও তা সেভাবেই আবর্তিত হচ্ছে। বারো মাসে এক বছর। এর মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। ধারাবাহিকভাবে রয়েছে তিনটি মাস, যথা জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররম। আর একটি মাস হলো রজব, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মাঝে অবস্থিত।’ (সহিহুল বুখারি : ৪/১০৭, হা. নং ৩১৭৯, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

উপরিউক্ত আয়াত ও তার ব্যাখ্যা সংবলিত হাদিস থেকে প্রমাণ হলো যে, মুহাররম মাস আল্লাহর নিকট সম্মানিত একটি মাস। সম্মানিত মাসগুলোতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে গুনাহ করা থেকে বেঁচে থাকতে বিশেষভাবে আদেশ দিয়েছেন। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, এসব মাসে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চাইতে অধিক গুরুতর অপরাধ। আর শরিয়তের মূলনীতি হলো, যেখানে গুনাহ করলে গুরুতর অপরাধ হয়, সেখানে ইবাদত করলে বেশি সওয়াব অর্জন হয়।

আল্লামা ইবনে কাসির রহ. বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাআলা এ মাসগুলো থেকে চারটি মাসকে আলাদা করে হারাম করেছেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। এ মাসগুলোতে গুনাহকে অধিক জঘণ্য করেছেন এবং সৎকর্ম ও সওয়াবকে বৃদ্ধি করেছেন। আল্লাহর বাণী “কাজেই এ মাসগুলোতে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না” এর ব্যাখ্যায় কাতাদা রহ. বলেন, নিশ্চয় হারাম মাসগুলোতে গুনাহ করা অন্যান্য মাসে গুনাহ করার চেয়ে অধিক গুরুতর অপরাধ। যদিও সর্বাবস্থায়ই গুনাহ নিষিদ্ধ, কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজের ইচ্ছানুসারে তাঁর কোনো বিষয়কে বড় ও গুরুত্ববহ করে দেন।’ (তাফসিরু ইবনি কাসির : ৪/১৩০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এ মাসে অধিক পরিমাণে সিয়াম পালন করবে। কেননা, নফল সিয়ামের জন্য সবচেয়ে উত্তম মাস হলো মুহাররম। যেমন সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে :

আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রমজানের সিয়ামের পর সবচেয়ে উত্তম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম। আর ফরজ সালাতের পর সবচেয়ে উত্তম হলো তাহাজ্জুদের সালাত।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮২১, হা. নং ২০২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসির আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এ হাদিস থেকে  স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, এ মাসে সিয়াম পালন করার সওয়াব অন্যান্য মাসে সিয়াম পালনের চেয়ে বেশি। সুতরাং যাদের সাধ ও সাধ্য আছে, তাদের এ সম্মানিত মাসে অধিক পরিমাণে সিয়াম পালন করা উচিত।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো রমজানের পর সবচেয়ে বেশি সিয়াম পালন করতেন শাবান মাসে, তাহলে শাবানের চেয়ে মুহাররম মাসের সিয়াম পালন উত্তম হয় কী করে? ইমাম নববি রহ. এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন :

সম্ভবত তিনি মুহাররমের এ ফজিলতের কথা জীবনের শেষ দিকে জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু (তাঁর ওফাত হয়ে যাওয়ায় এ মাসে) সিয়াম পালনের আর সুযোগ পাননি। কিংবা হতে পারে যে, এ মাসে তাঁর বিভিন্ন সমস্যা; যেমন সফর, অসুস্থতা ইত্যাদির কারণে অধিক সিয়াম পালন করতে পারেননি।’ শারহু মুসলিম, নববি : ৮/৩৭, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

মুহাররম মাসের দশ তারিখ তথা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা, এ দিবসে সিয়াম পালন করলে বান্দার পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :

আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকটে আসল। …অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,… আশুরা দিবসের সিয়ামের ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকটে আশাবাদী যে, তিনি এদ্বারা বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৮১৮, হা. নং ১১৬২, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

আশুরার সিয়াম পালনের জন্য কাউকে বাধ্য করা যাবে না। কেননা, এটা মুসতাহাব। তাই কেউ সিয়াম রাখতে না চাইলে তার ওপর কোনোরূপ চাপাচাপি ও জোরজবরদস্তি করা যাবে এবং তার প্রতি কোনো বিরূপ ধারণাও পোষণ করা যাবে না। যেমন সুনানে আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে, আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও জাহিলিয়াতের যুগে (নফল হিসেবে) এ সিয়াম পালন করতেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় আসলেন তখন তিনি (ফরজ হিসেবে নিজেও) সিয়াম রাখলেন এবং (সাহাবিদেরকেও) সিয়াম পালনের আদেশ দিলেন। এরপর যখন রমযানের সিয়াম ফরজ করা হলো তখন তা আবশ্যক হয়ে গেল এবং আশুরার সিয়ামের আবশ্যকীয়তা রহিত হয়ে গেল। অতএব যার ইচ্ছা সে এ সিয়াম পালন করবে এবং যার ইচ্ছা সে পরিত্যাগ করবে।’ (সুনানু আবি দাউদ : ২/৩২৬, হা. নং ২৪৪২, প্রকাশনী : আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)

আশুরার সিয়াম শুধু একটি রাখা ঠিক নয়; বরং তার সাথে আগে বা পরে আরেকটি সিয়াম রাখতে হবে, অন্যথায় তা মাকরুহ হবে। অর্থাৎ মুহাররমের ৯ ও ১০ তারিখ কিংবা ১০ ও ১১ তারিখ মিলে যেকোনো দুটি সিয়াম রাখা নিয়ম। এর কারণ হলো, ইহুদিরাও ১০-ই মুহাররম সিয়াম পালন করে। তাই আমাদের ইবাদতকে তাদের ইবাদতের সাথে অমিল করার জন্য অতিরিক্ত আরেকটি সিয়াম রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করো এবং ইহুদিদের বিরোধিতা করো। তোমরা এর আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি সিয়াম পালন করো।’ (মুসনাদু আহমাদ : ৪/৫২, হা. নং ২১৫৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এ হাদিসে দশ তারিখের সাথে ৯ বা ১১ যেকোনো একদিন সিয়াম রাখার কথা বলা হলেও সবচেয়ে উত্তম হলো ৯ তারিখের সাথে মিলিয়ে রাখা। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এদিনে সিয়াম পালনের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। যেমন সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নিজে আশুরা দিবসে সিয়াম রাখলেন এবং (সাহাবায়ে কিরামকেও) সিয়াম রাখার আদেশ দিলেন তখন সাহাবায়ে কিরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, এটা এমন এক দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আগামী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা নয় তারিখেও রোজা রাখব। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, কিন্তু আগামী বছর আসতে না আসতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাত হয়ে যায়।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৭৯৭, হা. নং ১১৩৪, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

আশুরা দিবস গুরুত্বপূর্ণ হওয়া এবং এদিনে সিয়াম পালনের কারণ হলো, আল্লাহ তাআলা মুসা আ. ও তাঁর সম্প্রদায়কে এদিন জালিম ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তিদান করেছিলেন। যেমন সহিহ বুখারির বর্ণনায় এসেছে, ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইহুদিগণ আশুরা দিবসে সিয়াম পালন করে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার? (তোমরা এদিনে সিয়াম পালন করছ কেন?) তারা বলল, এটা অতি উত্তম দিন। এদিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল হতে নাজাত দান করেছেন, ফলে এদিনে মুসা আ. সিয়াম পালন করেছেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের অপেক্ষা মুসা আ.-এর অধিক নিকটবর্তী। এরপর তিনি এদিনে সিয়াম পালন করলেন এবং (অন্যদেরকেও) সিয়ামের নির্দেশ দিলেন।’ (সহিহুল বুখারি : ৩/৪৪, হা. নং ২০০৪, প্রকাশনী : দারু তাওকিন নাজাত, বৈরুত)

আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা। বলা হয় যে, এদিনে কেউ নিজ পরিবারে খাবারের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা অবলম্বন করলে আল্লাহ সারা বছর তার রিজিকের মধ্যে প্রশস্ততা দান করবেন। যেমন বর্ণিত হয়েছে, আবু সাইদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ তাআলা সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।’ (আল-মুজামুল আওসাত, তাবারানি : ৯/১২১, হা. নং ৯৩০২, প্রকাশনী : দারুল হারামাইন, কায়রো; আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ১০/৭৭, হা. নং ১০০০৭, প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, কায়রো; মুজামু ইবনিল আরাবি : ১/১৪০, হা. নং ২২৫, প্রকাশনী : দারু ইবনিল জাওজি, সৌদিআরব; শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩১, হা. নং ৩৫১২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ; ফাজায়িলুল আওকাত : পৃ. নং ৪৫২, হা. নং ২৪৪, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মানার, মক্কা)

এ হাদিসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মতানৈক্য রয়েছে। কারও মতে হাদিসটি মুনকার (প্রত্যাখ্যাত)। আর কারও মতে হাদিসটি দুর্বল হলেও একাধিক সনদে বর্ণিত হওয়ায় হাসান লি-গাইরিহি, যা আমলযোগ্য হাদিস। যেমন ইমাম বাইহাকি রহ. একাধিক সনদে অনেকগুলো হাদিস বর্ণনা করে বলেন, এ সনদগুলো যদিও সব দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে। আল্লাহই ভালো জানেন।’ (শুআবুল ইমান, বাইহাকি : ৫/৩৩৩, হা. নং ৩৫১৫, প্রকাশনী : মাকতাবাতুর রুশদ, রিয়াদ)

হাফিজ সুয়ুতি রহ. বলেন, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে নিজ পরিবারের জন্য প্রশস্ততা অবলম্বন করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে প্রশস্ততা দান করবেন।” এটা সুসাব্যস্ত হাদিস নয়; বরং এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী। (হাফিজ সুয়ুতি রহ. বলেন,) আমি বলব, কক্ষনো নয়; বরং এটা সুসাব্যস্ত বিশুদ্ধ হাদিস। হাদিসটি ইমাম বাইহাকি রহ. শুআবুল ইমানে আবু সাইদ খুদরি রা., আবু হুরাইরা রা., ইবনে মাসউদ রা. ও জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। শেষে বলেছেন, “এ সনদগুলোর সবই দুর্বল, কিন্তু দুর্বল সনদগুলো পরস্পরে মিলে শক্তিশালী হয়ে গেছে।”’ (আদ দুরারুল মানসুরা ফিল আহাদিসিল মুশতাহিরা : পৃ. নং ১৮৬, হা. নং ৩৯৭, প্রকাশনী : ইমাদাতু শুউনিল মাকতাবাত, জামিআ মালিক সাউদ, রিয়াদ)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. বলেন, যদি (এতে) অস্পষ্ট রাবিটি না থাকত তাহলে এর সনদটি জাইয়িদ বা ভালো বলে বিবেচিত হতো। তথাপি পূর্বের রিওয়ায়াতের ভিত্তিতে এটা শক্তিশালী হয়ে যায়।’ (আল-আমালিল মুতলাকা : পৃ. নং ২৮, প্রকাশনী : আল মাকতাবুল ইসলামি, বৈরুত)
হাফিজ সাখাবি রহ. তাঁর ‘আল-মাকাসিদুল হাসানা’ গ্রন্থে হাফিজ ইরাকি রহ.-এর বক্তব্য নকল করে বলেন, ইরাকি রহ. স্বীয় “আমালি”-তে বলেছেন, আবু হুরাইরা রা.-এর হাদিসের অনেক সনদ রয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু সনদকে হাফিজ ইবনে নাসির রহ. বিশুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ...তিনি আরও বলেন, হাদিসটি আরেক সনদে জাবির রা. থেকে সহিহ মুসলিমের (বিশুদ্ধতার) শর্তানুযায়ী বর্ণিত হয়েছে। হাদিসটি ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহ. “আল ইসতিজকার” গ্রন্থে আবুজ জুবাইর রহ. সূত্রে জাবির রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ সনদ। এছাড়াও তিনি (ইমাম ইবনে আব্দিল বার রহ. স্বীয় গ্রন্থে) এবং ইমাম দারা কুতনি রহ. “আল-আফরাদ” গ্রন্থে উমর রা.-এর বাণী হিসেবে ভালো একটি সনদে বর্ণনা করেছেন।’ (আল মাকাসিদুল হাসানা : পৃ. নং ৬৭৪, হা. নং ১১৯৩, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এর বিপরীতে আরেকদল মুহাদ্দিসের নিকটে হাদিসটি বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। যেমন হাফিজ ইবনে কাইয়িম রহ. বলেন, আশুরা দিবসে সুরমা লাগানো, সাজসজ্জা করা, খাবারের মান উন্নত করা, বিশেষ সালাত পড়া ও তার বিভিন্ন ফজিলত-সংক্রান্ত যেসব হাদিস রয়েছে, তার একটাও সঠিক নয়। এসংক্রান্ত একটি হাদিসও বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এদিনে সিয়াম পালন ছাড়া অন্য কিছু সাব্যস্ত নয়। সিয়াম পালনের হাদিস ছাড়া সকল বর্ণনাই বাতিল।’ (আল-মানারুল মুনিফ : পৃ. নং ১১১, হা. নং ২২২, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল মাতবুআতিল ইসলামিয়্যা, হালব)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. আশুরা দিবসের বিভিন্ন রুসুম-রেওয়াজের আলোচনা করে বলেন, এসব রুসুম-রেওয়াজ সব বর্জনযোগ্য বিদআত। এগুলোর কোনোটিই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশিদিনের আদর্শ নয়। ...যদিও পরবর্তী কিছু ইমাম এগুলোর কিছু করার অনুমোদন দিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে হাদিস ও আসার বর্ণনা করে বলেছেন, এর কিছু বর্ণনা সহিহ; কিন্তু আমি বলব, বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে অবগত বিজ্ঞ উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে তারা নিঃসন্দেহে ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ইমাম হারব কিরমানি রহ. তার ‘আল মাসায়িল’-এ বলেন, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ.-কে আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করার হাদিসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এটাকে কোনো হাদিস বলে গণ্যই করলেন না।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়া : ২৫/৩১২-৩১৩, প্রকাশনী : মাজমাউল মালিক ফাহাদ, মদিনা)
শাইখ আলবানি রহ. বলেন, হাদিসটি আরও অনেক সনদে বর্ণিত হয়েছে, যার সবগুলোই দুর্বল। তবে দুর্বল সনদ সব মিলে শক্তিশালী হয়ে যায়; যেমনটি বলেছেন হাফিজ সাখাবি রহ.। আমি বলব, এটা হাফিজ সাখাবি রহ.-এর সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমি এটাকে সঠিক মনে করি না। কেননা, একাধিক দুর্বল সনদে হাদিস শক্তিশালী হওয়ার জন্য সনদে মাতরুক (পরিত্যাক্ত) ও মুত্তাহাম (মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত) বর্ণনাকারী না থাকা শর্ত, যা এ হাদিসে অনুপস্থিত।’ (তামামুল মিন্নাহ : পৃ. নং ৪১০, প্রকাশনী : দারুর রায়া, কায়রো)

তিনি প্রত্যেকটি সনদের দুর্বলতাগুলো বিশদভাবে আলোচনা করেছেন তাঁর ‘সিলসিলাতুল আহাদিসিজ জইফা’ গ্রন্থে। বিস্তারিত জানার জন্য গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে। (সিলসিলাতুল আহাদিসিজ জইফা : ১৪/৭৩৮, হা. নং ৬৮২৪, প্রকাশনী : দারুল মাআরিফ, রিয়াদ)
ইমাম ইবনুল জাওজি রহ. আশুরা দিবসে খাবারের মান উন্নত করা-সংক্রান্ত হাদিসটি বর্ণনা করে ইমাম উকাইলি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন, ইমাম উকাইলি রহ. বলেন, সালমান নামক রাবিটি অজ্ঞাত। আর (খাবারের মান উন্নত করাসংক্রান্ত) হাদিসটি মাহফুজ (সংরক্ষিত) নয়। (ইবনে জাওজি রহ. বলেন,) আর এসংক্রান্ত কোনো মুসনাদ হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনো কিছু বর্ণিত হয়নি।’ (আল-মাওজুআত : ২/২০৩, প্রকাশক : মুহাম্মাদ বিন মুনির, মদিনা)
মুল্লা আলি কারি রহ. হাফিজ জারকাশি রহ.-এর মন্তব্য নকল করে বলেন, হাফিজ জারকাশি রহ. বলেন, (খাবারের মান উন্নত করাসংক্রান্ত) এ হাদিসটি (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে) সুসাব্যস্ত নয়। এটা মুহাম্মাদ বিন মুনতাশির রহ.-এর বাণী মাত্র।’ (আল-আসরারুল মারফুআ : পৃ. নং ৩৬০, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)

এ হাদিসটির ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে আরও অনেক মন্তব্য রয়েছে। কলেবর দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সব এখানে উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি না। সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে যেটা সঠিক মনে হয়েছে, সেটা হলো, হাদিসটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী হিসেবে শক্তিশালী সূত্রে প্রমাণিত নয়; বরং সনদের বিবেচনায় অত্যাধিক দুর্বল বলেই সাব্যস্ত হয়। অবশ্য দুয়েকজন সাহাবি ও তাবিয়ি থেকে এর কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এ ব্যাপারে আমার মত হলো, এ নিয়ে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কেউ করতে চাইলে কিছু উলামায়ে কিরামের মতের দিকে তাকিয়ে করার অনুমতি দিলেও দেওয়া যেতে পারে। তবে যেহেতু এটা বিদআত হওয়ার কথাও অনেক উলামায়ে কিরাম লিখেছেন, তাই এ থেকে পারতপক্ষে বিরত থাকাই নিরাপদ ও শ্রেয়; বরং শরিয়তের মূলনীতি অনুসারে তখন বিরত থাকাটা আবশ্যক হয়ে যায়। কেননা, যখন কোনো আমল সুন্নাত বা বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে তখন উক্ত আমলকে পরিত্যাগ করাটা আবশ্যক।

ইমাম ইবনুল হুমাম রহ. বলেন, কোনো কাজ ওয়াজিব ও বিদআত হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলে সতর্কতামূলক তা পালন করবে। আর বিদআত ও সুন্নাত হওয়া নিয়ে কোনো কাজে সংশয় সৃষ্টি হলে তা পরিত্যাগ করবে। কেননা, বিদআত পরিত্যাগ করা আবশ্যক, কিন্তু সুন্নাত আদায় করা (সে পর্যায়ের) আবশ্যক নয়।’ (ফাতহুল কাদির : ১/৫২১, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
নির্ভরযোগ্য কোনো ইমামের মতেই আশুরা দিবসে পরিবারের খাবারের মান একটু উন্নত করা ফরজ বা ওয়াজিব নয়; এমনকি সুন্নাতও নয়; বরং কতিপয় উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে এটা জায়িজ বা সর্বোচ্চ মুসতাহাব একটি আমল। সুতরাং আমলটি অনেক উলামায়ে কিরামের দৃষ্টিতে বিদআত হওয়ার আশঙ্কায় আমাদের এমন আমল থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধে সূত্রে প্রমাণিত এতটুকুই হলো মুহাররম ও আশুরা দিবসের গুরুত্ব, ফজিলত ও আমল। এর অতিরিক্ত আমাদের সমাজে যেসব কিচ্ছা-কাহিনী ও রুসুম-রেওয়াজ আছে, তার অধিকাংশই জাল ও মিথ্যা কিংবা অনির্ভরযোগ্য ও দুর্বল বর্ণনা। চলবে