এ সমাজে পুরুষ ও নারী এখনও বন্ধু মনোভাবসম্পন্ন হয়ে ওঠেনি

মোরশেদ হাসান

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০১৯

আমি সন্ধ্যায় বাসায় এলে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনি বাসে চড়া ও সিটে বসা নিয়ে বিভিন্ন বিব্রতকর অভিজ্ঞতার কথা। বিব্রতকর অভিজ্ঞতাটি কেন এবং কার কাছ থেকে হয়? নিঃসন্দেহে পুরুষের কাছ থেকেই হয়। কখনও শুনি সে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে অন্য মেয়ের পাশে গিয়ে বসেছে। কখনও শুনি বলতে বাধ্য হয়েছে, আপনি ঠিকভাবে বসুন।

 

কখনও পাশের সিট খালি হতেই বাসে একটু দূরের মেয়েকে ডাক দিয়েছে, আপু, এখানে এসে বসুন। পাশে দাঁড়ানো পুরুষ সহযাত্রী উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, আপনি এত দূর থেকে একজনকে ডাকছেন কেন? আমি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকি। বেশিরভাগ সময় মন্তব্য করা ছাড়াই উঠে যাই। আমার পেশা অনুযায়ী চার চাকা কেন এখনও করতে পারিনি সেজন্য নিজের ওপরই এক ধরনের মিশ্র অনুভূতির জন্ম নেয়।

 

আমার অফিস সহকর্মী একজন তরুণী ডাক্তার। ডাক্তার মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, এ সমাজে এ ধরনের একটি ভুল বার্তা প্রচলিত আছে। আমি সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, বাসে চড়া নিয়ে তার অভিজ্ঞতা কী? আমি আমার নিজের বয়সের অভিজ্ঞতায় বিষয়টি জানি না, তা নয়। সহকর্মী চিকিৎসকের নাম ইশরাত। ইশরাত থাকেন সাভারে। সে বলল, ভাইয়া, খুবই করুণ অভিজ্ঞতা। শান্তিতে বাসে চড়ে যাতায়াত করা যায় না। এখন এমন একটা অবস্থা হয়েছে অপ্রীতিকর অবস্থা এড়ানোর জন্য আমি দুসিটের ভাড়া দিয়ে যাই। পাশের সিট খালি থাকে। জিজ্ঞেস করি, এতে বাসের অন্য যাত্রী যারা দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা কিছু বলেন না? - কী বলবে? সমস্যা তো কন্ডাকটরের। সে তো ভাড়া পেয়েই যাচ্ছে। আলাপের শুরুতেই একজন নারীকে সব প্রশ্ন করা যায় না, সেটা সমীচীনও নয়। কিন্তু আলাপ জমে উঠলে কথা প্রসঙ্গেই অনেক কথা এসে যায়।

-বুঝতেই পারছি ইশরাত, বাসে করে কোথাও যাওয়া নারীর জন্য সুখকর কোনও ব্যাপার নয়।

- সুখকর তো নয়-ই ভাইয়া, স্বস্তিকরও নয়।

- কিছু মনে করবেন না ইশরাত, কিছু কী বলা যায়, কী ধরনের বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় পুরুষদের কাছ থেকে।

-অনেক ধরনের। ধরেন পাশে যে পুরুষটি বসলেন, তিনি আস্তে আস্তে গায়ের দিকে সরে আসতে থাকেন। শরীরের সাথে শরীরের স্পর্শ ঘটিয়ে তিনি দারুণ এক বিকৃত মজা পান, এটিকে এক ধরনের বিজয় বা অধিকারও মনে করেন। হাতটি পায়ের ওপর না রেখে শরীরের সাথে পাশাপাশি রাখেন, যাতে ঘষা খাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না হয়। প্রতিবাদ করি। সেখানেও ঝামেলা লেগে যায়। সজোরে ও সরোষে আমাকেই শুনিয়ে দেয়, বাসে ওঠেন কেন? এত শুচিবায়ু কেন? প্রাইভেট কারে করে যান। ইশরাত বলে যায়। এ জন্য আমি এখন দুসিটের ভাড়া দিয়ে যাই। আরও আছে, ধরেন আমি জানালার পাশে বসেছি। এখন নামব। আমার পাশের পুরুষ সহযাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে নামার জায়গা করে দেন না। বসে থেকেই পা দুটো দাঁড়ানোর স্পেসের দিকে ঘুরিয়ে নেমে যাবার সুযোগ দেন। এতে করে সিট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটি মেয়ের খুবই অসুবিধা হয়। এসব ক্ষেত্রে পুরুষ যাত্রী উঠে দাঁড়ালেই একটি নারী সম্মানের সঙ্গে নামতে পারে। সাধারণ মানুষ হয়তো জানে না, কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে আমরা জানি মেয়েদের পেলভিক রিজন বড়ো হয়, সন্তানধারণসহ প্রকৃতিগত কারণেই। একজন পুরুষ আরেক পুরুষ সহযাত্রীকে পা ঘুরিয়ে স্পেস দিলে হয়তোবা হয়, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে হয় না। এছাড়া অনেক বিকৃত স্বভাবের পুরুষও আছে। মোট কথা ভাইয়া, নারীর জন্য বাসে চড়া মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।

-ইশরাত, এই যে পুরুষ যাত্রীদের কাছ থেকে বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন, কোন বয়সী পুরুষদের কাছ থেকে বেশি হচ্ছেন এমনকি বলা যাবে?

- সব বয়সী পুরুষই আছেন। তবে তরুণরা তুলনামূলকভাবে অনেক ভদ্র, সিভিলাইজড। সবচেয়ে খাটাশ হচ্ছে মিডল এইজ বয়সী পুরুষগুলো। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। সবাই নিজেকে যুবা ভাবতে পছন্দ করেন। কিন্তু মেঘে মেঘে বয়স তো কম হল না।

-মিডল এইজ বয়সী বললে আপনি কোন বয়সটিকে বলবেন? ইশরাত এক মুহূর্ত ভেবে বলল তেতাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন।

-এর বেশি বয়সী পুরুষ?

-তাঁরা তো বাসে খুব একটা ওঠেন না, ভাইয়া। বিষয়গুলো আগে থেকে জানা সত্ত্বেও একজন তরুণীর কাছ থেকে সরাসরি শোনার গুরুত্ব ও প্রভাব অনেক বেশি। এ সমাজে আমরা পুরুষরাও জানি, বাসে চড়া নারীর জন্য স্বস্তির কোনো বিষয় নয়। নিশ্চয়ই বাসে বিকৃত রুচির পুরষের সংখ্যার হারটি উল্লেখযোগ্য, কিন্তু সব পুরুষই বিকৃত রুচির নয়। অনেক পুরুষও হঠাৎ করে অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়ে পড়েন।

 

আমার এক ডাক্তার বন্ধুর কথা মনে পড়ল। এখন লম্বা দাঁড়ি, পাঞ্জাবিতে অবয়ব অনেক পালটে গেছে। কিন্তু স্বভাবে আগের মতোই প্রাণচঞ্চল ও হাসিখুশি। সে অনেক বছর আগে একদিন বাসে এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে গেল। বাসের এক মহিলা অভিযোগ করল, সে টাচ করেছে ভদ্রমহিলাকে। বন্ধুর কথা, আমি ভীষণ অবাক হয়েছি এ অভিযোগ শুনে৷ আমার শিক্ষা-দীক্ষা, ফ্যামিলি কালচার, পেশা সব মিলিয়ে কতটা মর্মান্তিক হতে পারে এ অভিযোগ বুঝতেই পারো। এসব ক্ষেত্রে বাসের অন্য সবাই পক্ষ নেয় নারীর দিকে। আমরা ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করি, তুই কি আসলেই করছিস এই কাজ?

-তোদের কি মাথা খারাপ? কিন্তু বাসের সব যাত্রী মহিলাটির দিকে চলে যাচ্ছে, আমি দ্রুত পরিস্থিতি কন্ট্রোল করলাম। স্পষ্টভাবে বললাম, আমার মতো সুন্দর ছেলে আপনার মতো মহিলাকে অনর্থক স্পর্শ করবে এটা কেউ বিশ্বাস করবে? সে বন্ধুটির চেহারা বলিউডের আমির খানের চেয়েও সুন্দর।

 

আমি নিজেই এই সেদিন বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে গেলাম। বাসে মাত্র উঠেছি। পিঠে হ্যাভারস্যাক ব্যাগ ঝোলানো। বাসে পা রাখার জায়গা নেই। এক দাঁড়ানো পুরুষ যাত্রী আমাকে বললেন, পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে হাতে নিতে। নিলাম। কিন্তু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা নেই। ব্যাগটিতে বই থাকার দরুণ বেশ ভারীও। আমি একটি সিটের উর্ধ্বপ্রান্তে ব্যাগটি একটু ঠেকান দিয়ে কষ্টকরভাবে নিজের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছি। এরমধ্যে এক মহিলা ঝাঁ করে উঠলেন, সরে দাঁড়ান ওদিকে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকেও এই কথা শুনতে হল। মেজাজ খুব তিরিক্ষি হল। বন্ধুর সেই ডায়ালগের কথা মনে পড়ল। হতভম্ব অবস্থায় আরেক পুরুষযাত্রীর সাথে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম; ভুলেও যেন দ্বিতীয়বার এই কথা শুনতে না হয়। এক হাতে ব্যাগ, ওদিকে দুপা বাসের ফ্লোরে রাখা, আবার কেউ যখন বাস থেকে নামবে তখন দাঁড়ানোর সরু প্যাসেজে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তার নাম ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।

 

আসল কাহিনি কী? এটাই পরিষ্কার যে, এ সমাজে পুরুষ ও নারী বন্ধু মনোভাবসম্পন্ন এখনও হয়ে ওঠেনি। বাসে নিঃসন্দেহে নারীরা অসহ্য ও বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। আবার কিছু পুরুষও না বুঝেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছেন। এ সমস্যার সমাধান কোথায়? আমাদের দেশের নগরগুলোতে বাসের ভেতরের সুযোগ-সুবিধা কী? খুবই খারাপ অবস্থা। সিটগুলো সংকীর্ণ ও ঠাসাঠাসি করে ফিট করা। অনেকসময় দুপা সামনে রেখে বসা যায় না। পা ও হাঁটু রাখার জন্য যতটুকু স্পেস দরকার তা নেই, সিটে থাকা একজনের শরীরের বেশিরভাগ অংশ থাকে সিটের বাইরে। পাশাপাশি দুটো সিটের মাঝে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে কতটুকু স্পেস থাকে? বাস থেকে মানুষ যখন ওঠে বা নামে তখন সাপের মতো এঁকেবেঁকে নামতে হয়।

 

নারীর জন্য সম্মানজনক অবস্থা মোটেই নেই নগরীর বাস ভ্রমণে। বিকৃত পুরুষ তো আছেই, বাসগুলোও মোটেই যাত্রীবান্ধব বাস নয়। আমরা বিদেশের বাসের দিকে তাকাই। যাঁরা ইউরোপ, আমেরিকায় থাকেন, তাঁরা জানেন সেখানকার বাস ভ্রমণ কতটা প্রীতিকর ও আরামদায়ক। এই সেদিন ব্যাঙ্গালোর থেকে ঘুরে এলাম। সেখানে বাস সার্ভিস দেখেও বুঝতে পারলাম, নগরের বাস সার্ভিসের সুযোগ-সুবিধার দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের। বাসের ভেতরে বসার ও দাঁড়ানোর প্রশস্ত স্পেস আছে। নারীদের জন্য সামনের দিকে প্রায় অর্ধেক সিট বরাদ্দ আছে। প্রতিবন্ধীদের খুব যত্ন করে বাসে ওঠানো ও নামানো হয়। যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো ও নামানো হয় না। যাঁরা কলকাতা ভ্রমণে যান তাঁরাও জানেন, কলকাতার বাস সার্ভিস খারাপ অবস্থানে নেই। নারী ও পুরুষ মিলেই মানব সমাজ। বিশ্বের অল্প যে কয়েকটি দেশে গিয়েছি, দেখেছি নারীর দিকে হা করে পুরুষরা তাকিয়ে থাকে না। মালদ্বীপ আমাদের পাশের সার্ক কান্ট্রি, ট্যুরিস্ট কান্ট্রি। সারা বিশ্ব থেকে ট্যুরিস্টরা আসছেন। কত রং বেরঙের মানুষ। সর্টস ও গেঞ্জি পরা ইউরোপীয় নারী। সেখানকার পুরুষদের হা করে তাকিয়ে থাকতে আমি দুবছরে কখনোই দেখিনি। আমাদের এখানে বাসে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিকৃত পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি, যেকোনো পরিসংখ্যানেই এটা প্রকাশ পাবে।