একজন লেখকের যাত্রাপথের বিশদ বিবরণ

তাসলিহা মওলা দিশা

প্রকাশিত : মার্চ ৩০, ২০২২

মানবজীবন এক অনতিদীর্ঘ ভ্রমণ। প্রতিটি মানবসন্তানের জন্ম থেকে ভ্রমণ শুরু হয়। সেই ভ্রমণের যবনিকাপাত হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। প্রতিটা মানুষের জীবন স্বতন্ত্র, স্বতন্ত্র তাদের জীবন-ভ্রমণও। একজন লেখকের যাত্রাপথ তবে কেমন? নিজের হেঁটেচলা সেই পথেরই বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন স্বকৃত নোমান তার ‘উপন্যাসের পথে’ বইটিতে। একজন পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি আখ্যান। গবেষণার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির কাছে বইটি গবেষণাধর্মীও বটে। যার মূল লক্ষ্য হলো, একজন লেখক কীভাবে এগিয়ে যাবেন তার আরাধ্য পথে, তার বিশদ আলোচনা; আমরা যাকে বলে থাকি explanetory research। আবার মজা করে আমি লেখককে একদিন বলেছিলাম ‘গাইড বই’।

বস্তুত ‘উপন্যাসের পথে’ বইটিতে উঠে এসেছে স্বকৃত নোমানের লেখক হয়ে ওঠার গল্প, যা তিনি বলে চলেছেন একজন কল্পিত চরিত্রকে। চরিত্রটি পুরুষ চরিত্র। চরিত্রের লিঙ্গ নির্ধারণ কেন করলাম, তা শেষে বলছি। রচনাটি বিশদ, তবু এর পাঠ অত্যন্ত আনন্দদায়ক। লেখক এখানে বলে চলেছেন গল্প। নানান ধরনের গল্প, নানান আঙ্গিকের গল্প। সেসব গল্পে আছে কত নাম না-জানা সাহিত্যের কথা, সাহিত্যিকের প্রেমের কথা, যৌনতার কথা, লেখকের অভিজ্ঞতার কথা। কল্পিত এক ‘তুমি’কে বলে চলা গল্পের ছলেই এগিয়ে গেছে এই আখ্যান।

যারা সাহিত্যের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, তারা সেসব সাহিত্যকর্ম ও সাহিত্যিকদের দেখা পেয়ে যাবেন ‘উপন্যাসের পথে’ বইটিতে। সেই হোমারের অডিসি, দান্তের ডিভাইন কমেডিয়া, ফেরদৌসির শাহনামা, তলস্তয়, ভিক্টর হুগো প্রমুখের কাল, সব রচনার পরিচিতিপর্বটি সেরে নিতে পারবেন এ বইতে। উপন্যাস প্রসঙ্গে কত কত চেনা-অচেনা মনীষী আর তাদের অমূল্য বাণী উদ্ধৃত আছে, বইটি না পড়লে হয়ত অজানাই থেকে যেত সব।

‘উপন্যাসের পথে’ যেমন একজন লেখনেচ্ছুক মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বই, তেমনি একজন অনুসদ্ধিৎসু অগ্রসর পাঠকের জন্য সাহিত্যের উন্মুক্ত দুয়ার আরও বেশি উন্মীলনের এক মাধ্যম। কিছু অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকা আছে বইটিতে, যা সহজেই একটা রেফারেন্স হিসেবে কাজে দেবে। লেখকের নিজ জীবনের চড়াই-উতরাইয়ের কিঞ্চিত বর্ণনাও আছে, যা তরুণ লেখকদের সাহস যোগাবে এই মন্ত্রে, ‘তুমি যা হতে চাও তাই হতে পারবে, যদি তোমার স্থির লক্ষ্য ও অদম্য চেষ্টা থাকে’।

স্বকৃত নোমানের ‘উপন্যাসের পথে’ একাধারে একটি complete guideline, সাহিত্যরসের আধার, সর্বোপরি একজন ঔপন্যাসিকের জীবনের কিছু অধ্যায়ের গল্প। বইটি পড়তে পড়তে আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছে যে, গুরু তার শিষ্যকে চিনতে ভুল করেননি। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন সঠিক রত্নটিকেই চিনে নিয়েছিলেন। গুরুপত্নী পরবর্তীকালে অনেক অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, স্বকৃতকে ধসিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। তিনি অভিযোগ করেছেন স্বকৃত চুরি করেছেন তার গুরুর লেখা। গুরুর লেখা চুরি করলে স্বকৃত নোমানের হাত দিয়ে ‘রাজনটী’ বা ‘উজানবাঁশি’র মতো উপন্যাস লেখা সম্ভব হতো না। চুরি করে বহু কিছুই হয় জগতে, কিন্তু শিল্পসৃষ্টি হয় না।

‘উপন্যাসের পথে’ সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই। উপন্যাস লিখুন চাই না লিখুন, সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য এ বই পড়া যেতে পারে। বইটি প্রকাশ করেছে পাঠক সমাবেশ।

একুশে বইমেলা ২০১৮