এলিজা খাতুনের গল্প ‘রক্তসমুদ্র’

প্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২৩

সময় মেপে বলা যাবে না ঠিক কতক্ষণ ধরে ভেসে চলেছি। ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানের স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিনারের দিকে সরে যাচ্ছি। নদীর বাঁকের ওপরই ব্রীজ। ব্রীজের নিচেই স্তম্ভের চারপাশে অল্প জলে জমে থাকা কচুরিপানায় আটকে পড়ছি ক্রমশ।

 

নদীর পাড় থেকে ব্রীজে ওঠার মুখে কোণের চা-বিস্কুটের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। দোকানে ঝুলন্ত হারিকেনের আলোয় কচুরিপানার পাতাগুলো চকচক করলেও নিজের শরীর দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু টের পাচ্ছি, আমার আশপাশে আরও অনেকেই আছে। কেউ ভেসে আসছে, ভেসে যাচ্ছে। কেউ কেউ আমারই মতো আটকে থাকছে স্বল্পজলে শ্যাওলার সাথে মিলেমিশে।

 

উপুড় হয়ে আছি বলেই ছোট ছোট মাছেরা আমার সমস্ত মুখ আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে। ওদের কাছে বোধহয় এখনও খাদ্যে পরিণত হইনি। জীবন্ত মনে করছে আমার শরীরটাকে। মানুষের রক্তের টাটকা গন্ধ অক্ষুণ্ণ আছে মনে হচ্ছে এখনো। চরের মতো জেগে থাকা তামাটে পিঠে দু`একটা ব্যাঙ লাফিয়ে উঠছে, বুঝতে পারছি। দু`চারটে শামুক গুটি গুটি পদক্ষেপে ডাঙার স্বাদ পেতে উঠে আসছে। জেগে থাকা পিঠকে বেলেমাটির নতুন চর ভেবেছে অবলীলায়।

 

হঠাৎ ছ্যাৎ করে দগ্ধ তরল ওপর থেকে এসে পড়ে আমার পিঠে। বুঝতে পারি, ব্রীজের ওপরে কোণার দোকানে খাকি পোশাকের লোকগুলো এসেছে। চা দোকানি ঠিক এ সময় কাঁপতে থাকে আর কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ, ডিশ ধোয়া গরম জল ছুঁড়ে ফ্যালে; উত্তপ্ত জল বিদগ্ধ রাতের অন্ধকারকে পোড়াতে পোড়াতে নেমে এসে আমার পিঠের ছামড়া ঝলসে দেয়। মনে হয়, মধ্য রাত পার হতে চলেছে। গতকাল ভোরেই তো ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম, যদিও হাত বাঁধা ছিল পেছনে। আরও অনেকেরই হাত বাঁধা ছিল; আমরা যারা গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ার প্রস্তুতিসহ অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম সারিবদ্ধভাবে।

 

আমাদের দলে ছিল ফরিদা। আমি ছাড়া বাকি ছেলেরা ওকে ফরিদ হিসেবে জানতো। ওর বুকের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকায় পরিচয়টা সামলে নিতে পেরেছিল। চাচা-চাচির বাড়িতে আশ্রয় ছিল ফরিদার। মা-বাবা দুজনেই পরপারে। ফরিদার চাচা আজম মোল্লা যেদিন দুজন পাক-আর্মিকে উঠোনে বসিয়ে নারকেলের নাড়ু খাইয়েছিল, সেদিন রাতেই ফরিদা তার হাতে তৈরি নাড়ুগুলো কাপড়ে বেঁধে নিয়ে চাচার পাজামা-পাঞ্জাবি আর টুপি পরে বেরিয়ে এসেছিল ওই বাড়ি থেকে।

 

শৈশবে আমার খেলাধুলার দিন কেটেছে ফরিদার সাথে। আবছা অন্ধকার পথে খপ করে ফরিদা আমার হাত ধরতেই ওর হাতকে আচমকা ভেবেছিলাম রাজাকারের হাত। টুপি খুলে ঘন কালো চুলের অস্তিত্বে জানান দেয়, ও পারবে আমাদের দলে থেকে কাজ করতে।

 

ক্ষুধার্ত আমরা দুটো করে নাড়ু খেয়ে নদীর জল পান করে ঝোপঝাড়ে কাটালাম বাকি রাত। আশপাশের পুড়ে যাওয়া ভিটের গন্ধে ঘুমের বদলে আমাদের চোখ, আর অন্তরের জ্বালা বেড়ে চলে। আমাদের অস্ত্র-সামগ্রী আরও দু’দিন পরে আসার কথা।

 

ফরিদা এখন আমাদের মধ্যে ফরিদ। অস্ত্র প্রশিক্ষণ না থাকলেও ওর বুদ্ধিটা অস্ত্রের মতো কাজ করে। পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় নিজেকে শান্তি কমিটির সদস্য পরিচয় দিয়ে পাকা রাস্তা থেকে একবার দুজন খাকি পোশাক পরা পাকিস্থানিকে নিয়ে এসেছিল আমাদের আস্তানায়। মুক্তি বাহিনীকে ধরিয়ে দেবে এই আশ্বাস দিয়ে। অস্ত্রবিহীন আমরা বৃত্তাকারে ওই দুজনকে আচমকা ঘিরে ঘাড় মটকাবো, ওদের ধারণার বাইরে ছিল। জরুরি তথ্য সংগ্রহে শহরের একটা বড় হোটেলে পাকিস্তানিদের এক উল্লাস-পার্টিতে যাবার জন্য আমাদের দরকার ছিল দুটো খাকি পোশাক আর দুটো রাইফেল।

 

পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক ছিল, যদি ফরিদ আমাদের সাথে না থাকতো। পাঞ্জাবি-টুপির মুখোশের অন্তরাল থেকে ফরিদার মুখ চিনতে অসুবিধা হয়নি ফরিদার চাচা আজম মোল্লার। আমাদের তিনজনকেই জিপে করে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ওখানে থেকে গেছে আমাদের আরেকজন। ধরা যখন পড়েনি, ধরে নিচ্ছি ঠিক সময়মতো কাজে সফল হবে ওর বোমা বেঁধে নেওয়া শরীরটা। এখন আমরা এক একটা শরীর মানে এক একটা অস্ত্র।

 

এক পর্যায়ে সৈন্যদের অন্যমনস্কতায় আমি লাফিয়ে পড়ি। ঝোঁপের কাছে সেঁটে থাকি কিছুক্ষণ। জিপ থামিয়ে দুজন সৈন্য পিছু নেয়। ছুটতে ছুটতে ময়দানের শেষ কোণে গিয়ে ডুমুর-খোকসার মাঝারি ঝোঁপে মূর্তির মতো অনড় থাকি কিছুক্ষণ।

 

আমার এমন ছোটা এই প্রথম নয়। বহু যুগ যুগ ধরে ছুটছি আমি। এতদিন যারা আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, খুঁজে বেড়িয়েছে, তারা আমাকে, আমার পূর্বপুরুষকে আগেই মেরেছে। মেরে আসছে। বহুবার বহুভাবে। আমি জানি, ওরা কারা। আমি দেখেছি, অত্যাচার-অবিচার শতাব্দী ধরে। আপনারা দেখতে পান না!

 

মনে হচ্ছে, বাতাসের শা শা শব্দের ভেতরে কেউ ক্রুদ্ধ নিঃশ্বাস ফেলে বলছে, ‘তুম কাঁহা হো?’ রাইফেল তাক করে গুলি চালাতে থাকি, কয়েকবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার পর ওদের এক সৈন্যের বাহু ভেদ করে যায়।

 

মৃত্যুর গভীর থেকে গুমরে গুমরে উঠছে একটা ভাষা; যেন কৈফিয়ত তলব করছে, কতকাল? আর কতকাল এভাবে দৌড়াবো? আমি দৌড়াচ্ছি দীর্ঘ মাঠের বড় বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে। কুয়াশা ছিঁড়ে একটা গুলি এসে আমার অনন্ত দিনের ক্ষুধা জর্জরিত উদরের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। কিছুটা ক্ষতে আমি কুঁকড়ে যাই। ততক্ষণে একজন আমার রাইফেলটা কব্জা করে নেয়। ওরা আরও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। আবার আমাকে টেনে তোলা হলো জিপে।

 

ব্রীজে আরো অনেককেই আনা হলো বিভিন্ন গ্রাম থেকে। এক মায়ের কোলে ছোট্ট শিশু ছিল। পাকিস্তানি আর্মি মায়ের কোল থেকে বাচ্চা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে দেয় নদীর মাঝখানে। ব্রীজ থেকে মায়ের লাফিয়ে পড়তে চাওয়া আকুতি আমাদের হাত বাঁধা প্রত্যেকের বুকের গভীরে রক্তের নদী বইয়ে দিয়েছিল। মধ্যবয়সী মাকে হায়েনারা পাঁজাকোলা করে তুলে জিপের ভেতর ছুঁড়ে দেয় পেঁয়াজ-রসুনের বস্তার মতো। সেই সাথে ফরিদের পাজামা-পাঞ্জাবি টেনে ছিঁড়ে তার ভেতর থেকে আলগা করে দেয় শর্ট কামিজ পরা ফরিদাকে।

 

ফরিদার ঘন কালো দীর্ঘ চুলগুলো ঘাস কাটার মতো মুঠো করে ধরে গোড়া থেকে কেটে দেওয়া হয়। ওকেও জিপের ভেতরে টেনে তোলা হয়। সে সময় আমার গায়ের রং কেমন আগুনের মতো লাল হয়ে উঠেছিল, আগে কখনো দেখিনি এমন। প্রথমেই আমার আঙুল কেটে দেয়। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার সমস্ত শরীর উত্তপ্ত লোহা হয়ে উঠেছিল।

 

আমাদের সারিতে একটা কিশোর ছিল। একজন সৈন্য আজম মোল্লাকে নির্দেশ দিতেই আজম মোল্লা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছুরি বের করে। এক পোঁচে কিশোর ছেলেটার কান বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রক্ত গড়িয়ে নামে ওর ঘাড় বেয়ে। ওর প্রচণ্ড চিৎকারে আকাশে জমাট মেঘ ফেটে দু’এক ফোটা জল নেমেছিলো। ওর অপরাধ, কানে রেডিও চেপে ধরে মুক্তির গান শুনছিল ওই চায়ের দোকানে। এক ভয়ানক-বীভৎস মঞ্চ হয়ে ওঠে ব্রীজটা।

 

আমাদের সকলের হাতপা বাঁধা। অন্তিম আঘাতের আগে অনবরত ওদের বেয়নেটের খোঁচায় আমরা রক্তাক্ত হতে থাকি। সর্বশেষ জ্ঞান থাকার মুহূর্তটা অস্পষ্ট হয়ে যায়নি এখনও। ঠা ঠা শব্দে গুলি এসে প্রথমে দুহাতে কুনুই ঝাঁঝরা করে। দুটো হাত কামারশালার গনগনে কাস্তের মতো লাল ও দগ্ধ হয়ে ওঠে। এরপর দুচোখ থেকে অন্ধকার ছুটছে যেন, আরও অবিরাম ঠা ঠা শব্দ কানে বাজতে লাগে।

 

পায়ের তলা থেকে মাটির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হয়তো আমি শূন্যে ভাসছি অথবা নদীর অতল গহ্বর আমাকে টেনে নিচ্ছে তার দিকে। অগ্নিশলাকা-বিদ্ধ সমস্ত শরীর জলের মধ্যে পড়ে একবার ডুবে যায়, আবার ভেসে ওঠে। আবার ডুবে যায়, আবার ভেসে ওঠে। এভাবে ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে কেবল ভেসে চলছিলাম। এখন এই কচুরিপানার সাথে মিলেমিশে আমরা ঠিক কতজন আছি গণনা করে শেষ করা যাবে না।

 

একটু পর আবারও পিঠে এসে পড়ে গরম চা`পাতা। পাশ কেটে চলে গেল কার্গো-লঞ্চ। ঢেউয়ের দোলায় টলে ওঠে কিনারের স্থির কচুরিপানার দল। ব্রীজের উপরে কোণের দোকানটা এতক্ষনে নিশ্চুপ। খাকি পোশাকের লোকগুলো চলে গেছে। দোকানের আলো নিভে গেছে। চারদিক শুনশান। শেষরাত হবে হয়তো। ওপার থেকে নারী কণ্ঠের চিৎকার ভেসে আসছে।

 

ওপারে স্কুলের বিল্ডিংয়ে হানাদার ক্যাম্প। হঠাৎ দুম দুম শব্দ হয় কয়েকটি। নারী কণ্ঠের চিৎকার থেমে গেছে। ওপারের সুলেখার কথা মনে পড়লো। যখন নদী পার হয়ে ওপারের ঘাটে নেমে হাটে যেতাম, ঘাটের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সুলেখাকে। সুলেখা কেমন আছে? কোথায় আছে এখন?

 

অথচ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, নদীর ওপারে নাকি এপারে, আদতে কোন্ পারের কাছাকাছি জলে ভাসছি! টের পাচ্ছি, কিছু-একটা ভীষণ রকম পেঁচিয়ে ধরেছে আমার একটা হাত। সাপ হবে বোধহয়!

 

লঞ্চ দূরে চলে গেছে। স্রোতের গতিবৃদ্ধিতে এরই মধ্যে আরো কয়েকটি শরীরসহ আমি ভাসতে শুরু করেছি ধীরে ধীরে। কিছুদূর গিয়ে জেলেদের জাল পেতে রাখা জাংলায় আবার আটকে গেলাম। কঞ্চি-কাঁটায় বিদ্ধ হলো পাঁজরটা। জল প্রবাহের কলকল শব্দ। বুঝতে অসুবিধা হলো না, কাঁটার খোঁচার পাশাপাশি চুড়ি পরা একটা হাতও আমার পাঁজরে এসে ঠেকেছে। আমার পাঁজরাকাঠি থেকে মাংস খসে যাবার উপক্রম।

 

অন্যপাশে উপুড় হয়ে মোটা দুটো কঞ্চির ফাঁকে বেধে আছে একটা ফর্সা ফ্যাকাসে দেহ। কোমরে তার ধুতির গিঁট বহাল তবিয়তে থাকলেও দেহের নিম্নাংশ উন্মুক্ত। মনে পড়লো, হাত বাঁধা অবস্থায় সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবার সময়ে আমার একপাশেই ছিল লোকটা, সেই হবে নিশ্চিত। হানাদারদের পৈশাচিক উল্লাসে লোকটির ধুতি ছিঁড়ে তাকে জোরপূর্বক খৎনা দেবার চিহ্ন বিদ্যমান। তার আরও কয়েকজনের পরে যে আটপোড়ে কাপড় পরিহিত মেয়েটি ছিল, তার মুখ আমি দেখিনি। সমস্ত মুখে রং লেগেছিল ছোপ ছোপ। এক সৈন্যর উচ্চারণে শোনা গেছে, কুমার কা বেটি।

 

সম্ভবত পোড়া মাটির বাসনপত্রে রঙের প্রলেপে নকশা আঁকছিল। মেয়েটির শাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলার মুহূর্তে কেবল আমার চোখ দুটোই নয়, দণ্ডায়য়মান প্রত্যেক মানুষের চোখ ঠিকরে আগুন ঝলকে বের হচ্ছিল। গালি আর থুতু ছিটিয়েছি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে। ঠিক তখনই চূড়ান্তরূপে গুলি বর্ষণ চলল আমার বুকে। সেই সাথে সবার ওপর।

 

ক্রমশ আরও আরও শরীর যুক্ত হতে থাকে স্রোতের ভাঁজে ভাঁজে। আমাদের ভেসে চলা দেহগুলো ভাসতে ভাসতে একের সাথে আরেকটি সংযুক্ত হয়ে চলেছে। চারপাশে অথৈ জল। রক্ত ধুয়ে নেমে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে জলে। রক্তশূন্য নির্জীব ফ্যাকাশে দেহ জল কাদার মাখামাখিতে মাটির মতো রং ধারণ করছে ক্রমশ। অগণিত মেটেরং দেহগুলো যুথবদ্ধ হতে হতে চরের আকার ধারণ করে।

 

চারপাশের জলের পরিধি ঠিক অনুমান করা যাচ্ছে না। এখনো নদীর দুধারে কিছুটা অন্ধকার। কিন্তু আমি নিশ্চিত নদীর জল লাল হয়ে উঠেছে। ঘন লাল! আমাদের বুকের রক্তসমুদ্রে ডুবে ডুবে নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছে নদীটা। শুধু নদী কেন! রক্তস্নানে গোটা মানচিত্র থেকে ধুয়ে যাবে হায়েনার বিষাক্ত দাগ, আমরা এই বিশ্বাসে ভেসে চলেছি যুথবদ্ধ।