
এহসান হাবীবের গদ্য ‘অদ্ভূত মেয়েদের প্রতি’
প্রকাশিত : অক্টোবর ২৯, ২০২২
তখন আমার বয়োঃসন্ধি শুরু হয়েছে কী হয়নি। আমি একা নান্দাাইল স্টেশন থেকে ময়মনসিংহগামী ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠেছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়ে গেছে। রেল লাইনের পাশের গাছগুলো তাদের ছায়া দীর্ঘ করতে শুরু করেছে। শীত আসি আসি করছে। হেমন্ত পার হয়ে যাচ্ছে। এরকম এক সময়েই আমি ফিরছিলাম আব্বার কাছ থেকে। আব্বা তখন তাড়াইল চাকরি করেন। আম্মা মাঝে মাঝে আমাকে পাঠাতেন আব্বার কাছে। আমি নান্দাইল স্টেশনে উঠি, গৌরিপুর জংশনে নেমে যাব। তখন ট্রেনগুলোতে লম্বা লম্বা মুখোমুখি সিট ছিল। এখনো বোধহয় কোনো কোনো ট্রেনে এরকম সিটের ব্যবস্থা রয়ে গেছে। চারজনের সিটে অনায়াসে পাঁচ-ছয়জন বসা যায়।
আমি একটা কামরায় উঠে সিট পেয়ে যাই। বসি। ট্রেন ছাড়লে আমার বিপরীতে বসা দুই যাত্রীর পরিচয়পর্ব মূলক কথাবার্তায় আমি সামনে তাকাই। একদম ঠিক বিপরীতেই একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বসা। তারা নিজেরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে। আজকে যদ্দূর মনে পড়ছে, তারা দুজনেই বোধহয় আলাদা আলাদা কোনো ফ্যাক্টরি বা গার্মেন্টসের ওয়ার্কার ছিল। খটকা লাগছে, তখন কি এরকমভাবে গার্মেন্টস ছিল? ছিল বোধহয়। না থাকলেও ওরকমই কোনো কারখানার ওয়ার্কার ছিল তারা। বয়সে আমার চেয়ে বড় হবে নিশ্চয়ই। আমি তাদের দিকে তাকালাম, মেয়েটা আমার চেয়ে বছর আটেক বড় হবে। ছেলেটা তারো চেয়ে বেশি। ছেলেতে মেয়েতে প্রেম ভালোবাসার বিষয়গুলো তখনো আমাদের কাছে এতটা ক্লিয়ার ছিল না। আমরা বলতাম, লাইন করা। অমুকে সঙ্গে তমুকের লাইন আছে। মানে প্রেম আছে। আর এই বিষয়টা খুবই ভয়ংকর এবং অশ্লীল ছিল আমাদের মতো বয়সের ছেলে ছোকরাদের কাছে। অতটা বোঝার বয়স আমার ছিল না অথবা এই বিষয়গুলো আমি একটু দেরি করে বুঝতে শিখেছি।
নারী-পুরুষের বায়োলজিক্যাল বিষয়গুলো খুবই অস্পস্ট, রহস্য ঘেরা ছিল আমার কাছে। যৌনতা, সেও খুব অশ্লীল ছিল আমাদের কাছে। আমাদের বেড়ে ওঠাটা এরকমই ছিল। যৌনতা মানেই ভয়াবহ বিষয়। এলাউ করার মতো না। এছাড়া এ বিষয়টা তখনো আমার বুঝার বাইরে। মেয়েদের সম্পর্কেও তখনো আমার সচেতনতা তৈরি হয়নি। তবু আমি তাদের খেয়াল করছিলাম। চলন্ত ট্রেনে কোনো কাজ তো আর ছিল না। মেয়েটা সম্ভবত ঈশ্বরগঞ্জ কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে যাবে আর ছেলেটা সোহাগী বাড়ি। ছেলেটা মেয়েটাকে আপ্যায়ন করাচ্ছে। ঝালমুড়ি, বুট এসব কিনে দিচ্ছে। দুজনেই খাচ্ছে। কথাবার্তা বলছে। হাসি ঠাট্টাও করছে। হঠাৎ খেয়াল করি তাদের কথা অনুচ্চ স্বরে নেমে এসেছে। ছেলেটা মেয়েটাকে সোহাগী নেমে যেতে বলছে। বলছে, রাতটা তাদের বাড়িতে থেকে সকালে ঈশ্বরগঞ্জ যেতে। দেখলাম, মেয়েটা নিমরাজি। ছেলেটা মেয়েটাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ আমার ভেতরে কী যেন হলো। আমার মনে হচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে না। মেয়েটা হয তো রাজি হয়ে যাবে আর মেয়েটা রাতে খুব বিপদে পড়বে। হয়তো তার খুব মূল্যবান কিছু সে হারিয়ে ফেলবে। আমি তখন কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, মেয়েটা যেন রাজি না হয়। যেন সে তার সাথে না যায়। আমি খুব খেয়াল করছি, তারা কী করছে?
কী ডিসিশান নিতে যাচ্ছে? আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা নেমে যাবে। আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়ছি। কী করে মেয়েটাকে আটকানো যায়? আমি খেয়াল করছি, ছেলেটা কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে। মেয়েটাও কথা বলতে বলতে আমাকে লক্ষ্য করছে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করছি। সে ছেলেটার সঙ্গে প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মেয়েটা আর আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে বোধহয় নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এক পর্যায়ে আমি আমার পা দিয়ে মেয়েটার পায়ে টাচ করি। মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। আমি ইশারায় তাকে অনুনয় করি যেন সে ছেলেটার সাথে না যায়। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল একটু। তারপর অনেকক্ষণ তাদের দুজনের মধ্যে আর কোনো কথা হয় নাই। আমিও চুপ করে জানালার কাছে মুখ নিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। ট্রেন আঠারোবাড়ি পার হয়ে সোহাগী থামলো। ছেলেটা নামার প্রস্তুতি নিয়ে মেয়েটার হাত ধরে টানলো। যাবেন না? প্রশ্ন করলো। মেয়েটা একটু আমার দিকে তাকালো। তারপর চুপচাপ ছেলেটার সাথে সোহাগী স্টেশনে নেমে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। কী এক অজানা অভিমান জমা হলো মেয়েটার প্রতি! মেয়েটা হয়তো এই অভিমানের কোনো খোঁজই পাবে না। কিন্তু আমার এখনো নতুন কোনো স্টেশনে গেলে, ট্রেনে চড়লে আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, শ্যামলা, ছিপছিপে, কমলা রঙেরা কমিজ পড়া আমার চেয়ে বছর আটেক বড় একটা মেয়ে আমার বিপরীত সিটে বসে আছে। যে প্রথম একটা অবুঝ বালকের হৃদয়ের প্রার্থনাকে খানখান করে দিয়ে অন্য একটা অচেনা যুবকের হাত ধরে চলে গিয়েছিল। অচেনা স্টেশনে সন্ধ্যা ঘনায়ে এলে এরকম অদ্ভূত মেয়েরা পৃথিবীতে নেমে আসে।
লেখক: কবি