ওয়াসিম আকরামের প্রবন্ধ ‘ইসলামি গানে ফররুখ আহমদ’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০২০

ফররুখ আহমদকে বলা হয় ইসলামি রেনেসাঁর কবি। কবিতা ও গানে তিনি বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের আকুতি প্রকাশ করেছেন। তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন ও বাকপ্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। আধুনিকতার সব রকম লক্ষণ তার কবিতায় দেখা যায়। তার কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতাও লক্ষণীয়।

মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে ১৯১৮ সালের ১০ জুন ফররুখ আহমদের জন্ম। বাবা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ফররুখের মায়ের নাম রওশন আখতার। খুলনা জিলা স্কুল থেকে ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে ফররুখ আইএ পাস করেন। এরপর স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন।

সে সময়েই তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। তবে চল্লিশ দশকে তার রাজনৈতিক বিশ্বাসে পরিবর্তন আসে। তিনি ভারত বিভাগ তথা পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেন। ১৯৪২ সালের নভেম্বর মাসে খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুনের সঙ্গে ফররুখ আহমদের বিয়ে হয়। বিয়ে উপলক্ষে তিনি ‘উপহার’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন, যা ‘সওগাত’ পত্রিকায় অগ্রহায়ণ ১৩৪৯ সংখ্যায় ছাপা হয়।

ফররুখ আহমদের ছেলেমেয়ে ১১ জন। তারা হলেন: সৈয়দা শামারুখ বানু, সৈয়দা লালারুখ বানু, সৈয়দ আবদুল্লাহ মাহমুদ, সৈয়দ আবদুল্লাহেল মাসুদ, সৈয়দ মনজুরে এলাহি, সৈয়দা ইয়াসমিন বানু, সৈয়দ মুহম্মদ আখতারুজ্জামান, সৈয়দ মুহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামান, সৈয়দ মুখলিসুর রহমান, সৈয়দ খলিলুর রহমান ও সৈয়দ মুহম্মদ আবদুহু।

ফররুখ আহমদের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৪৩ সালে আইজিপ্রিজন অফিসে, ১৯৪৪ সালে সিভিল সাপ্লাইতে এবং ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকরি করেন তিনি। ১৯৪৫ সালে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদী’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তবে শেষপর্যন্ত স্থায়ীভাবে চাকরি করেন ঢাকা বেতারে। দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে ফররুখ আহমদ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এখানেই প্রথমে অনিয়মিত হিসেবে এবং পরে নিয়মিত স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

ফররুখ আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায় ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর, সন্ধেবেলায়। ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বহুমাত্রিকতা সুবিদিত। কবিতা, কাব্য-নাটক, অনুবাদ কবিতা, ছড়া, কিশোর-কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি বিপুলসংখ্যক গানও লিখেছেন। তার রচনাবলির বৃহদাংশ এখনও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলা একাডেমি থেকে দুই খণ্ডে রচনাবলি প্রকাশের পর অজ্ঞাত কারণে অপর খণ্ডগুলো এখনও অগ্রন্থিত অবস্থায় পড়ে আছে।

এ কারণে তার সকল গানও আমাদের সামনে আসেনি। এখনও তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। তবে আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত ‘ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’র (প্রকাশক: ফররুখ স্মৃতি তহবিল, চট্টগ্রাম; প্রকাশকাল ১০ জুন ১৯৭৫) পরিশিষ্টে মুদ্রিত তার শতাধিক কাব্যগীতি, হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গানের তালিকা দেখে সর্বপ্রথম তার গানের ভাণ্ডার সম্পর্কে পাঠক উৎসাহী হয়ে ওঠে।

অবশ্য এর আগেই কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘নব দিগন্তের গান’ এবং নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ সম্পাদিত ‘নবজীবনের গান’ সংকলনে ফররুখ আহমদের অনেক কাব্যগীতি অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ঔৎসুক্য মেটাতেই ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার একমাত্র ও একক গানের বই ‘মাহফিল’। প্রকাশ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ। দীর্ঘদিন পর ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বর্তমানের গানের জগতে তার ইসলামি গান পৃথক মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্যের দাবি রাখে।

‘মাহফিল’ বইটি দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে পাঁচটি বিভাগ। বিভাগগুলো হচ্ছে: হামদ, নাত, নামাজ, জুমা ও মুহাররাম। ‘হামদ’ বিভাগে ৩১টি হামদ, ‘নাত’ অংশে ১২টি নাত এবং ‘নামাজ’ অংশে ৫টি, ‘জুমা’ অংশে ৪টি ও ‘মুহাররাম’ অংশে ৬টি গজল মুদ্রিত হয়েছে।

দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম ভাগে রবিউল আউয়াল, ঈদে মিলাদুন্নবী বিষয়ক গজলসহ ৩৩টি ইসলামি গান এবং দ্বিতীয় ভাগে ৩৫টি দোয়া ও মুনাজাত রয়েছে। বইটিতে মুদ্রিত গানের মোট সংখ্যা ১২৬টি।

এসব গানের বাণীতে ফররুখ আহমদের আল্লাহ ও রাসূলপ্রেম এবং ইসলামের প্রতি তার অকৃত্রিম অনুরাগ ও বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া ঈর্ষণীয় একজন কবির কবিসত্তার শক্তিমত্তারও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যান্য রচনাবলির মতো গানের ক্ষেত্রেও তার স্বাতন্ত্র্য ও অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।

বইয়ের ‘মহাপরিচালকের কথা’য় সাবেক সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক, বিশিষ্ট লেখক এ জেড এম শামসুল আলম লিখেছেন: এসব সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) প্রেমের যে আন্তরিকতাময় প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, তা নিখাদ ও হৃদয়ের গভীর উপলব্ধিজাত। ঈমানি আলোকে হৃদয় পরিপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত না হলে কারো পক্ষে এ ধরনের সঙ্গীত রচনা করা সম্ভব নয়। ফররুখ আহমদ
ব্যক্তিজীবন ও আচার-আচরণে ছিলেন ইসলামি জীবন-আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী। সে কারণেই তার কলমে এত নিবিড় অনুভূতিজাত ইসলামি সঙ্গীত রচনা হওয়া সম্ভব হয়েছে।

‘মাহফিল’ বইতে মুদ্রিত ১২৬টি ইসলামি গানের শুরুতে যে হামদটি রয়েছে তা সূরা ফাতেহার ভাবানুবাদ:

সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ রাববুল আলামিন
তুমি রহমান, রহিম তোমার রহমত শেষহীন।

কূল আলমের পালক হে প্রভু তুমি দাতা, দয়াময়
রোজ কিয়ামতে বিচার দিনের মালিক অসংশয়।
তব অধিকারে হাশরের মাঠ শেষ বিচারের দিন।।

করি বন্দেগি তোমারই হে রব করি তব ইবাদত
তোমারই সমীপে চাহি মোরা শুধু মদদ ও হিম্মৎ।
পাঠাও মদদ মোদের জীবনে হে প্রভু রজনী-দিন।।

চালাও মোদেরে তাদের সুপথে নেয়ামত পেল যারা
চির সত্যের সুদৃঢ় পথে সফল হয়েছে তারা।
তোমার রাসূল: নবি, সিদ্দিক, শহিদ ও সালেহিন।।

চালায়ো না তুমি মোদেরে হে প্রভু তাহাদের ভুল পথে
ভ্রান্তিতে লীন যারা পেল শুধু ব্যর্থতা কিসমতে।
যাদের উপরে আছে অভিশাপ রাত্রি ছায়া মলিন।।

ইসলামের প্রতি সাধারণ মানুষের ঝোঁক-প্রবণতা থাকার পরও ফররুখের ইসলামি গানের প্রচার ও প্রসার এখনো অন্তরালেই রয়ে গেছে। ইসলামি গানের ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম যে বিপ্লবের জোয়ার এনেছিলেন, আজকের সময়ে তা একেবারেই স্থিমিত। এখন ইসালামি গানের চর্চা মাদরাসাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সস্তা কথা আর সুরে তা পরিবেশন করা হয়। এ কারণে ইসলামি গান বর্তমানে তার শিল্পমূল্য হারাতে বসেছে।

নজরুলের পরবর্তী সময়ে এ দেশে ইসলামি গানের স্বতন্ত্র ধারাকে সমৃদ্ধ করতে এগিয়ে আসেন ফররুখ। অথচ দুঃখজনক যে,  রার ক্ষেত্রে মূল্যবান এখনও তার অনেক গান সংগৃহীত হয়নি।

জানা গেছে, বেতারের প্রয়োজনে রচিত তার অনেক গানই কণ্ঠশিল্পীদের সংগ্রহে আছে। তার ‘গীতিসমগ্র’ এর প্রকাশনা এখন ইসলামি সমাজের সময়ের দাবি। যেসব কণ্ঠশিল্পী কবির গানে সুরারোপ করেছেন ও কণ্ঠ দিয়েছেন, তারা অনেকেই এখন লোকান্তরিত। বাকিরাও পরকালে যাবার পথে।

বাংলাভাষায় মধ্যযুগ থেকে বিপুল সংখ্যক নাতে রাসূল (সা.) রচিত হয়েছে। এসব নাতে ভক্তির আতিশয্যে রাসূলুল্লাহর (সা.) উপর অবতারত্ব আরোপের একটি ক্ষীণ প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। সেই সাথে ‘মীম’ শব্দের অপব্যাখ্যাও হয়েছে। এ বিষয়ে কবি ফররুখ আহমদের সচেতনতা উল্লেখ না করে পারা যায় না।

বইটির ৩৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত তিন সংখ্যক ‘নাত’ এর দুটি পঙক্তি হচ্ছে: ইঞ্জিলে দেন ঈসা নবি তোমার আসার সুসংবাদ/আহমদে রয় গোপন কি আর রাহমাতুল্লিল আলামিন। এখানে কবি ‘আহমদ’ শব্দটিতে একটি টীকা সংযোজন করে লিখেছেন, আহমদ শব্দে মীম হরফের অপব্যাখ্যা পাওয়া যায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। শরিয়তপন্থী সাধকদের মতে, মীমের অর্থে মখলুকাত বা সৃষ্টিসমূহের প্রতি ইঙ্গিত। রাসূলে করিম (সা.) সৃষ্টির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, এ কথাই এতে প্রমাণিত হয়।

কবির এ টীকা সংযোজন থেকে প্রতীয়মান হয়, ফররুখ আহমদ তার হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান রচনায় ইসলামি শরিয়তের শুদ্ধতার প্রতি অত্যন্ত একনিষ্ঠ ও মনোযোগী ছিলেন। বিভিন্নভাবে সংগৃহীত ফররুখ আহমদের কিছু উল্লেখযোগ্য হামদ, নাত, গজল ও ইসলামি গান তুলে ধরা হলো।

১. তুমি ছাড়া আল্লাহ মাবুদ তো আর নাই।
২. আমরা সবাই সত্য-ন্যায়ের উজ্জ্বল পথে চলব।
৩. যখন আমায় ডাকবে না কেউ।
৪. শোন মুজাহিদ শোন, জেহাদের ঝাণ্ডা যেন রয় উঁচা।
৫. আল্লাহ হাদি করো তুমি সুপথ প্রদর্শন।
৬. আজ আমিনা মায়ের কোলে কে এলো কে এলো।
৭. আজ বিশ্বব্যাপী অবিচারের এ কোন অভিশাপ।
৮. চল মুমিন চল আবার জুম্মার জামাতে।
৯. নামাজ পড়ো জামাতে ভাই।
১০. তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া।
১১. শোন মৃত্যুর তূর্য-নিনাদ, ফারাক্কা বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ।
১২. শহিদের খুনরাঙা কাশ্মীর কাশ্মীর।
১৩. আজকে ওমরপন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন।
১৪. যখন আমায় ডাকবে না কেউ ডাকবে তুমি।
১৫. সকল তারিফ তোমারই আল্লাহ রাববুল আলামিন।
১৬. তোমার নেতা আমার নেতা আল আরাবি মোস্তফা।
১৭. জাগো রে আঁধার রাতের ভালে নবি মোহাম্মদ।
১৮. ও আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান।
১৯. ওঠো রাহাগির রাত হলো  অবসান।
২০. তোমার দয়া আছে খোদা জানি সকল দিকে।
২১. আমরা সবাই আলোর খুনি দীপ্ত কিশোর দল।
২২. রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী।
২৩. রোজ হাশরে তোমার নবি মুহাম্মদের সম্মুখে।
২৪. আরজ শোনও খোদা, আমায় খাতেমা বিল খায়ের করো।
২৫. ইঞ্জিলে দেন ঈসা নবি তোমার আসার সুসংবাদ।

লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক