
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১১
প্রকাশিত : জুন ২৯, ২০২৫
জাহাঙ্গীর স্যার ভালো শিক্ষক কিনা এই সন্দেহ শুধু আমার নয়, অনেকেরই ছিল। এর মূল কারণ হয়তো তার নোয়াখালীর আঞ্চলিক উচ্চারণ। কিন্তু তার ছাত্র তপন এসএসসি পাশ করে ফেলায় তিনি এখন ভালো শিক্ষকের তালিকায় উঠে এসেছেন। জঙ্গুইলা বাড়ির একটি ছেলে কলেজে যাবে পুরো এলাকায় বিষয়টা ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেই কৃতিত্বের অনেকটা লজিং মাস্টার জাহাঙ্গীরের। ছাত্রের সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারেরও কয়েক ধাপ পদোন্নতি হয়ে গেল। তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু হয়ে সড়কে হাঁটেন, মুখে দিগন্ত-বিস্তৃত হাসি। তপনের আব্বা আমিন উদ্দিন ও তার স্ত্রী তাকে প্রায় নিজের ছেলের মতোই দেখেন, আদর-যত্ন করেন।
কিন্তু দু`বছর না যেতেই জাহাঙ্গীর মাস্টারের গর্ব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ছিয়াশি সালের সেপ্টেম্বর মাসে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ফলাফল প্রকাশিত হয়। তপন অকৃতকার্য হয়েছে। তপনের বাপ-চাচারা পাঁচ ভাই। তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা প্রায় ২৫/২৬ জন। একবার হুররে বলে ডাক দিলে যে-কোনো সময় ১০/১২ জন এসে জড়ো হয়। গ্রামে বা মফস্বলে জনশক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। তপন কেন ফেইল করলো এর প্রাথমিক দায় জাহাঙ্গীর মাস্টারের, তাকে গালমন্দ করা শেষ। আমি ওদের বাড়িতে যাই সান্ত্বনার বাণী শোনাতে, তখন ওর মেজো চাচা সিদ্দিক ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে মারতে আসেন, তুই ফার্স্ট ডিভিশন পাইলি আর আমার ভাতিজায় ফেইল করলো ক্যামনে, এক লগে থাকস, এক লগে পাশ করলি না ক্যা?
তিনি একটা লাঠি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার দিকে আসেন, তার পেছনে এক দঙ্গল ছেলেপুলে। আমি বুঝতে পারি লাঠির নাগালের মধ্যে পেলে আজ আমাকে মেরেই ফেলবে। আমি কোনো রকমে দৌড়ে এসে বর্ষার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
টইটম্বুর বর্ষা তখন। নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর থেকে আমি এবং আমার পরিবার জঙ্গুইলা বাড়ির চরম শত্রু হয়ে উঠি। যেখানে আমাদের দেখে সেখানেই ওরা দৌড়ানি-দাবড়ানি দেয়। রাতে এসে আমাদের টিনের চালে বড় বড় ঢিল ছোঁড়ে। এক দুপুরে বিটন মনের আনন্দে নৌকা বাইছিল, হঠাৎ সিদ্দিক মিয়া ওকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যান। পেয়েই তিনি তার বড় ডিঙ্গি নৌকাটা নিয়ে ছুটে আসেন এবং লগি দিয়ে একটা বাড়ি মেরে বিটনকে পানিতে ফেলে দেন। বিটনের চিৎকার শুনে আমরা ঘর থেকে বের হই, ভয়ে আমরা সবাই কাঁপতে থাকি। বিটন অনেক দিন গ্রামে ছিল বলে সাঁতারটা কম বয়সেই শিখে নিয়েছে। কাজেই পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়টা অন্তত নেই। সেদিন থেকে আমি নিজেকেই অভিশাপ দিতে থাকি, আমার বোধ হয় এই বছর পাশ না করলেই ভালো হতো।
যাই হোক ফিরে আসি চুরাশি সালে। এসএসসি পাশ করার পরেই আমার জীবনে একটি বড়ো ধরণের পরিবর্তন ঘটে যায়। এতদিন আমি একটা ঝিনুকের খোলসের মধ্যে বন্দি ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে মুক্ত পৃথিবীতে শ্বাস নেবার সুযোগ পাই। সুযোগটি আমাকে করে দেয় নুরুল ইসলাম। আমি তখন পুরোদমে লেখালেখি করছি। কবিতা লেখি, উপন্যাস লেখি, গল্প লেখি। সারাদিন লেখায় ডুবে থাকি। সেইসব লেখা আগে যেমন গৃহশিক্ষক ছাড়া কাউকে দেখাতাম না, পড়ে শোনাতাম না, এখন আমার সেই জড়তা নেই, সবাইকেই পড়ে শোনাই। এলাকার সবাই জানে আমি একজন কবি।
এক বিকেলে নুরুল ইসলাম বলে, আমাদের এক আত্মীয় আছেন, খুব বড় কবি, স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কবি।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকাই। একই সঙ্গে ভাবতে থাকি তিনি নিশ্চয়ই অনেক আগেই মারা গেছেন। সাধারণত কবিরা মারা গেলেই স্বর্ণপদক-টদক পায়।
নুরুল ইসলাম বলে, না, না, উনি বেঁচে আছেন। উত্তর বাড্ডায়ই থাকেন। একদিন তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।
আমি বলি, তার নাম কি?
নুরুল ইসলাম তার পুরো নাম জানে না, বলে আনওয়ার।
আমি বলি, চলো কবি আনওয়ারের কাছে আজই যাই।
আজ না, আগে একদিন আমি যাই, জিজ্ঞেস করে দেখি তোমার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা?
আমার খুব মন খারাপ হয়। আমি একজন কবি, আরেকজন কবির সঙ্গে দেখা করবো, এতে আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে? আমি আজই যেতে চাই। আসলে আমি স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কবিকে আমার কবিতাগুলো দেখাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি।
নুরুল ইসলাম পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কবির বাড়িতে যায় কিন্তু কবির দেখা পায়নি। তার পুত্র শাহজাদার দেখা পেয়েছে। শাহজাদা নাকি তাকে বলেছে, নিয়া আইসো। আব্বার অনুমতি লাগবে না।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি নুরুল ইসলামকে পাগল করে ফেলি যাওয়ার জন্য। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমার অত্যাচারে নুরুল ইসলাম রাজি হয়। ও খুব অলস প্রকৃতির ছিল আর মেয়েদের মতো সাজগোছ করতো। মুখে স্নো-ক্রিম মেখে, মাথা আঁচড়িয়ে ওর তৈরি হতে অনেক সময় লাগছিল। ও যে অহেতুক সাজসজ্জা করে ঠিক তখনই বিষয়টা আমার নজরে এলো। হয়তো এই প্রতীক্ষাটা না করতে হলে বিষয়টা কখনোই খেয়াল করতাম না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই মানুষকে কিছু না কিছু শেখায়।
সেই সন্ধ্যায় আমি কাঙ্ক্ষিত কবিগৃহে পৌছে যাই। ওমা, এটা তো কোনো বাড়ি নয়। একটা ছাপড়া ঘর, তাও অন্যের জমিতে। ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা স্টিলের আলমারি আর দুটো খাট, ছোট্ট একটা লেখার টেবিল আর একটা কাঠের চেয়ার। যেখানে বসে কবি লেখালেখি করেন। স্টিলের আলমারিতে কোনো অলঙ্কার, সোনা-দানা নয়, কবি সেখানে রাখেন তার অতি মূল্যবান, টাইপ রাইটারে টাইপ করা, কবিতার পাণ্ডুলিপি।
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি কবির দেখা পাইনি। তিনি বাড়িতে নেই। কবির স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি বলেন, কাল বিকাল চারটায় এসো, তখন কবিকে পাবে। চলবে