কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের চিলতে গদ্য ‘চাঁদরাতে ভাংচুর হবে’

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০২৪

চাঁদরাতে রিলিজ হচ্ছে আরিফ রানার নতুন গান ‘ভাংচুর`। এই বাক্যটি লিখতে গিয়ে আমি বেশ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। আপনারা যারা আমার বয়সী বা কাছাকাছি বয়সের তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আশির দশকের শেষের দিকে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ক্যাসেটের গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

নতুন বই প্রকাশের জন্য যেমন লেখক-প্রকাশকেরা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতীক্ষায় থাকেন, তেমনি শিল্পীরা, ক্যাসেট কোম্পানিগুলো ঈদের অপেক্ষায় থাকতেন। সারা বছরই ক্যাসেট বেরুত, তবে ঈদে নতুন ক্যাসেট রিলিজ হওয়া ছিল একটি বিশেষ ব্যাপার। ক্যাসেটগুলো বেশিরভাগ চাঁদরাতে বেরুত।

ঢাকার বড় বড় মার্কেটগুলোতে ক্যাসেট বিক্রির দোকান ছিল, তারা লাউডস্পিকারে চাঁদরাতে নতুন রিলিজ হওয়া গানের ক্যাসেট বাজাত। তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, ডলি সায়ন্তনী, দিলরুবা, শুভ্র দেব, রবি চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীকে আমরা সেই সময়ে পাই। এর কিছুকাল আগেই বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের যাত্রা শুরু হয়। তবে ক্যাসেট মাধ্যম এই যাত্রাটিকেও জনপ্রিয় করে তোলে।

যেহেতু অনেক শিল্পীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল, ব্যক্তিগত আলাপ-পরিচয় ছিল, তাই জানি, চাঁদরাতে তারা গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন মার্কেটের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতেন। বোঝার চেষ্টা করতেন তার গানটি বাজছে কিনা। কেউ কেউ আরো একটু উৎসাহী হয়ে শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করতেন, কেমন বিক্রি হচ্ছে তা বোঝার চেষ্টা করতেন।

আমরা তখন ঈদের শপিংয়ের বাজেটে একটা/দুইটা ক্যাসেটও রাখতাম। ক্যাসেটের দাম ছিল ত্রিশ/পঁয়ত্রিশ টাকা। চাঁদরাতে শিল্পীরা ক্যাসেট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সম্মানির টাকাটা পেতেন। আমার শিল্পী বন্ধুদের মুখে তখন বিজয়ীর হাসি দেখতাম।

এর কিছুদিন পরেই সিডি এসে ক্যাসেটের জায়গাটা দখল করে নেয়। কিন্তু সিডি ক্যাসেটের মতো ততটা জনপ্রিয় হতে পারেনি। এর মূল কারণ, গ্রামে-গঞ্জে মানুষের ঘরে ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ারের মতো সিডি প্লেয়ার পৌঁছাতে পারেনি। আর্থ-সামাজিক কারণেই তা সম্ভব হয়নি। সিডি মূলত শহুরে সংস্কৃতির মধ্যেই সীমিত ছিল।

এখন সিডি ও ক্যাসেট কিছুই নেই। এখন সঙ্গীত চলে গেছে ইউটিউবে, ফেইসবুকে। আগের মতো একজন শিল্পীর একসঙ্গে ১২/১৩টা গান প্রকাশ হয় না। এখন গান প্রকাশ হয় একটা। প্রায় সব শিল্পীরই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল আছে। তারা তাদের সময় মতো গান তৈরি করে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করে।

কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল আছে, তারা অর্থ বিনিয়োগ করে শিল্পীদের দিয়ে গান তৈরি করে, তবে তা খুবই কম। এখন গানের জন্য একটি ক্রান্তিকাল চলছে। গান মানুষ শুনছে ঠিকই, শ্রোতা কমেনি কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাপারটা বেশ এলোমেলো হয়ে গেছে। ফলে পেশাদারিত্বটা সব ক্ষেত্রেই কমে গেছে বলে আমার মনে হয়। পেশাদারিত্ব না থাকলে কাজের মানও পড়ে যাবে, এটিই স্বাভাবিক।

গানের এই দুর্দিনেও কিছু নিবেদিত শিল্পী শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সেইরকম একজন শিল্পী আরিফ রানা। তিনি খুলনার মানুষ। বর্তমানে বিশ্ব শিল্প-সাহিত্যের তীর্থ প্যারিসে বসবাস করেন। ঘুমানো ছাড়া আর বাকিটা সময় সঙ্গীতের মধ্যেই থাকেন। আমার লেখা দুটো গান এর আগে তিনি নির্মাণ করেছেন, একটি দেহকাব্যের গান, অন্যটি ধুলপবনের গাঁও।

দুটি গানেরই নির্মাণ খুব শিল্পসম্মত হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ জনপ্রিয় হয়নি গানগুলো। এবার তিনি নির্মাণ করলেন ‘ভাঙচুর’। এটি আরিফ রানার ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পাচ্ছে চাঁদরাতে। সবাইকে শোনার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক