কারার ঐ লৌহকপাট, এ আর রহমানের সুর ও বাঙালির রক্ষণবাদী বালখিল্য

রহমান মুফিজ

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২৩

আপনি প্রথমে বোঝার চেষ্টা করেন যে, এ আর রহমান কোথাও ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের সুর বিকৃত করেননি। এটা একদমই নতুন সুর। নজরুলের গানের আরেকটা ভার্সন বলতে পারেন। এ গানের প্রচলিত যে সুর যেটা গিরীণ চক্রবর্তীর করা, তার কোনো নোট এমনকি কোনো পরিবেশনভঙ্গিও ব্যবহার করেননি এ আর রহমান। এটা একদমই নতুন নির্মাণ, নতুন প্রকাশ। এখানে নজরুলের কথা অবিকৃত রেখে নতুন সুরের একটা এক্সপেরিমেন্ট প্রত্যক্ষ করেছি আমরা।

আর আর্ট তো ইটসেল্ফ এক্সপেরিমেন্ট। শিল্প কখনো মৌলিক কিছু নয়, শিল্প কখনো এবসলিউট কিছুও নয়। শিল্প নানামাত্রিক নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠতে উঠতে, ভেঙে পড়তে পড়তে এগিয়ে যায়। যেটা টিকে থাকার সেটা টিকে থাকে, যেটা ঝরে পড়ার সেটা ঝরে পড়ে। শিল্পের টিকে থাকা আর ঝরে পড়া নির্ভর করে ওই শিল্পের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর। শিল্পসমঝদার মানুষ হিসেবে আপনার-আমার কাজ হচ্ছে শিল্পকে ‘যা ইচ্ছা তা’ হতে দেওয়া। সে কিভাবে হয়ে উঠে বা ভেঙে পড়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকা। শিল্প আপনার অনুমোদনের তোয়াক্কা করে না। শিল্প নিজেই নিজের শর্ত। অন্যের শর্তে সে জন্ম নেয় না অন্যের শর্তে সে মারাও যায় না।

‘কারার ঐ লৌহ কপাটে’ এ আর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টির প্রতি যারপরনাই সৎ থেকেছেন। গানের কথাকে এক বর্ণও এদিক-ওদিক করেননি। কিন্তু সুরকার হিসেবে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন। তার উদ্ভাবনের পক্ষে কোনো ধরনের প্রি-কনসেপ্ট, কোনো ধরনের পূর্বশর্তকে প্রশ্রয় দেননি।

তাহলে নজরুলের গানের সুর বিকৃত করার  অভিযোগ কেন করছেন? যারা এটা করছেন তাদের উদ্দেশ্য ও রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। অথবা তাদের বালখিল্য বা বোকামো নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারেন। প্রশ্ন তোলাটা জরুরি। কারণ, কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি বা সম্প্রদায় পৃথিবীর কোনো শিল্প বা আর্টের একক অথরিটি দাবি করতে পারে না। পৃথিবীর সমস্ত শিল্পের মালিকানা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের। এমন কি শিল্পী নিজেও তার সৃষ্ট শিল্পের মালিক নন। যদিও মেধাস্বত্ব আইনের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শিল্পীর স্বত্ব স্বীকার করে এক ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়। তার মানে এই নয় যে, ওই সুনির্দিষ্ট শিল্পকীর্তির অথরিটি বা কর্তৃপক্ষীয় ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়। শিল্পের কর্তৃপক্ষ মূলত ‘মানুষ’।

এ আর রহমান ‘কারার ঐ লৌহ কপাটে’ এ ধরনের সুর দেওয়ার কে? তাকে এ অধিকার কে দিয়েছে― এমন আলাপ শিল্পের উঠানে দাঁড়িয়ে দিলে আপনি স্রেফ অর্বাচীন প্রতিপন্ন হবেন। কারণ আপনি জানেনই না শিল্পী জন্মগতভাবে একটা অধিকার নিয়ে জন্মান সেটা হলো, তিনি অধিকারের ধার ধারেন না।

আপনি বলবেন ‘কারার ঐ লৌহ কপাটের’ একটা স্টাবলিশড সুর আছে, সেই সুরকে কেন্দ্র করে বাঙালির একটা আবেগ আছে, কেননা বাঙালির অবরুদ্ধ সময়ের নানা রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় এ গান প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। একদম ঠিক। কিন্তু তাই বলে আপনি দাবি করছেন, এ গান নিয়ে নতুন কোনো এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে না? এক্সপেরিমেন্ট করলেও মৌলানুগ হতে হবে? এক্সপেরিমেন্ট করলেও আপনার অভ্যাস ও আরামের অনুবর্তী এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে? কেন? এ গান কি মন্দির-মসজিদ হয়ে গেছে? এ গান কি ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠেছে? এ গানকে কি আপনি ‘কাল্ট’ করে তুলেছেন? তাহলে আপনি আর অন্ধ কূপমণ্ডক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য কি রইলো?

ধর্মের কোনো বিষয় নিয়ে নতুন কোনো ভাবনা হাজির করলে ধর্মান্ধদের ভয় যেমন থাকে, তাদের ব্যবসা বা রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হবে কি না, তেমনি আপনার ‘কাল্টকে’ ঘিরে নতুন শিল্প নির্মাণের প্রয়াস হলে আপনার ভয়টা কোথায়? আপনি যে গানকে কাল্ট ধরে নিচ্ছেন সেটা খুব দুর্বল? ভেঙে পড়বে সেটা? নাকি আপনার কাল্টকে ঘিরে আপনার ‘ইমান’ই অতিশয় দুর্বল?

নজরুলের গানে এ আর রহমানের নতুন সুরারোপ নিয়ে আপনার প্রতিবাদ, নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশের ছিরি দেখে আমি রীতিমতো স্তম্ভিত। উগ্র ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর মতো আপনি একজন শিল্পীকে তার একটা শিল্পীত প্রচেষ্টাকে ‘অপরাধ’ সাব্যস্ত করছেন। তার সৃষ্টিপ্রয়াসকে নিষিদ্ধ করার দাবি করছেন। এমন কি নিন্দের ঝড় তুলতে তুলতে তার সব সৃষ্টিকে বয়কট করার ঘোষণাও দিচ্ছেন। আহা! আপনার কি জাত্যাভিমান! আপনার কি বাঙালিপনা। আপনার কি শিল্পপ্রেম! আপনার কি প্রগতিপনা!

আপনিই বলেন, আপনার এ আলাপ প্রগতিশীল নাকি রক্ষণবাদী? যদি প্রগতিশীল হতেন, তাহলে বিশ্বাস করতেন শিল্প-সংস্কৃতি একটা প্রবহমান বিষয়। প্রতিমুহূর্তে বিচিত্র সব নিরীক্ষা ও নবায়নের ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হয়। কোনো ফ্রেমে আটকে থাকা নয়, কোনো কিছুকে কাল্ট বানিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রক্ষণবাদী হয়ে ওঠা নয়, শিল্পীর স্বাধীনতা, শিল্প গড়ে ওঠার অবাধ ও নিঃশর্ত পরিবেশ গড়ে তোলাটাই আপনার-আমার কর্তব্য। এর পরও যদি কোনো নির্মাণ আপনার পছন্দনীয় না হয়, আপনাকে স্বস্তি না দেয়, আপনার রুচি অনুবর্তী না হয়, সে নির্মাণ, বিনির্মাণ বা পুণনির্মাণকে আপনি সমালোচনা করুন, বাতিল করুন যুক্তি দিয়ে। এমন কি তার ভোক্তা না হওয়ার অধিকারও আপনি সংরক্ষণ করেন।

কিন্তু আপনি তাকে নিষিদ্ধ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন না। আপনি একজন শিল্পীকে যারপরনাই ভর্ৎসনা করে এলাকাছাড়া করতে পারেন না। শিল্পীর প্রতি কোনো ধরনের অমর্যাদাকর উচ্চারণও করতে পারেন না। আপনি শিল্পীকে সীমানা টেনে দিয়ে বলতে পারেন না ‘এইটা আমার এলাকা, ওইটা তোমার এলাকা’। আপনাকে বুঝতে হবে শিল্প নিয়ে সমালোচনা, তার গ্রহণ-বর্জন সম্পর্কিত আলাপে আপনার সীমানা কতটুকু?

আপনি জানেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানে গিরীন চক্রবর্তীর করা সুরটাও ছিল রিমেক। নজরুলের করা প্রথম বা আদি সুরটা আর পাওয়া যায় না। ১৯২১ সালে গানটা রচিত হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে গিরীন বাবুর নতুন সুরারোপ পর্যন্ত (২৫ বছর) নজরুলের করা সুরেই লোকমুখে এ গান বিচ্ছিন্নভাবে গীত হয়েছে বলে গবেষকরা বলছেন। ১৯৪৯ সালে ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথমবার ব্যবহৃত হওয়ার পর বলা যায় বেশ জনপ্রিয়ই হয়ে ওঠে এ গান।  তার মানে গিরীন চক্রবর্তীর সুরটাই স্রোতাসমাজে প্রশ্নহীন মান্যতা পেয়েছে। কিন্তু এবার নতুন ছায়াছাবি ‘পিপ্পা’য় ভিন্ন আঙ্গিকে সুরারোপিত হয়ে যখন আমাদের কানে আসলো তখন সেটা আর প্রশ্নহীন মান্যতা পাচ্ছে না। কারণ আমাদের অভ্যস্ত সুরের বাইরে গিয়ে গুণী সুরকার এ আর রহমান যখন নতুন, অনভ্যস্ত ও অপরিচিত সুরে গানটা উপস্থাপন করলেন তখন আমরা দাবি করছি― তিনি কাজটা ঠিক করেননি। কারণ, তিনি আমাদের অভ্যাসে ঘা দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে শুনতে শুনতে গড়ে ওঠা শ্রবণমন্দিরের দেয়ালে আঁচড় কেটেছেন।

এই গান নিয়ে কাল্ট প্র্যাক্টিসের বাইরে এসে ভেবে দেখেন তো, নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’র অনেকগুলো সুর এক্সিস্ট করছে। গিরীন চক্রবর্তীর একটা রিমেক, এ আর রহমানের একটা রিমেক― এভাবে আরও কয়েকটা রিমেক শোনার অভিজ্ঞতা যুক্ত হচ্ছে আমাদের কানে― বিষয়টা কী দারুণ আর কী রোমাঞ্চকর! নতুন নুতন সুর ও সঙ্গীতায়োজনে সৃষ্টিসুখ উপভোগ করতে পারার মতো আনন্দ! আহা! নজরুল তো বলেই গেছেন―

আজ  সৃষ্টিসুখের উল্লাসে―
মোর চোখ হাসে, মোর মুখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ  সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।

বলি, রক্ষণবাদী বালখিল্যপনা দিয়ে শিল্পীর সৃষ্টিসুখের উল্লাসকে স্তব্ধ করবেন না, বরং তার সৃষ্টিকে এপ্রিশিয়েট করুন। কোনো আপত্তি থাকলে বলুন, লিখুন। কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে তেড়ে যাবেন না। শিল্পের ওপর কোনো ‘ব্লাসফেমি’ আরোপ করবেন না দয়া করে। করলে সেটা হবে বর্বরতা, ভয়াবহ অপরাধ।

লেখক: কবি