গাজায় হত্যাযজ্ঞ এবং আরবীয় শাসকদের মুনাফেকি চরিত্র

আবদুল্লাহ ইসহাক খান

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২৩

ওহুদের যুদ্ধে নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার তিন হাজার সদস্যের মুশরিক বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হন, তখন তিনি মদিনার সাহাবিদের সাথে করণীয় কী তা নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। আলোচনার ভিত্তিতে তখন তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মদিনার অদূরে ওহুদ প্রান্তরে তারা শত্রুদের মোকাবেলা করবেন।

সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক এক হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে তারা মদিনা থেকে ওহুদের উদ্দেশে রওনা হন। এই বাহিনীর সাথে ছিল মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার তিনশো সৈন্য। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মদিনা থেকে নবির দলের সাথে একসাথে বের হয়ে ওহুদ প্রান্তরের কাছাকাছি আসতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেলল। সে বলল, তারা যুদ্ধে অংশ নেবে না। তাই তারা যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে মদিনায় ফেরত চলে গেল।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার মুনাফিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটিয়ে যুদ্ধের স্থান ত্যাগ করলো এবং মুসলিমদের বাহিনী তখন এক ধাক্কাই এক হাজার থেকে সাতশোতে নেমে গেল। মূলত মুনাফিকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের ময়দানে মুসলিমদের মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং আসল যুদ্ধের আগেই মুসলিমরা যেন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়।

আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে আল্লাহও এভাবে পরীক্ষা করলেন যে, ঈমাদের দাবিতে কে আসলে সচ্চা আর কে আসলে মুনাফিক? আর নবির সাথে মুনাফিক বাহিনী থাকবে ও শত্রুর সাথে একসাথে যুদ্ধ করবে মহান আল্লাহর তাকদিরের লিখনও নিশ্চয় সেভাবে লেখা ছিল না।

এখান থেকে মুনাফিকদের চরিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং সেটাই নবির জীবনের মাধ্যমে তার উম্মতের কাছে পরবর্তী সকল প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আল্লাহ এভাবেই বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে মুমিন ও মুনাফিকদের দলকে আলাদা করেন।

একদিকে মুমিনের দল আরেকদিকে মুনাফিকদের দল। সমাজে সাধারণভাবে তারা একসাথে মিলেমিশে থাকলেও যখনই ইসলামের শত্রুদের সাথে মুসলিমদের সরাসরি সংঘর্ষের সময় চলে আসে তখনই মুনাফিকদের আসল চরিত্র বের হয়ে আসে। আর এটাই আল্লাহর হিকমত, তিনি এভাবেই বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে মুনাফিককে মুমিনদের কাতার থেকে আলাদা করেন।

আজকের জমানায় সেই ওহুদের প্রান্তর হচ্ছে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি, বায়তুল আকসার পবিত্র ভূমি ও গাজার পবিত্র ভূমি। যেখানে ইসলামের শত্রুরা মুসলিমদের সাথে প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। প্রকাশ্য এই যুদ্ধের মাধ্যমেই আসলে প্রকাশিত হবে কারা আসলে ঈমানের দলভুক্ত আর কারা আসলে মুনাফিক সর্দার আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর দলভুক্ত।

এখানে মনে রাখা দরকার, আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও ঈমান এনেছিল, সেও মুসলিমদের মতো পোশাক পরতো, সেও নামাজ পড়ত এবং সেও আরবিতে কথা বলতো। কিন্তু তার অন্তরে ছিল ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ। আর ইসলামের ভালোর চাইতে ক্ষতি বেশি পছন্দ করতো শুধুমাত্র তার নেতৃত্ব ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

অর্থাৎ সে ঈমানের চেয়ে দুনিয়ার ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। তাই একদম যুদ্ধের ময়দানেও সে নবি ও মুসলিমদেরকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দিয়ে আসতে কুণ্ঠিত বোধ করেনি। বরং সে আশা করেছিল, এই যুদ্ধের মাধ্যমে নবি ও সাহাবিরা নিহত হলে মদিনার ক্ষমতা তার হাতে চলে আসবে। আর এটাই ছিল তার জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগ।

ঠিক তেমনি আজকে দেখতে পাই, আরব বিশ্বের একদম নাকের ডগায় ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের মুসলিমদের প্রতি গণহত্যা চললেও, অসম যুদ্ধ চললেও, বছরের পর বছর জুলুম-নির্যাতন চললেও পশ্চিমের মদদপুষ্ট আরবের শাসকরা তাদের পশ্চিমা প্রভুদের খুশি রাখতে কখনোই ইজরায়েলের সন্ত্রাস ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না, কোনো উচ্চ-বাচ্চ্য করে না। পশ্চিমারা নারাজ হয় এমন কোনো উদ্যোগ তারা হাতে নেয় না। বরং লোক দেখানো কিছু নিন্দা আর কিছু ছোট-ছুটি ও বৈঠকের মাধ্যমে শুধু সময় ক্ষেপণ করে।

তারা ফিলিস্তিনি অসহায় ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়ায় না। তারা যখন শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন আরব শাসকরা হ্যালোউইনের উৎসব পালন করে। গাজার ভূমি যখন রক্তে লাল হয়ে যায় তখন তারা বিনোদনের জন্য নিয়ন নগরী বানাতে ব্যস্ত থাকে। তারা আপাত হয়তো আল্লাহতে বিশ্বাস করে, তারা নামাজও পড়ে, তারা মুসলিমদের মতো পোশাকও পরে। কিন্তু তাদের অন্তরে নির্যাতিত মুসলিমদের প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই, কোনো ভালোবাসা নেই, কোনো দুঃখ-বোধ নেই। বরং তারা নিজেদের ক্ষমতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশ বজায় রাখার স্বার্থে পশ্চিমাদের অনুগত হয়ে মুসলিমদের ভাই-বোনদেরকে যুদ্ধের ময়দানে একলা ফেলে রাখে। তাদের ক্ষমতা ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তাদের সৈন্য বাহিনীগুলো বেরাকে বসে থাকে আর চেয়ে চেয়ে মুসলিমদের গণহত্যা দেখে।

আর এরাই হলো আজকের দিনের আবদুল্লাহ ইবনে উবাইর বংশধর। হ্যা, ওহুদের ময়দানে মুসলিমদের অনেকেই শদিদ হয়েছেন, অনেক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুসলিমরাই জয়ী হয়েছে আর মুনাফিকরা অপমানিত-লাঞ্ছিত হয়েছে। আজকের দিনে ফিলিস্তিনিরা হয়তো দুর্বল, তারা সংখ্যায় কম, তারা ব্যাপকভাবে শহিদি মৃত্যুবরণ করছে। কিন্তু হাদিসের ভাষ্যমতে, একদিন তারাই বিজয়ী হবে, তারাই আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, তাদের জন্যই ইমাম মাহদি আসবেন, তাদের জন্যই গাছ কথা বলবে, তাদের জন্যই পাথর কথা বলবে, আর তাদের বিজয়ী করতেই ইসার আ. আগমন হবে। আর ইসলামের শত্রু ও মুনাফিকরা তখন সেদিন হবে লাঞ্ছিত ও পরাজিত।

মহানবি (স.) বলেন, “আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর দৃঢ় থাকবে। তারা শত্রুকে পরাজিত করবে এবং যারা তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করবে তারা ক্ষতি করতে পারবে না।”

সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, তারা কোথায় থাকবে?”
মহানবি জবাব দিলেন, আল মাকদিস। (আহমদ)