গাজী কামরুল হাসানের গল্প ‘ক্যাকটাসের কাঁটা’

পর্ব ৭

প্রকাশিত : অক্টোবর ২১, ২০২১

নতুন বছরের প্রথম দিন। রেন্ট-এ কারের গাড়ি আধঘণ্টা আগে শাহানাদের তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। বাসায় ঢুকে লতিফা বেগমের মেজাজ সপ্তমে উঠল। রাহেলাকে দুই-তিনটা কড়া কড়া গালি দিয়ে ছোট বোনকে বললেন, অভাগির বেটির স্পর্ধা দেখলি। ফোন করে মাসের মাঝখানে কাজ ছেড়ে দিল। বড় গার্মেন্টসে নাকি লাট সাহেবের চাকরি পেয়েছে... অনেক বেতন। দেখিস...কয়দিন পর আমার পায়ে এসে পড়তে হবে... তখন জুতা খুলে এমন বাড়ি দেব। অবশ্য ভালোই হয়েছে। নতুন আরেকটা খুঁজতে হবে, এই যা।

মাথা নিচু করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল শাহানা। জানালার গ্রিল ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে থাকে। ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল শাহানা। পিছনে তাকিয়ে দেখে দরজার সামনে জয়া দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে এক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো জয়া। বিস্ময়, ক্ষোভ অনুভূতিগুলো ক্রোধে পালটে যেতে থাকে। রাগে জয়ার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। এক পা দুই পা করে সে শাহানার দিকে আগাতে থাকে। একবারে সামনে এসে শাহানার গালে সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় মারল। গ্রিল ধরে নিজেকে কোনোরকমে সামলে নেয় শাহানা।

এত রিষ তোর মনে। আমার ভালো মানুষ বাবাটার নামে... ছি ছি শাহানা। তোকে দেখলে ঘিন্না হয় আমার... ছি... সুমনকে চেপে ধরে কথাটা... ছি...মুখে আনতেও ঘেন্না হয়... কিভাবে পারলি এসব বলতে... তুইতো আমার আপন বোনের থেকেও কাছের ছিলি...

শাহানার মুখের দিকে একবার বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে জয়া হনহন করে ঘর থেকে বার হয়ে চলে গেল। আম্মা, ভাইয়া, আব্বা, খালা এবার জয়া... একটুও অবাক হলো না শাহানা। কারন, আসলে দোষ তো তার। কেন গিয়েছিল ওখানে! কেন গিয়েছিল লংস্কার্ট আর টপস পরে!

দিনগুলো যেন একসাথে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও শাহানা সেই জট ছাড়াতে পারছে না। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে দিন কেটে যায় শাহানার। মাঝে মাঝে দরজার ওপাশ থেকে কথা বলার শব্দ শোনা যায়। হাসির শব্দ শোনা যায়। মায়ের, ভাইয়ার, জয়ার। আব্বা রংপুর থেকে এসেছিল। কয়েকদিন থেকে আবার চলে গেছে। তার ঘরে একবারের জন্যও আসেনি। আজকে নতুন বছরের পনেরতম দিন। একমাস হয়ে গেছে কলেজে যাচ্ছে না। কালকে যাবে নাকি যাবে না... কেউ তাকে চিনতে পারবে? আয়নায় দাঁড়ালে নিজেকেই চিনতে পারে না...

কলেজে পরে যাওয়ার ফুলহাতার জামাটা ইস্ত্রি করছে শাহানা। নতুন বছরের তৃতীয় দিন থেকে করছে। শনিবার থেকে বুধবার... কিন্তু যাওয়া আর হয় না। টেবিলে রিকসা ভাড়া আর নাস্তার টাকাগুলো পড়ে আছে। মা রেখে যায়। দিনে ওই একবার তার ঘরে আসে। প্রতিবেলার খাবার নতুন মেয়েটা রেখে যায়। কী যেন নাম... হ্যাঁ জেবা... ঘুম?... ঘুমতো কতদিন হয় না... না, মাঝে মধ্যে হয় মনে হয় অল্পসল্প... কে জানে!

আচ্ছা, ইস্ত্রিটা এখনও গরম। তাই না? একটু আগে ইস্ত্রি করল। কেমন গরম দেখার জন্য কেন জানি একটা ইচ্ছা হতে থাকে। ডান হাতটা কাত করে শোয়ানো ইস্ত্রিটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে... হঠাৎ করে বাসার কারেন্ট চলে গেল... সম্বিৎ ফিরে পায় শাহানা। ঝটকা টান দিয়েসে মেশিনটার একদম কাছ থেকে তার হাতটা সরিয়ে নিল।

আজকে নতুন বছরের সাতাশতম দিন। রবিবার... ডায়েরির জানুয়ারি মাসটা লাল লাল দাগে ভরে গেছে। সকালবেলা শাহানা কলেজে যাওয়ার জামাটা পরে নিল। টেবিলে রাখা টাকাগুলো নিয়ে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বাসা থেকে বার হয়ে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবে। তারপর কলেজের দিকে হাটা শুরু করে। কতটুকু আর পথ। হেটেই যেতে পারবে।

ক্লাসরুমে ঢুকে একেবারে পিছনের বেঞ্চে বসে পড়ে শাহানা। তারপর জানালা দিয়ে করিডোরের দিকে তাকিয়ে  থাকল। জয়া, রত্না আর লিজাও ক্লাসে আছে। রত্না আর লিজা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল কিন্তু কাছে আসল না... ও হ্যাঁ। চিকেন পক্স হয়েছিল তার... ভাইয়া কলেজে ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন জমা দিয়েছে... অনেক কঠিন আর ছোঁয়াচে রোগ... হলে দাগ লেগে যায়...

কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজলেসবিতা সেনক্লাস ইলেভেন কমার্স সেকশন বিএর রুমে ঢুকলেন। বিশ বছরের চাকরিতে তার এখন পর্যন্ত একদিনও দেরি হয় নাই। ক্লাসে ঢুকে তিনি পুরো ক্লাসে একবার চোখ বুলিয়ে গেলেন। শাহানার দিকে চোখ পড়তেই বিস্মিত হয়ে যান। কি হয়েছে মেয়েটার? অফিস থেকে বলেছিল, পক্স। দেড় মাসে শুকিয়ে কাঠি কাঠি হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। ইস, নিশ্চয়ই অনেক ভুগেছে বাচ্চা মেয়েটা!

সবিতা সেন ক্লাসে পড়ানো শুরু করলেন। কিন্তু বারবার তার চোখ শাহানার দিকে চলে যেতে থাকে। মেয়েটার ক্লাসে থেকেও যেন নেই। জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। কি বিষণ্ণ সেই দৃষ্টি... বুকের মাঝে কেমন জানি করতে থাকে সবিতার। মনের মধ্যে একটা খটকা লাগে... এরকম তাকানো তিনি আগেও দেখেছেন বেশ অনেকবার... চলবে