চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ০১, ২০১৯

কোনো মহিলা যদি একটু উপযাচক হয়ে একজন পুরুষকে বলে, ‘আমি আপনাকে পছন্দ করি’, আরো এক ধাপ এগিয়ে, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি’ অথবা ফাইনালি, ‘আমি আপনার সাথে শুতে চাই’— তবে সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া কিংবা তাকে প্রত্যাখ্যান করা যেকোনোটাই করতে পারে সেই পুরুষ; কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই সম্ভবত ওই পুরুষ মনে করবে যে, তার সামনে এই ধরনের আবেদন পেশ করে ওই মহিলা তাকে অপমান করল। কারণ, তার মাথায় স্বভাবতই এ কথা আসবে না যে, একথা বলার মাধ্যমে একজন মহিলা তাকে ভোগ করার কথা বলল অর্থাৎ তিনি আসলে ভোগ্যবস্তু। একথা মনে না আসার কারণ, এটা আমাদের সোস্যাল সেক্সুয়াল কনস্ট্রাকশন নয়। বরং তিনি একথা মনে করেই স্বাভাবিকভাবে গর্বিত হবেন যে, তিনি এখনো কতখানি কাম্য!

আমি যখন কলেজে পড়ি, একদিন এক বান্ধবী এসে আমাকে বলল, চোখ মুখ তার রক্তাভ, ‘জানিস, ও আমাকে আই লাভ ইউ বলেছে। কী সাহস!’ আমি বেশ ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ‘তা ওতে অত রেগে যাওয়ার কি আছে? ভালোবাসার কথাই তো বলেছে। ঘৃণা করি বললে খুশি হতিস? সে চাইলে তুই ভালো নাও বাসতে পারিস তাকে’। শুধু ‘আই লাভ ইউ’ বললে যখন এই প্রতিক্রিয়া, ‘আমি তোমার সাথে ঘুমাতে চাই’ এ কেবল সপাটে চড় আর খিস্তি ছাড়া কিই বা প্রত্যাশা করা যায়। কারণ সোস্যাল কনস্ট্রাকশন এটাই যে, এটা বলার মধ্যে দিয়ে মেয়েটিকে ভোগ করার অফার দেয়া হচ্ছে, কুইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে, যেহেতু বিছানার ইক্যুয়েশনে সে এক ভোগ্যবস্তু হিসেবেই চর্চিত। ছিচকে পুরুষরাও তাই বুঝে গেছেন এইসব কথা বললে মহিলাদের যারপরনাই বিরক্ত করা যায়। এইসব কথা বললে একজন মহিলাকে অপমানিত করা যায় অতি সহজেই, কারণ তারা এই অপমানটাকে নেন, গায়ে মাখেন। অন্য কোনোভাবে যখন একজন মহিলাকে নামানো যায় না, ছোট করা যায় না, উত্তেজিত করা যায় না, তখন এইসব বলে সহজেই তার ওপর যাবতীয় প্রতিশোধ নেয়া যায়। কারণ তিনি এটা গায়ে মাখেন অবলীলায়।

হ্যাঁ, প্রতিশোধ। একবার এক উচ্চশিক্ষিত সাহিত্যের প্রফেসর আমাকে বলেছিলেন, ‘আজকাল যে এই কাজকারবারের মন্দা, ছেলেদের কোনো চাকরি বাকরি নেই, এরজন্য কারা দায়ী জানো? তোমরা। মেয়েরা। তোমরা রান্নাঘর ছেড়ে এখন এসে নেমে পড়েছো চাকরির বাজারে।’ এ কথা বলতে বলতে, আমি দেখছিলাম, তার চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে, দাঁতে দাঁত ঘষার রব উঠছিল। মেয়েদের ওপর রেপ শ্লীলতাহানি তথা যৌন শোষণের যত রকম অপরাধের কথা শোনা যায়, তার কারণ কেবল অবদমিত যৌন উত্তেজনা নয়, কারণ তার জন্য শহরে গ্রামে অনেক `পতিতালয়` আছে। কিন্তু যিনি এরই মধ্যে সমাজের দৃষ্টিকোণে `পতিতা` হয়েছেন, তার ওপর শুধু যৌনেচ্ছা মেটানো যায়, তাকে নতুন করে টেনে নামানো যায় না। টেনে নামানো যায় একটি সাধারণ মহিলাকে, যিনি মনে করেন তার যৌনতা একটি অত্যন্ত পবিত্র সম্পদ, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি তাতে কারোর হাত পড়ে তবে তিনি পতিত তো হবেনই, কারোর কাছে মুখ দেখানোর যোগ্য থাকবেন না। তাই যৌনতার নামে সামাজিক প্রতিশোধ তার ওপরেই তো নেয়া সম্ভব, তাকে অন্য সবার দৃষ্টিতে সর্বোপরি তার নিজের দৃষ্টিতে নিজের কাছে অগ্রহণীয় করে তুলে।

এমন অনেক মহিলাকে দেখেছি যারা অবলীলায় নিজের আবক্ষ উন্মোচিত ছবি পোস্টিয়ে তালি কুড়োতে চান। কিন্তু সেই ছবির নিচে কেউ `সেক্সি` শব্দটুকু লিখলেও তিনি রাগে তেড়ে আসেন। এইসব মহিলারাই নিজের অজান্তেই হয়তো ওইসব ছিচকে পুরুষদের মরাল আরো স্ট্রং করে, যারা মহিলাদের অপমান করার সহজ রাস্তাটি খুঁজে বেড়ায়। যৌন আবেদনময়ী হওয়া কি আপনার দোষ? নাকি আপনাকে `সেক্সি` বলা হলো মানেই আপনাকে খারাপ বলা হলো? কাউকে `সেক্সি` বলা হলো মানে গালাগাল দেয়া হলো বা বক্তা আপনার সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে চাইছে, এমনও নয়। উপরন্তু আপনি যদি যৌন সুড়সুড়ি দেয়া ছবি দেখান আর দর্শকের যদি তাতে যৎপরনাস্তি সুড়সুড়ি লাগে, তাতে দোষ কার? সে আপনাকে রেপ না করতে এলেই তো হলো। কিন্তু সে যদি বুঝতে পারে যে, আপনার কাজ আসলে সুড়সুড়ি দেয়া অবধি, তার অধিক কোনো শব্দ উচ্চারণে আপনাকে যারপরনাই জ্বালানো যায়, তবে ওটাই করবে।

তাহলে কেন `ওটাই` করবে, এ প্রশ্ন আমাকে করে কোন লাভ নেই। মানুষ জঙ্গল কেটে, জীবজন্তু মেরে, মানুষের পিছনে লেগে, হিংসাহিংসি খাবলা খাবলি করে, যুদ্ধ বাঁধিয়ে, অগণিত প্রাণের হত্যালীলার মতো এমন অনেক নেতিবাচক কাজ করে অকারণই আনন্দ পায়। কেন তা, সে তার প্রবৃত্তিকে প্রশ্ন করো। ধর্ষণের পিছনেও এমনই এক মন কাজ করেই বলে আমার বিশ্বাস। ধর্ষণের পিছনেও এক প্রতিশোধের বাসনা কাজ করে বলে আমার বিশ্বাস, যা অন্যকে নিচে নামিয়ে নিজেকে দানবীয় বিশালতায় উন্নীত করতে চায়। মানুষের মধ্যে কেন এই দানবের বাস, সে প্রশ্ন নিজেকে করো। দানবকে যত প্রতিরোধ করতে চাইবে, যত বের করে দেখাবে তোমার এক একটি ক্ষত, যত বোঝাতে চাইবে কত অনিচ্ছুক তুমি কত অসহায় কত যন্ত্রণাকাতর তত দানবের মরাল আরো স্ট্রং হবে। কারণ সে ওটাই চায়।

বরং একহাত নিতে শেখো। পারলে তাকে সমূলে বিনাশ করো। পারলে তাকে বুঝিয়ে দাও, এ শরীর নশ্বর, যে কোনোদিন বয়ে যাবে ছাই হয়ে। কিন্তু তোমার অন্তরাত্মাকে অপমান করা, তোমার সম্মান নিয়ে খেলা করা এত সহজ নয়। কারণ সে সম্মান তোমার আব্রুতে নেই, সে তোমার শরীর অতিক্রান্ত। পারলে সেই দানবকে এগিয়ে দাও, টোস্ট অ্যান্ড ওয়াইন, বলো, ‘চিয়ার্স’, বলো, ‘কাম অন, লেট আস এনজয়...’

তোমাকে আনন্দ দেয়ার সম্ভাবনাতেই কেবল সে দানবের মৃত্যু হবে, যার জন্ম তোমার ক্ষত থেকে তোমার আর্তনাদের গভীর থেকে যার উত্থান, তোমাকে আঘাত দিয়ে যে জিততে চায়। বুকে তীর লাগা পাখির মতো সেদিন ঝটপট করতে করতে সে এসে পড়বে তোমার পায়ে।

লেখক: কবি