চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৬

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ০৭, ২০১৯

কিছুদিনের মধ্যে নিজের সম্পর্কে একটা নতুন ব্যাপার অনুভব করেছি, তা হলো আমার `ক্লস্ট্রোফোবিয়া` আছে। কবে কখন কোথা থেকে এর শুরু হলো, জানি না। তবে কোনো একটা ক্ষুদ্র পরিসরে, সংকীর্ণ জানলা দরজার ঘেরাটোপে বদ্ধ আকাশহীন চিরঅসবুজ কোনো জায়গায় আটকে পড়ার ভয় আছে আমার, যাকে বলে `ফোবিয়া`। চিরদিন উন্মুক্ত মফস্বলে অনেকটা আকাশ অনেকটা সবুজ নদীর অনেকখানি কাছে হাওয়া বাতাসময় জেগে থাকা আমি, জানি না কখন নিজের ভেতর একখানা হাওয়ামহল গড়ে তুলেছি, যেখানে বড় বড় ঘর উঁচু সিলিং খড়খড়ি দেয়া জানলা খুললেই দিগন্ত এসে ঢুকে পড়ে।

কিছু কিছু মানুষ আছে শুনেছি যাদের ওপর বহির্জগতের প্রভাব কম, তারা আপন অন্তর্জগতে এতটাই বুঁদ হয়ে থাকে যে, কোন পথে চলেছে তাদের খেয়ালই থাকে না। কারণ পথ কাটতে তিনি ব্যস্ত আপন অন্তরে। আমিও আত্মমগ্ন, তবু অতখানি আত্মকেন্দ্রিক নই সম্ভবত। ঘরের দেয়ালের রঙ হলুদ থেকে ঘননীল হলে আমি এক অন্য মানবী হয়ে উঠি, আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি এলে যে আমি সে রোদ্দুরভরা দিনের আমির মতো নয়। এমন আমি, আমার মন, বহির্জগতের বেখেয়ালি স্বভাবের সাথে হামেশা পাল্লা দিয়ে বদলাতে থাকে। আমার মনের ভেতর যে হাজার স্কোয়ার ফুট পেল্লাই ড্রইংরুমখানা একলা পড়ে আছে, তার সাউথফেসিং জানলা দিয়ে আকাশ দেখি আর ভাবি, ওই অনন্ত আকাশটাকে যদি ধারণ করতে পারতাম!

যে কোনো যন্ত্রণাই একটা খাঁচা, যা মানুষকে সীমিত করে দেয়। তার চারপাশে গড়ে ওঠা অদৃশ্য সীমারেখা যেন পৃথিবীকে কেটে টুকরো টুকরো করে, এ পৃথিবী থেকে ও পৃথিবীর দিকে উৎসুক নয়নে চেয়ে থাকা ছাড়া থাকে না আর করার কিছু। আর আনন্দের কেবল আছে বয়ে চলা, সে অপার অপরিসীম শূন্যতার পিয়াসী যাকে ভাগ করা যায় না স্কোয়্যার ফুটের মাপে।

ক্রমশ ছোট হতে থাকি তাই। হাওয়ার থেকেও নির্ভার। পাখির চেয়েও বেশি নিরাভরণ। গোছা গোছা কোমর অবধি চুল কেটে ছোট করে দেই। দুল খুলে রাখি, খুলে রাখি গাছা চুড়ি। নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিতে থাকি। পাছে জায়গা কম পড়ে। আমি যত স্বল্প হই না কেন, জায়গাখানা বড় হওয়া চাই। যেখানে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসা যায়। যেখানে কোনো আরোপ নেই। যেখানে কেউ বলে না, ‘ফিট ইনট্যু দ্য বক্স।’ বরং একটা ঘন লাল কার্পেটের ওপর কফির কাপখানা নামিয়ে রেখে চলে যায়, নীরব সে হাসি। ওই নীরবতা আমার বড় বেশি প্রিয়, যার ভেতর একটা গোটা আকাশ হেসে ওঠে।

এমনটা না হলেই ভয়। এই ভয় আসলে প্রতীকী, যে কোনো জানলা দরজাহীন আকাশহীন সংকীর্ণতায় জীবনের হাতে বন্দি হয়ে থাকার শর্তাধীন পরিণতিকে খুঁজে পায়। যে ভয় অজান্তেই বাসা বেঁধেছিল মনের কোণে, যে হঠাৎ একদিন প্রকাশিত হয় রাক্ষসের মতো। মনে হয় যেন পালাই এক্ষুণি, ভীত সর্পিণীর মতো অরণ্যের কোনো প্রাচীন বৃক্ষমূলে আশ্রয় নেই যেখানে ধ্যানে আছেন সেই সাধুবাবা সহস্র যার আয়ু। এত বড় পৃথিবী থাকতে এত গভীর অরণ্য থাকতে ঝরনার এত জল থাকতে কেন মানুষ ঘর বাঁধে কে জানে? আসলে বৃহতের প্রতিও তার এক ভয় আছে। ভয়কে ছোট করতে করতে তার ঘরখানিও হয়েছে ছোট, আর আরও ছোট হয়েছে সে নিজে।

লিফটের মধ্যেও কেমন একটা দমবন্ধ লাগে আজকাল। এক একটা ঘরে পৃথিবী এক এক রকম। এক একটা পৃথিবীকে এক একটা মানুষ এক এক রকম করে তোলে। আমি সেই ঘরটাই চাই, মেঝের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে যেখানে সূর্যাস্তের ছবি আঁকা যায়। এদিক ওদিক বয়ে যায় রঙ। একটু দূরে মেয়ে আমার ব্যস্ত, ‘তা তা থৈ থৈ’ এ, সদ্য ফোটা মুদ্রায়। কেউ মাথায় হাত রেখে সরে যায় পর্দার আড়ালে। এত বড় ঘর নিজের মধ্যে ধারণ করি বলেই এত একা লাগে। তবু কবিতাকে সামলে নিয়ে চলি। ভেতরের কবিতা আর বাইরের গদ্যে বড় বেশি অমিল হলে নিতে পারিনা। আজকাল লিফটের বদলে সিঁড়ি নিতে ভালোবাসি। ভালোবাসার আরেক নাম? হ্যাঁ, ক্লস্ট্রোফোবিয়া।

লেখক: কবি