চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৭

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ০৯, ২০১৯

‘স্বামী` শব্দটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। এর মধ্যে কেমন এক মাস্টারি মাস্টারি গন্ধ আছে। আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে আমার বরের নামের একটা শর্টফর্ম নির্ধারণ করেছি, যেহতু `বর` শব্দটিও কেমন ন্যাকা ন্যাকা শোনায়, উপরন্তু যে সম্বোধনগুলি আমার কাছে অর্থের যথার্থতার ভিত্তিতে সঠিক লাগে, যেমন `অর্ধাঙ্গ`, `সহযোদ্ধা`, `সাধনসঙ্গী` ইত্যাদি সেগুলি আবার অতিনাটকীয়। তো যাই হোক, সেই শর্ট ফর্মটি হলো `এস.এস`, অনেকটা হলো গিয়ে ওই কলেজের প্রসেফরদের ঢঙে। কলেজের প্রসেফরদের আমার মন্দ লাগতো না, বিশেষ করে যারা সাহিত্য পড়াতেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বেশ রোম্যান্টিক ছিলেন এবং আমার ওপর কোনোদিন তারা কেউ মাস্টারি করেননি। বরং স্কুলের হেডমিসট্রেস হিসেবে কাজ করলে আমার যে উন্নতির সম্ভাবনা আছে প্রভূত সে কথা বলেছিলেন কেউ কেউ।

তো কিছুক্ষণ আগে এস.এস বিশ্ব ইতিহাসের ক্লাস নেয়ার ভঙ্গিতে কীসব বকবক করছিল। আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘জানো আজ নারী দিবস?’ এ কথা বলার সাথে সাথেই সে বেশ থমকে গিয়ে বলল, ‘এইরে, সকাল থেকে তো কোনো নারীর সাথে কথাই বলা হয়নি!’ আমি খচেমচে বললাম, ‘মানে? আমি পুরুষ?’ এ কথায় সে বেশ সঙ্কুচিত হয়ে বলল, ‘ইয়ে... মানে...’ যদিও তার আচরণে ক্রোধান্ধ হলেই সে আমাকে তার একটি করে কুশপুত্তলিকা দাহ করার অধিকার সম্প্রদান করেছে, তবু তার শেষ কথার অসম্পূর্ণ অংশটির কথা ভাবা মাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলার পরিবর্তে আমার ভেতরটা হাসি হাসি হয়ে গেল সেইসব `পুরুষ` ও `পরপুরুষ`দের কথা ভেবে।

একবার একজনকে বলতে শুনেছিলাম, মেয়েদের চারটে চোখ থাকে, মাথার সামনে দুটো মাথার পেছনে আরো দুটো। আমার ধারণা ওটা চারটে নয়, ওটা ছটা। মেয়েরা সব দেখে, দেখতে পায়, যা তার চোখের সামনে ঘটে তা আবার যা তার চোখের পিছনে ঘটে, তাও। এই অদ্ভুত অতিপ্রাকৃতিক অতীন্দ্রিয় শক্তি ঈশ্বর ক’জন পুরুষমানুষের মধ্যে দিয়েছেন, আমার সন্দেহ আছে।

সে যাই হোক, তথাকথিত জীবনের খণ্ডিত সহস্র মুহূর্তে আত্মমগ্নতায় নিজেকেই ভুলে থাকা আমি, কখনো বাস্তবিক কঠিনতায় রে রে করে ওঠা উদ্ধত আমি, অনেক প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা সহসা কলম তুলে নেয়া আমি হামেশাই এ কথা ভুলে যাই যে, আমি তো নারী! চূড়ান্ত লিঙ্গসচেতন না হওয়ার দরুণ আমার বিবেক, আমার বোধ, আমার বুদ্ধি অধিকাংশ সময়েই একজন মানুষের অধিশাস্তায় কথা বলে, ছাল বাকল ছাড়িয়ে নেয়া যে কেবল এক মানুষ। আমার চারপাশে অসম্ভব সফল অথবা ব্যর্থ আরো অজস্র জীবনকেও আমি সেভাবেই দেখি, যা কেবল এক মানুষের।

এইভাবে ক্রমশ নৈর্ব্যক্তিক হতে থাকা আমাকে তবে কারা মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেন, যে আমি নারী, আমি নারীর মতো সুন্দর, আমি প্রেয়সী, আমি চূড়ান্ত কাঙ্ক্ষিত, আমি প্রিয়তমা? সে তো পুরুষের মতো করে আর কেউ নয়!

আজকের দিনটি তাই সেই সকল প্রিয়তমাদের আর তাদের প্রিয়তম পুরুষদের, যারা বেঁচে থাকেন পরস্পরের আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে। আজকের দিনটি কেবল তাই নারীদের নয়, আজকের দিনটি সেই সকল পুরুষদের যাঁদের স্পর্শে যাঁদের কল্পনায় যাঁদের প্রেমে নারী মানবী থেকে তিলোত্তমা হয়ে ওঠেন, তিলোত্তমা থেকে দেবী।

আজকের দিনটি সেই সকল ঝরে যাওয়া মুকুলের দিন, যারা ফুল হতে চেয়ে একদিন শিহরিত হয়েছিল। সেই শিহরণে সরল কিশোরীটিও বুঝেছিলো সেদিন, যে সে আজ প্রথম নারী হলো।

লেখক: কবি