চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৮

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ১২, ২০১৯

স্কুল লাইফে বন্ধুদের সাথে ঝগড়াঝাটির পর পুনরায় ভাব করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ কার হবে, এই নিয়ে হেব্বি চাপে থাকতাম। সত্যি বলতে, ফার্স্ট মুভটা নেয়া খুবই ডিফিকাল্ট ছিল। অপরপক্ষেরও একই সমস্যা হলে অনেক সময় তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতাম। দুজনেই যখন দরজার দুই কোণে দাঁড়িয়ে, যেন কোনোদিনই ভাব করার ইচ্ছে নেই, এমন ভাব করে একজন মাঠের দিকে চেয়ে থাকতো আর আরেকজন নখ খেতে ব্যস্ত, তখন সেই তৃতীয় পক্ষ রীতিমতো ঝুলোঝুলি করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে যে কোনো একপক্ষকে কনভিন্স করে নিতো যে, এই বারের মতো অন্তত ভাব করে নেয়াটা কতই না জরুরি।

এইসব ব্যাপারে অতিরিক্ত সেন্টিমেন্টাল এবং ঈষৎ ত্যাঁড়া হিসেবে আমার একটা সুপরিচিতি ছিল। তবু স্কুলজীবনের এইসব ঝগড়াঝাটির এক অন্য মায়াও ছিল। আমি আবার নিজের রাগ অভিমানের কথা মুখে বলতাম না সচরাচর। প্রিয় বন্ধু হয়তো একটু কম ইমপরট্যান্স দিলো কিংবা কাউকে একটু বেশি, ব্যাস! গোঁজ হয়ে বসে রইলাম আরকি। মুখে কোনো কথা নেই। এদিকে দূরে তাকালেই দেখতাম, বেঞ্চ বিল্ডিং এলোমেলো মেয়েদের দল সবুজ মাঠ সবই কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। বেশ একটা সর্দি সর্দি ভাব হতো সেদিন, বাতাসের ধুলোবালি লেগে।

বাড়িতে ফিরে পড়ার টুলে বই নিয়ে বসেও রাজ্যের অভিযোগ ভিড় করে আসতো মাথায়। চিঠি লেখালিখি ইত্যাদির পর্ব পেরিয়ে অপর পক্ষই একদিন বুড়ো আঙুলটা টেনে নিজের সাথে মিলিয়ে নিতো কিংবা ওই তৃতীয় পক্ষের অংশগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতো। বুক ফেটে গেলেও আমি কোনোদিন কাউকে বলতে পারিনি, আসলে পুনরায় মিটমাটের জন্য আমিই কতখানি উদগ্রীব। এসব না বলতে পারার দায় মাথায় আর হৃদয়ে ধিকিধিকি আগুন নিয়ে বরফের মতো অবিচল হয়ে যেতাম ক্রমশ।

এখন আর সেই ধরনের ঝগড়াঝাটি নেই। ছোট-খাটো জিনিসের হিসেব ফুরিয়েছে। ঔদাসীন্য পা রেখেছে রোদে মোড়া বারান্দায়। বদলেছে প্রায়োরিটি লিস্ট, প্রয়োজনীয়তার মাত্রা, অধিকার বোধের ধরণ। কে কাকে বেশি পাত্তা দিলো এইসব ভাবার ঠুনকো মেজাজও আর নেই। তবু কাছের মানুষটি জানে সম্ভবত, মানুষ খুব বেশি বদলায় না। ভেতরে ভেতরে সে তেমনই থাকে যেমন সে ছিল, বদলে যায় শুধু বাইরে নিজেকে প্রকাশিত করার কিংবা অপ্রকাশিত রাখার তাগিদ।

এখনো সেই স্বপ্নের বারান্দায় দাঁড়াই যখন একা, দূর থেকে দেখি হাত ধরাধরি করে কেমন ভেসে চলে গেল সেই বন্ধুটি যার সাথে কথা নেই তিনদিন, সে কেমন হেসে হেসে ঢলে পড়ে আরেকটির কাঁধে। বুকের ভেতর কেমন চিনচিন করে তখন। পা বাড়াতে গিয়ে দেখি, কে যেন পা দুটি টেনে ধরে আছে মাটির ভেতর। ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে দেখি, কোথায় সেই বারান্দা? নেই কোনো তৃতীয় পক্ষ। ভাব তবে হবে নাকি আর? বিচ্ছেদই বা কই? যা আছে সে কেবল ভেঙে যাওয়া। ব্যথা আছে, তবে সে ব্যথা অন্য কিছুর।

ফেলে আসা দিন স্বপ্নের মতো বোধ হয়।