চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৯

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০১৯

গাছতলার মায়েদের কথা মনে পড়ে, সারাবছর বিভিন্ন অনুষঙ্গে যারা কৃষ্ণচূড়ার বেদীর কাছে জড়ো হতো, পরস্পরকে নাম ধরে ডাকাডাকি হাসাহাসি গসিপ করতো, আর ছুটির ঘণ্টা বাজলেই দূর থেকে যে যার মেয়েকে চিনে নিয়ে ছুটে যেত পরীক্ষা কেমন হলো জানতে। কত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা সেসব জীবনের! মার্কস কম এলে কারো কারো স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়েই জুটতো কানমলা।

সেসব অনেক পুরনো কথা। কখনো কোনো কোনো মায়ে মায়ে খুব জমতো। সময় এমন করেই মানুষের সাথে মানুষের সখ্য ঘটায়, আবার সময় বুঝে বিস্মৃতি। কিছু মা আরো কিছু মা এমন করে মায়েদের দল তৈরি হতো। জন্মদিনের ঘরোয়া উৎসবে মা সমেত মেয়েদের নিমন্ত্রণ থাকতো। কখনো কখনো মায়েরা মিলে কোনো এক মায়ের বাড়িতে যেসময় বাবা অফিসে মেয়ে স্কুলে এমন একটা সময় দেখে ফিস্ট করতো। সেই ফিস্টে যোগ দিতো স্কুল ফিরতি বাচ্চারা, মানে আমরাও। মনে আছে, এমনই এক মায়ের বাড়িতে তিনতলায় একটা দোলনা ছিল, যেখানে দুলতে ভালোবাসা আমি, সেই ছোটবেলার একদিন খবর পেয়েছিলাম কাকিমা আর নেই! সে সময় `আত্মহনন` এর যথার্থ অর্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। একথা বুঝতে আরো দেরি হয়েছিল ভালোবেসে গাঢ়তর আঘাত পেলে মনুষ্যমন তীব্র সংবেদে প্রয়োজনীয় মেরামতির সাধ্যাতীত বদলে যায়।

অনেক রকম মা দেখেছি তথা অনেক রকম মানুষ। কোনো কোনো মা আমাকে খুব ভালোবাসতো, স্কুলের গেটে দেখা হলেই গাল টিপে দিতো। কারো কারো বাড়ি গেলে তার মা যত্ন করে রেঁধে বেড়ে খাওয়াতো। কোনো কোনো মা এখনো আমাকে খুব ভালোবাসে। এই পক্ষপাতিত্বে লজ্জিত হলেও কিছু করার থাকে না। কোনো কোনো মা ভিড়ের মধ্যে সহসা দেখা হলেও সকলকে অপ্রতিভ করে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এসব পাওয়ার মতো আমি কিছু করিনি। আমাকে ভালোবাসা কঠিন, ভালো না বাসাও।

এসব কথা কেন বলছি? বলছি কারণ, সময় কিভাবে সব মুছে দিতে দিতে চলেছে স্পষ্ট দেখছি। সেই সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি আমার মেয়ের প্রিয় বান্ধবীকে, দুটিতে হাত ধরাধরি করে স্কুল থেকে বেরোবে যে সেই সময় আগত। বদলে যাচ্ছে মাঠ, স্কুলবিল্ডিং, নীলবাসের ভাইদের নাম। একটা মহাস্রোত আসছে আবার ফিরে যাচ্ছে, ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদেরও।

তবু যতদিন আছি, মনে হয় এই বেঁচে থাকা বুঝি অশেষ। আমরা কেউই কারোর থেকে আলাদা নয়, অথচ ভীষণভাবে আলাদা এই বেঁচে থাকা। সময়ের যায় আসে না কিছুই। আমরা কেবল সেতু বন্ধনের কাজটুকু করছি একটি স্রোত ফিরে গিয়ে অপরটি আসা অবধি। একটি শূন্যতা থেকে পরের শূন্যতা কেবল প্রাণ দিয়ে জুড়ে আছে।