চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ১১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ২৮, ২০১৯

সময়টা আশির দশক। হাত ধরাধরি করে আমরা একদল পড়ুয়া বাসে কিংবা ভ্যানে চড়ে যেতাম ইস্কুলে। নার্সারি থেকে দশম শ্রেণি অবধি ছিল তখন। সরকারি স্কুল। সেটিকে বারো ক্লাস অবধি প্রসারিত করার মনোনয়ন চলছিল। আমারই এলাকার কিংবা আশপাশের আমারই বয়সী কিংবা খানিক ছোট অথবা বড় তারাও ছিল বেশিরভাগই কোনো না কোনো সরকারি স্কুলের ছাত্র। সেসব স্কুল ছিল প্রায় অবৈতনিক। পাঠ্যবইয়ের প্রধান অংশটি স্কুল তথা সরকারই দিতেন। এর বাইরে যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী রেফারেন্স বইয়ের সাহায্য নিতো। সরকারি পাঠক্রমের ভুলত্রুটি থাকলেও আমাদের মতো সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা যাদের বাবা মায়ের সাধ্য ছিল না অনেক বেতন দিয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর, তারা একদম উচ্চমাধ্যমিক অবধি অতি সুলভে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের স্নেহধন্য হয়ে এই যে বৈতরণী পার করতে পেরেছিল তাতে তৎকালীন সরকারের একটা ভূমিকা ছিল বৈকি।

আমি যেবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেই, সে বছর রাজ্যে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল `ইতি` বলে একটি মেয়ে। কলকাতা রবীন্দ্রসদনে সেবছর মাধ্যমিকের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের ফেলিশিটেশন হয়েছিল যেদিন, একই মঞ্চে ছিলাম আমি ও ইতি। ইতির হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে আপ্লুত হতে দেখেছিলাম তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে। কারণ অনেক দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেও ইতি একজন কৃতী ছাত্রী হিসেবে তার পরিবার ও স্কুলের নাম উজ্জ্বল করেছিল। ইতির মতো উঠে এসেছিলো আরো নক্ষত্রেরা, আর্থিক বাধা অন্তত যাদের স্কুল শিক্ষাটুকু ভালোভাবে শেষ হওয়া থেকে বিরত করেনি। কারণ, সেইসময় সরকারি স্কুলগুলিতে সেই সুযোগ ও সাহায্যটুকু পাওয়া যেত।

এর আরো অনেক বছর পরে সিঙ্গুর নন্দী গ্রামের কৃষক উচ্ছেদ তথা তৎকালীন সরকারের ভূমিকায় বেশ নড়েচড়ে বসেছিলাম আমরা, যারা তখন কলেজে টলেজে পড়ি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে `নরখাদক` ইত্যাদি বিশেষণে ভূলুণ্ঠিত করে এই আমরাই নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে ছুটেছিলাম। বেশ ক`জন বন্ধুর সাথে আমি তখন বাঙলা স্টেটসম্যানের অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতাম আমাদের প্রতিবাদের ভাষাকে কাগজের অক্ষরে ফুটিয়ে তোলার দাবিতে। সেসময় একদিন স্টেটসম্যানের সম্পাদক আমাদের তাঁর চেম্বারে ডেকে বলেছিলেন, "তোমরা বিষয়টা কতটুকু বোঝো? নিজেরা সিঙ্গুরে গেছো কোনোদিন? কথা বলেছো কৃষকদের সাথে? একদিন নিজেরা যাও।” তার কথাকে অবশ্যই আমরা ভালোভাবে নেইনি সেদিন, কারণ মিডিয়ার বিতরণ করা তথ্যে সেইসব বছর কুড়ির তরুণ তরুণীদের যথেষ্ট ভরসা ছিল, তাদের বোধগম্যতার মধ্যে এ তথ্য তখনো রেজিস্ট্রার করেনি যে, বেশিরভাগ মিডিয়াই আসলে কোনো না কোনো শক্তির দালাল, কখনো তা সরকারের কখনো বা বিরোধীর, তার অতিরিক্ত গভীরতর সত্যকে তুলে ধরার কোনো দায় তাদের নেই।

কত ধানে কত চাল বুঝতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল অনেক। তার মধ্যে একে একে কাজ খুঁজতে রাজ্য ছাড়া হয়ে গেল প্রায় আমার সকল বন্ধু, কারণ চা বা চপশিল্পটা ঠিক সবার দ্বারা হলো না। অমীমাংসিত অবস্থায় ভূতগ্রস্ত হয়ে পড়ে রইল সিঙ্গুরের অধিকৃত জমি। না হলো কারখানা না হলো ধানচাষ।

কাজেই আজকের যুবক যুবতীদের এই অনশন এই দাবি দাওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চারপাশটা তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, চোখকান একটু খোলা রাখলেই বোঝা যায়, যে রাস্তায় ধর্ণা দেয়ার মতো কারণ এক নয় অনেক। সরকারি স্কুলগুলো প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে। স্কুলছুটের সংখ্যা অকল্পনীয়। এক একটি সরকারি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা নাকি পঞ্চাশ একশোয় এসে দাঁড়িয়েছে। স্কুলে নিয়োগ হচ্ছে না নতুন শিক্ষক। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের রাজ্যভিত্তিক পরীক্ষাটিও নাকি উঠে যেতে বসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার জন্য নিযুক্ত হচ্ছেন সামান্য বেতনের পরিবর্তে মিনিমাম গ্র্যাজুয়েট পার্টটাইম কনট্র্যাকচুয়াল শিক্ষক। কেমন হবে এই অধুনা শিক্ষকতার মান তা সহজেই অনুমেয়! মাঝখান থেকে ফুলে ফেঁপে উঠছে পাড়ার মোড়ে মোড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বেসরকারি স্কুলগুলো। যে জাতির কোনো শিক্ষানীতি নেই তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। যেখানে শিক্ষার পরিকাঠামোটি ভেঙে যেতে বসেছে কাঁচা বাঁশের মাচার মতো, সেখানে পাড়ার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান আর চপের দোকানের বাড়বাড়ন্ত যে হবেই তা বলাই বাহুল্য, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে জেলুসিল আর অ্যান্টাসিডের দাম।

আজকের দিনে আমাদের মতো সাধারণ বাবা মায়ের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে ভেবে শঙ্কা হয়। ইতির মতো মেয়েরা কিংবা আরো অনেক গরিব মানুষ যারা হয়তো ভ্যান টানেন, দিনমজুরের কাজ করেন, সবজি বিক্রি করেন, মিস্ত্রির কাজ করেন, বা যেকোনো মেহনত করে কোনোভাবে দিন চালান, তাদের সম্ভাবনাময় সন্তানেরা কোথায় যাবে? সেসব সন্তানেরা কি কোথাও কোনো মঞ্চে গিয়ে দাঁড়াবে আর? তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে গিয়ে আপ্লুত হবেন কি আর কোনো বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি? নাকি স্কুল ছুটের দলে হতাশায় অন্ধকারে তলিয়ে যাবে এক একটি সম্ভাবনা একটু শক্তি পেলে যে ঝলমল করে উঠতে পারতো অগণিত নক্ষত্রের ভিড়ে?

লেখক: কবি