চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ১২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : এপ্রিল ০৭, ২০১৯

ছোটবেলায় ওর দুটো প্রিয় গরু ছিল। একজনের নাম জ্যাগোব্যাগো, আরেকজনের মুনু। জ্যাগোব্যাগোর সাথে খাতির ছিল বেশি। কলির কেষ্ট নাকি ওর পিঠের ওপরেই শুয়ে থাকতো সারাদিন। বাছুরদের দলে মিশে দুধ খেত। জ্যাগোব্যাগোকে খোল ভুষি এসব খেতে দেয়া হলে বাছাধনের ভালো লাগতো না মোটেও। লুকিয়ে লুকিয়ে হেঁসেল থেকে হাঁড়িসমেত ভাত এনে খাইয়ে দিতো। জ্যাগোব্যাগো সবাইকেই গুঁতিয়ে দিতো, কেবল আমাদের গোপালকে ছাড়া। সে যখন খেলাধুলো সেরে ঘরে ফিরতো সন্ধ্যাবেলা, পাড়ার মোড় অবধি এসে পৌঁছলেই নাকি জ্যাগোব্যাগো তার গন্ধ পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করতো। এইসব গপ্পগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেলেও, দশ বছরের সম্পক্কে হেন এমন দিন নেই যেদিন অন্তত একবার আমাকে চোখ গোল গোল করে যেন প্রথম শুনছি এমন ভান করে যেন শুনে কতই না পুলকিত হচ্ছি এমন হাসি হাসি মুখ করে এই গল্পগুলো শুনতে হয়নি। কি আর করবো! বাবু এতেই খুশি। আর শত হোক, জ্যাগোব্যাগো আর যাই হোক আমার সতীন তো নয়!

তো বাবুর এখনও ইচ্ছে একখানি গরু পোষার। তা গরুখানি বাঁধা হবে কোথায়? এখন তো আর বাড়িতে গোয়াল ঘর নেই। শুনলাম তার স্থান নাকি হবে বাড়ির ছাদে। সে গরুকে নাকি গয়নাগাটি পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হবে ক্যালেন্ডারের মতো। শুনে তো আমি ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কিন্তু সে গরু ঘাস পাবে কোথায়? তার জন্য নাকি ছাদ থেকে মাঠ অবধি একখানি সিঁড়ি নামানো হবে, যেমন সিঁড়ি দিয়ে মহাকাশযান থেকে মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে নেমে আসে, তেমন একখান। ঘাসটাস খেয়ে সে আবার সিঁড়ি দিয়ে সটান মাথার ওপর চলে আসবে জাবর কাটতে!

আবার ক’দিন আগে শুনলাম ছাদ নয়, তাকে বাঁধা হবে বাগানে আমগাছের সাথে। সে বাগানে মুলোটা বেগুনটা চাষ করছে যে আজকাল সেই নাকি তার দেখভাল করবে। শুনে বিশ্বাস হলো না। বিশ্বাস না হলেই বা কি? অবিশ্বাস্য বলে কিছু আছে নাকি? ওরই গোবরে নাকি জমি আরো ঊর্বর হবে। সারটার লাগবে না। আর সবথেকে বড় কথা হলো, এতে নাকি গরুর মালিকের জীবনের সব স্ট্রেস উধাও হয়ে যাবে। ছোটবেলায় রচনা লিখতাম বটে, গরু এক অতি উপকারী গৃহপালিত প্রাণী। তার মাথার শিং থেকে মলমূত্র অবধি অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। এখন জানছি, স্ট্রেস নামক ভয়ংকর ব্যাধি সারাতেও নাকি গরুর কোনো বিকল্প নেই!

সারা পৃথিবীর গরুদের সব খবর ওনার নখদর্পণে। কোথায় কোন গরুটা কোন বাড়ির বুড়িকে গুঁতিয়েছে, কোথায় কোন গরু ঘাস খেতে বেরিয়ে রোদ্দুরে শুকোতে দেয়া শাড়ি শিং দিয়ে খুঁচিয়ে ছিঁড়ে দিলো, কে আবার সক্কাল সক্কাল চায়ের দোকানের কাস্টমারদের ভয় দেখিয়ে পাউরুটি আত্মসাৎ করে পালিয়েছে, এসব রসিয়ে রসিয়ে বলতে উনি কাব্যপাঠের মতোই তৃপ্তি পান মনে হয়। রাস্তাঘাটে সাদা কালো তামাটে রঙের গরু একখানা দেখলেই হলো। আমাকে যেকোনো অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রেখে উনি তার গায়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে চলে যান। এসব দেখেশুনেও আমি আকাশের দিকে মুখ করে রয়ে যাই। কি আর করবো? আরে শত হোক, গরু তো, আমার সতীন তো নয়!

আমার আড়াই বছরের কন্যাও এখন শেয়ানা হয়ে গেছে। কথা বলতে শেখার পরই তার প্রশ্ন, ‘বাবা, জ্যাগোব্যাগো কে?’ যাই হোক, এখন সে বুঝে গেছে, জ্যাগোব্যাগো তার ভাই বোন নয়, একখানি গরুর নাম। তার বাবা মোবাইল থেকে দেশি-বিদেশি নানারকম গরুর ছবি বের করে তাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, কেমন? মেয়ে আমার সাথে সাথে উত্তর দেয়, খুব ছুন্দর।

জন্মদিনে হ্যাপি নিউ ইয়ারে আমার কাজ হলো, নেট থেকে ঘেঁটে ঘেঁটে সুন্দর সুন্দর গরুর ছবি বের করে ওনাকে উপহার দেয়া। কারণ এই সামান্য উপহারে উনি যত খুশি হবেন ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় ঘড়ি বা পারফিউমে উনি তার অর্ধেকও হবেন না। সত্যি পৃথিবীতে কতরকম মানুষই না আছে! এই যেমন হরিদ্বারে বেড়াতে গিয়ে উনি আমাকে গঙ্গার ধারে একা একা দাঁড় করিয়ে রেখে ক্যামেরাটা নিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। ফিরে এসে একগাল হাসি নিয়ে বললেন, এই দেখো কত ছবি তুলেছি! আমি অবাক হয়ে দেখি, আকাশ বাতাস নদী কিছুই নয়, ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হয়েছে একখানি সাদা গরু, ইয়া বড় বড় শিং। আমার হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে খুব উচ্ছ্বাসের সাথে উনি বললেন, চলো তোমার সাথেও দুটো তুলে দিই। আমি খপাৎ করে ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে বললাম, ভালো চাও তো চলো এখান থেকে, এক্ষুনি!

লেখক: কবি