চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ১৩

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৬, ২০১৯

মুভির নাম `রোমিও আকবর ওয়াল্টার`। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি এই সিনেমায় ভারতের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট রোমিওকে পাকিস্তানের নাগরিক সাজিয়ে আকবর নাম দিয়ে ওখানকার এক হোটেলে কাজ করতে পাঠায় `সিক্রেট এজেন্ট` হয়ে গোপন খবর সরবরাহের জন্য। ঐ হোটেলেই আকবরের সাথে আলাপ হয় আফ্রিদির, যে পাকিস্তানে গোপন অস্ত্র পাচার সংস্থার হেড। আফ্রিদির নিজের ছেলে তাকে খুন করতে চায়। এই সুযোগে আকবর আফ্রিদির ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এবং সব খবর ভারতকে দিতে থাকে। এর মধ্যে আকবর তথা রোমিওর ভারতীয় প্রেমিকা, যেও নাকি ইন্ডিয়ান আর্মির এজেন্ট, পাকিস্তানে এসে হাজির হয়। তাকে দেখে আকবর একটু নরম হয়ে যায় বৈকি। নিজের দেশে রেখে আসা মার কথাও মনে পড়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্সের হাতে সে ধরা পড়ে। এদিকে ভারতও তার মাথার ওপর থেকে হাত তুলে নেয়। এহেন অবস্থায় আকবর পাকিস্তান হাইকমিশনের কাছে আত্মসমর্পণ করে জানায়, সে নিজেই প্লেন চালিয়ে বিশ্বাসঘাতক ভারতের ওপর বোম ফেলতে চায়। পাকিস্তানের বোকা অফিসাররা সেটা বিশ্বাসও করে। যথাসময়ে ভারতের ওপর বোমা ফেলে আকবর পাকিস্তানের হাইকমিশনে স্থায়ী জায়গা বানিয়ে নেয়।
তার নতুন নাম হয় ওয়াল্টার খান। প্রথম দিকে এসবই তার নিজের আত্মরক্ষার স্বার্থে করা বলে মনে হলেও সিনেমার শেষে জানা যায়, এসবই আসলে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স সংস্থার চিফের নির্দেশে করেছে সে, নিজের সব কিছু বাজি রেখে, এমনকি মায়ের কবরে মাটিটুকুও দিতে পারেনি, শুধু পাকিস্তানের সব গোপন খবর ভারতকে সাপ্লাই দেবে বলে! আপাত দৃষ্টিতে এই গাঁজাখুরি স্ক্রিপ্টটা কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া মেঘনা গুলজার নির্দেশিত `রাজি`র দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে হলেও গল্পের ভেতরেও আরো অনেক গল্প থাকে। থাকে না?

আমাদেরই সামনের সিটে বসে থাকা এক কাপল গোটা সিনেমা চলাকালীন একটি মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকায়, বিশেষ করে অন্ধকার হলে বারবার মোবাইল স্ক্রিনের আলো ঝলসে ওঠায় যারপরনাই বিরক্ত হচ্ছিলাম। কারণ খাজা সিনেমাও আমি খুব মন দিয়ে দেখি। সে যাই হোক, ইন্ট্যারভ্যালে চায়ের কাপটা নিয়ে সিটে এসে বসেছি সবে, ওমা শুনি দুটির মধ্যে হেব্বি ঝগড়া হচ্ছে। মেয়েটির হাতে জ্বলজ্বল করছে একটি মোবাইল, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খোলা ফেসবুক মেসেন্জারের পাতা। মেয়েটি ওটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে ছেলেটিকে বলছে, ‘তুমি এইসব করো? তোমার নাকি আমার সাথে কথা বলার সময় হয় না! আর ফেসবুকে মেয়েদের এই সব বলো? ফুলশয্যার কথা?’

ছেলেটি এটা ওটা বলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেও ঝড়ের মুখে ঝরাপাতার মতো উড়ে যাচ্ছে। মেয়েটি বলে চলেছে, ‘তুমি আবার ভদ্রলোকের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াও? এইসব কথা লেখো তুমি মেয়েদের?’ ছেলেটি এতক্ষণে রুমাল দিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলেছে, মাঝে মাঝে ফাঁক-ফোকর দিয়ে দু’একটা কথা বলার চেষ্টা করে চলেছে। সে মেয়েটিকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে, সে তাকে আঘাত দেবে বলে কিছুই করেনি, ইনফ্যাক্ট সে তাকে আঘাত দেয়ার কথা ভাবতেই পারে না! আসলে সে খানিকটা মজবুর হয়েই এসব লিখে ফেলেছে! তার থেকেও বড় কথা হলো, সে যাকে যাই বলে বা লিখে ফেলে থাকুক না কেন আসলে তো সে একজনকেই ভালোবাসে!

এদিকে মেয়েটিও বলেই চলেছে, ছেলেটির দু’একটি অক্ষম অনুনয়ের দৃষ্টান্তে তার রাগ বেড়েই চলেছে ক্রমে, ‘এই যে, ওদিকে মুখ করে আছো কেন? শোনও আমি তোমাকেই বলছি... এবার সেই মোক্ষম প্রশ্ন, বলো তো, আমি যদি এরকম করতাম?’ ভাবছিলাম মেয়েটিকে একটু শান্ত হতে বলি, কিন্তু তার আগেই যে হল অন্ধকার হয়ে গিয়ে শুরু হলো আকবর আর তার প্রেমিকার চুম্বনদৃশ্য, যে প্রেমিকাকে আসলে ইন্ডিয়ান আর্মি পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল প্রেমের জাল বুনে আকবরের ওপর নজরদারি চালাতে আর বেগতিক দেখলেই তাকে খালাস করে দিতে!

তাই বলে বছরের প্রথম দিনেই এমন কাণ্ড! ফেরার পথে ভাবছিলাম, শো ভাঙার পর ছেলেটি আর মেয়েটির মধ্যে কি হলো! ছেলেটি কি সপাটে চড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে বসলো কোন ম্রিয়মাণ আলোর নীচে? আর দূরে মিলিয়ে যাওয়া মেয়েটি বাসের জানালার ধারের সিটটি ঘেঁষে বসে আঙুলে বুলিয়ে নিলো বুঝি দুচার ফোঁটা নোনতা জল, বিশ্বাস ভঙ্গের? বিশ্বাস! সে বড় আজব জিনিস।

এপ্রসঙ্গ তুলতেই সুদীপ্ত হেসে বললো, না না এতক্ষণে দুজনের মিল হয়ে গেছে। আমি অবাক নয়নে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও প্রাজ্ঞ, স্থির কণ্ঠে বলে উঠলো, কি হলো? আমি নভিস, একটু মাথা চুলকে একটু থেমে আস্তে আস্তে বললাম, না না। কি আবার হবে? ইউ আর অ্যাবসোলিউটলি রাইট!