চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ১৮

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ০১, ২০১৯

এক,
ভোর ছটা বাজতে না বাজতেই পাশের লোকটা টেলিভিশন অন করে দিয়েছে। একটানা একঘেয়ে শব্দে আমার মাথা ব্যথা হয়। সাউন্ড অ্যালার্জি। মাঝে মাঝে ফেসবুক খুলে দেখি জনমানসে উষ্মার ছোঁয়া। তারপর বারান্দায়। আগে বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকখানি গঙ্গা দেখা যেতো। এখন জেলেপাড়ার টালির চালঅলা নিচু বাড়িগুলো একে একে দোতলা অবধি উঠে গেছে, এই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। প্রধানমন্ত্রী যোজনা। চোখ তাই আকাশনদীকে ছুঁতে চায়।

পাড়ার বাচ্চাগুলো মটকা কুলফি নিয়ে অকারণ হইচইয়ে মত্ত। পাশের মন্দিরে দমাদম ঢাক বাজছে আজ। উল্টো দিকের সদ্য দোতলা ওঠা বাড়ির একতলার দাওয়ায় বসা বুড়ি দেখি চেয়ে আছে আমাদের বাড়ির বেলগাছটার দিকে। তার দৃষ্টি বরাবর অনুসরণ করে দেখি, ঝড়ে উড়ে আসা লাল ঝাণ্ডা লটকে আছে গাছের ডালে।

ফোকলা দাঁতে হাসে বুড়ি। সে টের পেয়েছে মনে হয় আমি তাকে দেখছি। তারপর তর্জনি উঁচু করে আমাকে কী যেন দেখায়। কী দেখাচ্ছে বুড়ি? ঢপ করে শব্দ হয়। পাকা বেল পড়ার শব্দ। এবার আমিও হেসে উঠি।

দুই.
সেতু,
দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলি তুই। আজ তোর তিন বছর পূর্ণ হবে। এমন ভাবেই আরো বড় হয়ে যাবি একদিন। বুঝতে পারবি জীবনের পথটা উভমুখী নয়। একবার বড় হয়ে গেলে আর ছোটটি হওয়া যায় না। হওয়ার দরকারই বা কি? জীবনের প্রতিটি অধ্যায় তার নিজের মতো করে অর্থবহ। চিরকালীন নয় যে কিছুই।

ভাবছি আজকের দিনটায় তোর জন্য কি চাইবো? আলাদা করে কিই বা চাওয়ার আছে, রোজকার চাওয়ার বাইরে? তোর জন্য আমার চাওয়া তেমনই যেমন সকল মায়েরা চায়। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট হয় না আমার কাছে। এই যেমন অনেক মায়েদেরই বলতে শুনি, ‘শুধু এইটুকুই চাই সন্তান যেন ভালো মানুষ হয়।’ চাওয়া যদি সত্যিই অতটুকু হতো রে! ওই টুকু চাওয়ার মধ্যেই তাদের সকল চাওয়া নিহিত থাকে। অর্থাৎ সে সন্তান হোক তাদের প্রতি ভালো, দেশ ও দশের প্রতি ভালো। এ চাওয়া কি কম চাওয়া হলো, বল?

সেতু, এই পৃথিবীটা ততটাও খারাপ নয় যতখানি খারাপ করে তাকে ভাবা হয়। সব মানুষগুলো রাক্ষস নয়। আবার দেবতাও নয় তারা। পৃথিবীটা ততখানি সুন্দরও নয় যতখানি সে প্রতিভাত হয় ছবিতে। কিংবা তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। তাকে ততখানি সুন্দর বা অসুন্দর ভাবেই গ্রহণ করতে শিখিস যতখানি তোর হৃদয়ের অনুভব তোকে সত্যের কাছে অবনত হতে শেখায়। সেতু, ভালো মানুষ কাকে বলে আমি জানি না। পারলে একজন খাঁটি মানুষ হোস।

এ সমাজ তোকে তার মতো করেই গড়ে পিটে নিতে চাইবে জানি। এসবের মাঝে কোনো মা-ই চায় না, যে বাচ্চাটা তার কষ্ট পাক। কিন্তু এও আমি জানি, সব কষ্টের থাবা থেকে তোকে ঠোঁটে করে তুলে সরিয়ে নেয়ার ক্ষমতা হয়তো আমার নেই। কারোরই থাকে না। তাই কোনো মিথ্যে পৃথিবীতে মিথ্যের চাদরের তলায় তুই বড় হ, আমি তা চাই না। এই পৃথিবীকে চোখ মেলে দেখিস। সুখ মানুষকে আরাম দেয়। আর বেদনা তাকে উত্তীর্ণ করে। সুখে দুঃখে সমান সাবলীল হওয়ার মতো শক্তি হোক তোর এই কামনা করি।

আরো কত কিছুই বলতে ইচ্ছে করে তোকে। সময়ে অসময়ে সেসব কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। আসলে আমি তো এমনই। আশপাশের লোকজন ভাবে, এ মানুষ কেমন মানুষ তবে! অন্যের তৈরি করে দেয়া সংজ্ঞায় এ কেমন বিচিত্র মানুষ আমি সত্যিই জানি না। অনেক কিছুই ভুলে যাই। ভুলে থাকতে ভালোবাসি। তুইও বিচিত্র হবি জানি। প্রশাখাময় তুইও এক মহীরূহ হয়ে ওঠ সেতু।

অনেক পাখি এসে বসুক তোর ডালে। ফুলে ফলে ন্যুব্জ হ। ঝড় বাদলে দৃঢ়। আমি আছি। আমি এই জানলাটির পাশে বসে তোকে দেখবো আজীবন। খাঁচাটির বাইরে এই অপার করুণাময় পৃথিবীর আলোয় হাওয়ায় জলে তুই চিরস্বাধীন বেড়ে ওঠ। তোর কোনো সীমা নেই, এটুকুই তুই জানিস চিরটাকাল।

আমার মধ্যে যে সকল প্রেমিক ভালোবাসায় সন্দিগ্ধ অস্থির থেকে গেছে চিরটাকাল, তাদের মধ্যে সেরাটি তোর প্রেমে জন্ম নিয়েছে। সে তোর সাথে চলতে চায়। তোকেই স্পর্শ করতে চায়। কিন্তু তোকে বাঁধতে চায় না, কেবল স্নেহের অদৃশ্য রশ্মিটি ছাড়া। ভালো থাক সেতু। সেই তো আমার ভালো থাকার কারণ। অপার ভালোবাসা।

লেখক: কবি