চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০১৯

পাশে খুকি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে নড়িয়া উঠিলাম। আকাশ আর নদীর সঙ্গমস্থল হইতে রাশি রাশি আলো মেঘের বক্ষ চিড়িয়া আমার গৃহের চারিপাশ বেষ্টন করিতে উন্মুখ যেন। হঠাৎ মনে হইলো, সমগ্র পৃথিবী বৃষ্টির জলে সিঞ্চিত হইতেছে যেন, নবযৌবনা হইতেছে। অথচ আমি এত শুষ্ক কেন? কোথায় এতটুকু বৃষ্টির জল ঝরে পড়িতেছে না কেন আমার উপর? এই গৃহ এক রক্ষা কবচের মতো এই পৃথিবীর সকল দুর্গম অথচ আশ্চর্য সুন্দর হইতে আমাকে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে বলিয়া মনে হইলো।

এমন সব ভাবিতে ভাবিতে দেখি, এক অদ্ভুত আলোর রেখা এক জানালা থেকে অপর জানালা স্পর্শ করিয়া অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। ইহা কি করিয়া সম্ভব? বহির্জগতের বিদ্যুত তরঙ্গ তবে কি বায়ুস্তর মারফৎ আমার গৃহের অন্দরে বাহিত হইতেছে? গোটা ঘরখানি কি তবে এক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে পরিণত হইতেছে, যার ভেতরে থাকিলে অচিরেই আমরা ভস্মীভূত হইবো? কিয়ৎক্ষণ ঐ আলোর পানে চাহিয়া অকস্মাৎ খুকির জন্য মন কেমন করিয়া উঠিলো। নিদ্রায় ডুবিয়া থাকা তিন বৎসরের বালিকা কতটুকুই বা জানে এই পৃথিবীর রহস্য কথা!

মনে পড়িল, বারান্দায় দেওয়া তাহার পোশাক গুলি এতক্ষণে বোধহয় ভিজে চুবুচুবু হইলো। ছুটিয়া গিয়া সেইগুলি ঘরে আনিলাম। তারপর ভাবিলাম, আহা এই বৃষ্টিতে ভিজিলে কি বা ক্ষতি? নিঃশব্দে দরজা খুলিয়া ছাদে যাইতেই বিপুল পরিমাণ জলরাশি আমার কেশ সিক্ত করিল। চোখের তলে বৃষ্টিফোঁটা ধারণ করিয়া মনে হইলো কোন সুদূর সমুদ্রের জল যেন কত পথ পার করিয়া আজ বৃষ্টির রূপ ধরিয়া আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত। আমি পবিত্র হইলাম।

খুকির বাবা কার্যে বাহির হইয়াছে। বাহিরের বৃষ্টি অন্তরে আসিয়া ঝরিতেছে যখন মনে হইলো তাহার সীমানাতেও এমন বৃষ্টি হইতেছে কিনা। সেই বিপুল বর্ষণ ভেদ করিয়া সে কি পথ চলিতেছে যেন কোনো একক অশ্বারোহী? এই কথা ভাবিতেই মনের ভেতর বৃষ্টিপাতের শব্দ ভেদ করিয়া অশ্বক্ষুরের শব্দ শ্রুত হইলো।

এই ভাবেই কোনো কোনো দিন কোনো কোনো ক্ষণ সহসা বজ্রপাতের শব্দ আমাকে বিস্মৃত হইতে দেয় না আমি কোন সুদূর পর্বতমালা হইতে নিদ্রার ভেতর বহিয়া আসিয়াছিলাম। আমার যে এই মিথ্যা জাগরণ খুকির পাশে অন্তহীন অপেক্ষায় তাহা কেবল ফিরিয়া যাইবার। বৃষ্টিপাতের শব্দ আমাকে বিস্মৃত হইতে দেয় না পর্বতের শরীর স্পর্শ করিয়া অবিচল যে সমুদ্র তাহার বড় নিকটে আমার ফিরিয়া যাইবার সময় আসন্ন।

বৃষ্টির ভেতর আমি সেই ঘণ্টাধ্বনি শুনিতে পাই। ঢং ঢং। আমার শরীরের অন্দরে জল। আমার শরীরের বাহিরে জল। কেবল শুষ্ক এক প্রাচীর প্রমাণ শরীর। খুকীটিকে দূরে একটু উচ্চতায় আড়াল দিয়া ঘুম পাড়াইয়া রাখি। তাহার এখনো এত কিছু জানার সময় হইয়াছে কি? চলবে