চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২৪

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০১৯

একটি মেয়ে একবার আমার একটি কবিতা ঝেপে আমার নাম উল্লেখ না করেই তার প্রোফাইলে সাঁটিয়েছিল। বিষয়টা আমার নজরে এলো। দেখলাম কবিতার নিচে এক ভদ্রলোক বারবার জানতে চাইছেন, ‘ভীষণ ভালো কবিতাটি, কার লেখা?’ মেয়েটি আমার পরিচিত এবং জেনেশুনেই আমার কবিতাটি ঝেপেছিল। আমি নিঃশব্দে খেয়াল করতে থাকলাম, মেয়েটি প্রশ্নকর্তার জিজ্ঞাসাকে এড়িয়ে যাচ্ছে এই বলে, ‘কী জানি! মনে নেই’, ‘কোনো এক কবির হবে’, ইত্যাদি। ইঙ্গিতখানা এমন যেন সেই কোনো এক কবি সে নিজেও হতে পারে!

কমেন্ট বক্সে ওই ভদ্রলোকের প্রশ্নের নিচে আমি ছোট করে লিখলাম, ‘এটা আমার লেখা।’ এরপর ওই মেয়েটির ব্যবহার দেখে ভারি অবাক হয়ে গেলাম। তখনই সে লাফিয়ে পড়ে আমার কমেন্টটা ডিলিট করে দিলো। ভীষণ অবাক হয়েই তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কেন করলি?’ এই প্রশ্ন করাতে সে কবিতাটিই উড়িয়ে দিলো, তারপর মেসেজ বক্সে আমাকে মেসেজ করলো, ‘এত `আমি` `আমি` কোরো না তো।’ দু’একটা কথা বলাতে, তার আজব ব্যাখ্যা, ‘কবিতাটা অসম্ভব ভালো লেগেছে। তুমি বুঝতে পারছো না আমি তোমার কবিতার কত বড় ফ্যান!’

এরপরেও মেয়েটি বেশ কিছুদিন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে ছিল। দেখতাম, সে কোনো এক এনজিওতে কাজ করে। ছবিটবি আঁকে, আরো কীসব, এবং নিজস্ব কৃতীর নিচে নিজের নাম বড় বড় করে লেখে। কারণ সে মনে করে, তাতে আমিত্বের জাহির হয় না বড় একটা!

সারা পৃথিবী ঘুরে এসেছে এমন অনেক লোক দেখেছি, মনটা এতটুকু বড় হয়নি। তেমনই লোক দেখিয়ে সমাজসেবা করে এমন অনেক মানুষই আছে যারা ভণ্ড, লোকের চোখে বড় হয়ে আমিত্বের অন্ধ মোহে ডুবে মরার বাসনা তাদের কম নয়। আসলে মানুষ এসব সীমাবদ্ধতা নিয়েই জন্মায়। একসময় মেয়েটিকে বাদ দেই, কারণ এত দ্বিচারিতা আমার সহ্য হয় না।

যাই হোক, মেয়েটি যে আমার কবিতার বড় বেশি প্রেমে ছিল সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না। এতটাই গাঢ় সেই আসক্তি, যে সে আমাকে মুছে সাফ করে কেবল আমার কবিতাটিই রাখতে চেয়েছিল, যেন এ কেবল তার একার নিজস্ব! একদিন এভাবেই সময়ের নুয়ে পড়া কাস্তের এক কোপে কেটে যাবে আমার লগ্ন হয়ে থাকাটুকু, এ পৃথিবীর সাথে অদৃশ্য নাড়ির বন্ধনে। সেদিন কেউ এমন করে আঁকড়ে থাকতে চাইবে কিনা আমার কোনো শব্দবন্ধ, সে আমি জানি না। সব একদিন ফুরিয়ে যায় ঝুপঝাপ এটুকুই জানি, তাই এইসব হাবিজাবি লেখা!

সৃষ্টিতে নিজেকে সমাধি দেয়া এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা। যেমন ঈশ্বর বিলীন হয়ে আছেন প্রকৃতির কোণে কোণে। কেবল আমরা মানুষ, জেনেছি বলতে হয়, এ গাছ আমার, এর ফুল কেবল আমার পুজোয় লাগুক! মৃত্যুকে সে জেনেছে যে, তাই এত ভয়। চলবে

লেখক: কবি