চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২৫

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুলাই ২৯, ২০১৯

কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি স্মোক করেন?’ কারণ সম্ভবত, আমার ঠোঁটগুলো গোলাপি নয়। আজ্ঞে, আমি স্মোক-টোক করি না। এমনকি যারা পাশে দাঁড়িয়ে স্মোক করে এবং ভরপুর মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ে তাদের ওপর বিরক্ত হই। কারণ প্যাসিভ স্মোকিং ব্যাপারটা ভীষণ বিরক্তিকর। কী ইনসেনসিটিভ হয় এক একটা মানুষ, উফফ।

সিগারেট খাওয়ার সাথে ইনটেলেক্টের যে কোনো রকম সম্পর্ক নেই, তা কে না জানে। রাস্তাঘাটে আজকাল তরুণদের যত না স্মোক করতে দেখি, তার থেকে বেশি দেখি তরুণীদের। বুঝতে পারি, ওরা ওদের সামাজিক এভল্যুশনের অ্যাডলসেন্সে আছে। যাক গে। ওতে কেউ খারাপ হয় না। তবে সোস্যাল মিডিয়ায় নিজের স্মোক করার ছবি পোস্টানোর সাথে নিচে ছোট করে লিখে দেয়া অবশ্যই উচিত, ‘স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস ট্যু হেলথ।’

এটা একটা স্ট্যাটুটারি ওয়ার্নিং। ওই যেমন আমরা সিনেমায় দেখি। কারণ ছবির মধ্যে সবসময়ই কিছু না কিছুর প্রমোশন থাকে, যেহেতু তা সহজ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যসংবেদী। তাই আজেবাজে জিনিসের প্রমোশন কখনই প্রয়োজনীয় সচেতনতা ছাড়া হওয়া উচিত নয়।

সোস্যাল মিডিয়ায় মানুষ আজকাল কিসের না ছবি দেয়। সবটাই যে খারাপ তা নয়। যার যেটা ট্যালেন্ট সে সেটাকে শোকেস করে। যে লেখে যে ছবি আঁকে যে গান গায় যে নাচে যে ভালো রাঁধে বা যে সুন্দর করে সাজে সবাই নিজের প্রতিভাকে চিত্রায়িত করে। ভালোই লাগে। কিন্তু সমাজসেবা? দরিদ্র মানুষের হাতে অন্ন বস্ত্র তুলে দেয়া? এটাও কি অধুনা সোস্যাল মিডিয়ার আবিষ্কৃত কোনো প্রতিভা নাকি?

এও হচ্ছে। বছরান্তে দুবার দরিদ্র কিংবা অনাথ শিশুদের রেঁধেবেড়ে খাইয়ে সমাজসেবা হচ্ছে এবং সেই ছবি ফলাও করে চওড়া হচ্ছে ফেবুজাত ভালো মানুষ দাদা-দিদিদের বুক। আত্মপ্রচারের এধরনের বিকারগ্রস্ত চেহারা দেখতে ভালো লাগে না। এতে যে দাতা নিজেকে উচ্চে রাখতে চায় তার মহানুভবতার জাহির হয় তাই নয়, যে মানুষটা আরেকজনের থেকে হাত পেতে নিচ্ছে তার অসহায়তারও প্রকাশ হয়, এটুকু বোধ নেই অকালকুষ্মাণ্ডদের। অথচ যে দিচ্ছে আর যে নিচ্ছে তাদের মধ্যে ফারাক কতটুকু বা কিসের?

এই পৃথিবীতে কেউ কারো থেকে হাত পেতে কিছু নেয়ার জন্য জন্মায়নি। এই বিপুলা পৃথিবী প্রতিটি প্রাণের প্রাপ্যটুকু রেখেছে যথাস্থানে। এ তো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ তো মানবজাতির জিঘাংসা যে একজনকে মহাধনী করেছে আর আরেকজনকে অন্নবস্ত্রহীন। অন্নহীনের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার সে কাজ করতে হয় নীরবে, মাটিতে নেমে, নিরন্তর। কারণ সে কাজ ঈশ্বরের। কোনো একদিন দুদিনের আত্মপ্রচারের বণার্ঢ্য উৎসবে দাতা সেজে আরেকজনকে গ্রহীতার আসনে বসিয়ে তার অসহায়তাকেই তুলে ধরা হয়।

সবার সামনে পকেট বাজিয়ে দুপয়সা দেয়াকে ভিক্ষে দেয়া বলে। দান করতে হয় সকলের অজ্ঞাতসারে, নীরবে। দান করে কেউ মহান হয় না। দানের কোনো আত্মসুখ নেই। নেই কোনো অহংকার।

এসকলই কেবল `মরাল` তাড়িত নয়। এ জীবন এখন অনেকটাই পিকচার ফেড। ছবির মধ্যে যা থাকে তা পুরোপুরি সত্যি নয়। আবার পুরোপুরি মিথ্যাও নয়। সোস্যাল মিডিয়া যে সত্যকে সামনে আনে তা একধরনের সিউডো রিয়্যালিটি বা ট্র্যান্স রিয়্যালিটি বা অলীক বাস্তবতা। তাই সোস্যাল মিডিয়ায় মানুষকে দেখতে হয় স্বপ্ন দেখার মতো। সব স্বপ্ন ভালো হয় না। কিছু কিছু দুঃসপ্নও বটে।

আর বাস্তব? যখন পা মাটি স্পর্শ করে, আঙুল ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যায় ত্রসরেণু, চুল বেয়ে চুঁইয়ে নামে জল, তোমার বুকের শার্ট থেকে খুলে পড়া বোতাম গড়িয়ে যায় পালঙ্কের নিচে আর এসবের মাঝে আমরা টুকি টুকি খেলি... এই বেঁচে থাকা স্বপ্নের চেয়েও বেশি অলীক মনে হয়। ট্রুথ ইজ স্ট্রেন্জার দ্যান ফিকশন। চলবে

লেখক: কবি