চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ২৭

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : আগস্ট ১৫, ২০১৯

কোথাও কোনও তাড়া নেই। কুয়াশায় ঝুম হয়ে আছে পাইনের বন। যেন গদের আঁঠার মতো নেশায় লেগে আছে সকালের ঘুমভাঙা চোখ। ঢাল বরাবর পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমি ও আমার প্রেমিক। এর হাত ওর মুঠোর ভেতর উষ্ণতায় ঠাসা। কোথায় পৌঁছতে চাই জানা নেই। একটা স্বাধীন সকাল আমার কাছে এরকম।

ঝর্ণার ধারে বসি। আঁজলা ভরে জল পান করি। দেখি অরণ্যের মাথার ওপর সূর্য ওঠে ঘন লাল। কত পাখি ডাকে। অপরিচিত শব্দের রেশ ধরে ধরে মায়া গাঁথি। পাথরে প্রতিহত হয়ে ছিটকে আসে জল, ভাবনার। ঘোর কাটলে দেখি, প্রেমিকের চোখ পাখির ঠোঁটের মতো `হা` হয়ে আছে, ভেতরে তার আজন্মের ক্ষুধা। এত বিস্ময়, তা কেবল আমার জন্য, পৃথিবীতে বেঁচে আছে জানলে নিজেকে পাখি বলে মনে হয়।

অথচ আমার কোনও ডানা নেই। কেবল পাণ্ডুলিপি আছে। ছেঁড়া পাতাগুলো উড়িয়ে দেই আকাশে। সে বলে, ‘চলো। আরো গভীরে যাওয়া বাকি।’ কোনও কিছু কুড়িয়ে নেয়ার মতো দ্বিধা না রেখেই উঠে পড়ি। দেখি, বনের লতাপাতারা কেমন নিবিড় হয়ে আছে। এমনই কোনও নিবিড় জন্ম তবে কি আমারও সাধ ছিল?

সে আমার পিছু পিছু চলে। ভুলে যেতে দেয় আমি কে। আমিও ভুলে যাই কেন এসেছিলাম তবে এতদূর থেকে। পথে কোনও দিকচিহ্ন রাখা জরুরি নয় যেন। কোথাও একটা পৌঁছে যাব ঠিক। মাথার ওপর সূর্য ঢলে বিকেল হয়ে আসে। বনের ভেতর পাহাড়ি পতঙ্গের গুঞ্জন শোনা যায় । সে বলে, ‘আর কতদূর হাঁটবে? তোমার স্নান পায় না?’

স্নান শব্দে আমার ঘরের কথা মনে পড়ে। আকাশ ছাওয়া ঘর। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি যার সময়। এবার মনে পড়ে আমি কেন এসেছিলাম, আমরা কেন এসেছিলাম। আমি তার চোখের ভেতর আঙুল গেঁথে দিই। শূন্য থেকে শূন্য অবধি বিপুল জলরাশির শব্দ হতে থাকে। সমস্ত অরণ্য ভাসিয়ে নিতে পারে এত জল কোথা থেকে এলো হঠাৎ?

সেই গোপন ইন্দ্রিয়মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেখি স্ফটিক ভেঙে চুড়চুড় হয়ে আছে। শঙ্খের মতো সাদা জল হুড়মুড় করে নামে। নামতে নামতে রাত হয়। রাত হতে হতে চরম অন্ধকার। পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দে কে যেন বলে ওঠে, ‘ভালোবাসি।’

এই অসহ্য উচ্চারণের ভেতরেও লিখে চলি। মাথার ভেতর কে যেন দরজা দেয় ধপাধপ। কেউ বিছানা পাতে। কেউ বলে, ‘খেতে দাও।’ কেউ ‘মা’ বলে ডাকে। কে আবার হাতুড়ি মারে দেয়ালে। এত প্ররোচনার ভেতরেও শব্দের টুঁটি টিপে ধরি। সেই অরণ্যের কথা মনে পড়ে যায়, আমাদের নিবিড় জন্মের কথা।

একটা স্বাধীন রাত আমার কাছে ভুলে থাকার, যে সকলকেই ফিরে যেতে হয় একদিন।

লেখক: কবি