জগদীশ চন্দ্র বসু: মাইক্রো তরঙ্গ সৃষ্টির রূপকার

অজয় রায়

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০২০

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর আজ প্রয়াণ দিবস। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর বিহারের গিরিডিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেতার যন্ত্রের আবিষ্কারক। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে অজয় রায়ের ‘জগদীশ চন্দ্র বসু: মাইক্রো তরঙ্গ সৃষ্টির রূপকার’ প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এই নভেম্বর মাসেই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম, মৃত্যুও এ মাসেই। তাই এই নভেম্বরে তাকে নিয়ে সামান্য আলোচনা করলে আর তার একটি অবদানের কথা একটু বিস্তৃতভাবে জানতে পারলে বোধ হয় মন্দ হয় না। তাকে বলা হয় ভারতের আধুনিক বিজ্ঞানের প্রবর্তক এবং সার্থক আধুনিক বিজ্ঞানী। বিদেশের মাটিতে নয়, দেশেই প্রেসিডেন্সি কলেজের ২০x২০ বর্গের কুঠুরিতে বসেই তিনি পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা এবং শারীরবিদ্যার ওপর নানা গবেষণা করেন। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত যন্ত্র ও সরঞ্জাম দিয়ে নয়, নিজ হাতে নিজের প্রয়োজনে যন্ত্রপাতি বানিয়েছেন। সাহায্য নিয়েছেন স্থানীয় কামারদের।

এই স্বহস্ত নির্মিত যন্ত্র-সাহায্যে গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেছেন বিদেশের আন্তর্জাতিক মানের জার্নালে। যেমন, তার অতি গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় গবেষণাপত্রটি ১৮৯৭ সালে প্রকাশ করেছিলেন রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে নিম্নলিখিত এই শিরোনামে, On the Determination of the Wave-length of Electric Radiation by Diffraction Grating, Proc. Royal Soc. (London), LX (1897), 167-178

তার প্রথম গবেষণাপত্রটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে, যার শিরোনাম ছিল, On Polarisation of Electric Rays by double refracting crystals, Asiatic Society of Bengal. May, 1895 [Collected Physical Papers, Longmans. Green and Co. London]

আচার্য বসুর গবেষণার ক্ষেত্র যে কতটা প্রসারিত আর বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল তা উপলব্ধি করা যায় তার প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলোর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করলেই। তিনি তার পরীক্ষায় যে বিদ্যুৎ-চুম্বক রশ্মি বা তরঙ্গ ব্যবহার করেছেন তার নাম দিয়েছেন ’বিদ্যুৎ তরঙ্গ’। তার ভাষায়, Electric waves। আর  যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এই রশ্মিসমূহ গবেষণাগারে সৃষ্টি করেছেন তার আধুনিক নাম ’ক্ষুদ্র তরঙ্গ’ বা মাইক্রোওয়েভ। এসব তরঙ্গের দৈর্ঘ্য সাধারণভাবে 10-6cm সীমায় পড়ে।

জগদীশ বসুর গবেষণার ক্ষেত্র বহুধা বিভক্ত হলেও আমরা আজ মাইক্রোওয়েভ সংক্রান্ত তার গবেষণার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব। বিশদে যাওয়ার আগে গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আচার্য বসুর একটি বাণী উদ্ধৃত করতে চাই, The more difficult is the task, the greater is the challenge. When you have gained the vision of a purpose to which you can and must dedicate yourself wholly, then the closed doors will be opened and the seemingly impossible will become fully attainable

আমরা ম্যাক্সওয়েলের বিখ্যাত ক্ষেত্র সমীকরণসমূহের সাথে পরিচিত। তার প্রধান ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে ছিল, ১. বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গের অস্তিত্ব অবশ্যই রয়েছে এবং এই তরঙ্গরাজি কল্পিত ঈথারসহ যে কোনো মাধ্যমে জ্বলতে সক্ষম। ২. এই প্রবহমান তরঙ্গের দ্রুতি (speed) বিশুদ্ধ তাড়িতিক পরিমাপণের মাধ্যমে নির্ধারণ সম্ভব। ৩. কোলশ্রাউক কর্তৃক পরিমাপিত আলোর দ্রুতির মানের সাথে বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গের দ্রুতির মান তুলনা করে আমরা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, আলোও একধরণের বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ, প্রভেদ কেবল তরঙ্গদৈর্ঘ্য।

গবেষণাগারে সৃষ্ট বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ
ম্যাক্সওয়েলের ভবিষ্যদ্বাণীতে উৎসাহিত হয়ে সে সময় অনেক পরীক্ষণবিদই ল্যাবরেটরিতে বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ উৎপাদনের কাজে লেগে যান। ১৮৭৯ সালে পরীক্ষাগারে এ ধরণের তরঙ্গ উৎপাদনে প্রথম সক্ষম হন হার্জ (Hertz)। কিন্তু দুঃখের বিষয়, হার্জের এই চমকপ্রদ সাফল্য তার সমসাময়িক সহকর্মী ও বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস অর্জনে ব্যর্থ হয়। হার্জের এই সাফল্য অবশ্য ম্যাক্সওয়েল দেখে যেতে পারেননি, কারণ তিনি এ ঘটনার আগেই ১৮৭৯ সালেই মৃত্যুবরণ করেন। হার্জ নিজেও মোটামুটি তরুণ বয়সে ১৮৯৪ সালে মারা যান। গবেষণাগারে যে বিদ্যুৎ-চুম্বক তরঙ্গ উৎপাদন সম্ভব এটি প্রতিপন্ন করতে হার্জের অনুগামীদের, যাদেরকে বলা হয় হার্জিয়ান, বহুবছর ধরে নিবেদিত প্রাণ হয়ে সাধনা করতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, আমাদের বোসও ছিলেন একজন হার্জিয়ান।

গবেষণাগারে তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ উৎপাদন সংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে আরেকটু আলোচনা করা যাক। এ প্রসঙ্গে অলিভার লজের কাজের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮৮৭-৮৮ সালে লজ দেখিয়েছিলেন যে, তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গ তারের ভেতর দিয়ে সঞ্চালিত হতে পারে, এই তরঙ্গ যে মুক্তস্থানেও চলতে পারে তা প্রমাণে ব্যর্থ হন। লজের মতো বিজ্ঞানী একঅর্থে ব্যর্থ হয়েছেন, হার্জের সাফল্য তাই বিপুলভাবে অভিনন্দিত। ডেসিমটিার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে সীমায় এধরণের তরঙ্গ উৎপাদন করা (তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ৬৬ সে.মি.) ছিল তার প্রাথমিক উদ্ভাবন। কাঠের ফ্রেমের ওপর স্থাপিত দস্তার পাতের তৈরি বেলনাকার প্যারাবোলিক প্রতিফলকের ফোকাস বিন্দুতে স্থাপিত একটি দ্বিপোলের ওপর তিনি তার তরঙ্গকে উদ্ভাসন করেন। তিনি দ্বিপোলটির রসদ যোগান দেন ধাতব বর্তুলের গ্যাপে একটি স্পার্ক ডিসচার্জ করে। স্পার্ক সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করা হতো একটি ‘রামকর্ফ কয়েল’ (Ruhmkorf coil) থেকে। বলা বাহুল্য, প্যারাবোলিক প্রতিফলকের মাধ্যমে সৃষ্ট তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গকে মুক্তস্থানে ছড়িয়ে দেয়া হতো যাতে, এ ধরণের তরঙ্গের ক্রিয়া বহুদূর অবধি অনুধাবন করা যায়।

স্পষ্টতই হার্জ ডেসিমিটার (১০ সে.মি = ১ ডেসিমিটার) তরঙ্গ উৎপাদী যন্ত্র বানিয়েছিলেন। কিন্তু এই যন্ত্রটি দিয়ে তিনি যা করেছিলেন তা ছিল পরমাশ্চার্যের বিষয় (এবং এখনও)। তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বাতাসে (মুক্তস্থানে) তাড়িত চৌম্বক তরঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে এবং আলোকসম দ্রুতি নির্ধারণ করেছিলেন, এবং  এও দেখিয়েছিলেন, এই তরঙ্গের সাধারণ আলোসম ধর্ম (যেমন প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, এবং পেলারায়ন বা মেরুবর্তিতা) রয়েছে। এই তরঙ্গ ব্যবহার করে দিয়ে তিনি ডাইইলেকট্রিকস’এর ওপরও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল ৩০টি কঠিন, ২০টি তরল এবং ৮টি গ্যাসীয় পদার্থ; একটি ক্ষেত্রে ৪৫ লিটার প্যরাফিন দিয়ে পরিপূর্ণ একটি ওক কাঠ নির্মিত আধার নিয়েও পর্যবেক্ষণ চালিয়েছেন।

এই চমকপ্রদ কাজের ফলাফল ছিল তাৎক্ষণিক এবং সত্যই বিস্ময়কর! লজ ১০১ সেন্টিমিটার তরঙ্গে এসব পরীক্ষণের পুনরাবৃত্তি করেছিলেন, এবং পিচ দিয়ে তৈরি বেলনাকার লেন্সের ফোকাসে রশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। লেন্সটির ওজন ছিল ১৬০ কেজি এবং ফোকাস দূরত্ব ৫১ সে.মি.। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি রশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করতে ব্যর্থ হন, কারণ তার যন্ত্রটি ছিল ১০০ সে.মি।

হার্জের অকাল মৃত্যুতে তিনি হার্জের ওপর ১৮৯৪ সালের জুন মাসে একটি স্মারক বক্তৃতা দিয়েছিলেন রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে এবং অনতিকাল পরে এই স্মারক বক্তৃতাটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা রূপে প্রকাশ করেছিলেন ‘হার্জ এবং তাঁর কতিপয় উত্তরসূরিদের কর্ম’ (The Work of Hertz and some of his successors) শিরোনামে। এর আগে লজ হার্জের গবেষণাগুলোর ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন।

স্পষ্টতই যারা লজের খ্যাতির কথা শুনেছিলেন বা তাঁর বইটি পাঠ করেছিলেন তারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন জগদীশ বোস এবং মার্কনি, তাছাড়া ছিলেন ব্র্যনলি, জেহন্দার, পপোভ, রিঘি এবং এমন কি রাদারফোর্ডও। রিঘি ৩ সেমি ও ১০ সেমি তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছিলেন। অন্যদিকে মার্কনি এবং তার ছাত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন ২৫ সে.মি তরঙ্গদৈর্ঘ্য নিয়ে। ৪ মাইল দূরত্বে স্থাপিত এক জোড়া প্যারাবোলিক প্রতিফলক ব্যবহার করে তিনি ব্রিটিশ পোস্ট অফিস কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে পেরেছিলেন, তারহীন (বেতার) টেলিগ্রাফি সম্ভব। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৯৭ সালে।

আমরা এবার আচার্য বসুর কাজের কথায় ফিরে আসি। লজের বই পড়ে অনুপ্রাণিত হলেন জগদীশচন্দ্র, আর শুরু করলেন বিশাল কর্মযজ্ঞ। তিনি প্রথমেই বিদ্যুৎ তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৫ মিলিমিটারে নামিয়ে আনলেন আলোক বর্ণালির কাছাকাছি, যা ইতিপূর্বে কেউই করেননি। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, হার্জিয়ান তরঙ্গের আলোক-সদৃশ আচরণ অনুশীলন করতে হলে ক্ষুদ্রতর তরঙ্গ হবে অনেক বেশি যুতসই। এই ক্ষুদ্রতর তরঙ্গের যন্ত্র নির্মাণ করে তিনি পারিপার্শ্বিক প্রতিফলন দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সংকীর্ণতর বীম উৎপাদন করেছিলেন। এ কারণেই অন্যান্য হার্জিয়ান ব্যবহৃত যন্ত্রের তুলনায় তার যন্ত্রটি ছিল অনেক ক্ষুদ্রাকারের। ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত তিনি তার প্রথম গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, The radiating box, thus constructed, is very portable. The one I have been using, for some time past, is 7 inches in height, 6 inches in length, and 4 inches in breadth. He must find natural substances which would polarize the transmitted electric ray.

বোস ভেবেছিলেন যে, তাকে প্রকৃতিজাত স্বাভাবিক কেলাস natural crystal খুঁজে পেতে হবে যার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ রশ্মি অতিক্রম করলে রশ্মিটি পোলারায়িত হবে। এটি সম্ভব হলে তার উৎপাদিত বিদ্যুৎ রশ্মি ও আলোর মধ্যে সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হবে। তিনি নানা ধরনের প্রাকৃতিক কেলাস নিয়ে পরীক্ষণ চালিয়ে সফল হলেন, এর মধ্যে ছিল: বেরিল (Beryl), অ্যাপটাইট (Apatite), নেমালাইট (Nemalite – a fibrous variety of Brucite), বেরিটস (Barytes) মাইক্রোক্লাইন (Microcline), রকসল্ট (Rock Salt), কালো টোরমালিন (black Tourmaline) এবং আইসল্যান্ড স্পার (Iceland Spar)। তিনি তার পরীক্ষণের সার সংক্ষেপ এভাবে লিখলেন, ‘তাত্ত্বিকভাবে রকসল্ট ধরণের কৃস্টাল ছাড়া  সকল কৃস্টালই আলোকে পেলারায়িত করতে পারার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান আলো ব্যবহার করে অস্বচ্ছ কৃস্টালে এটা যাচাই করা সম্ভব হয় নি। কিন্তু ইলেকট্রিক রশ্মির ক্ষেত্রে এ ধরণের কোনও সমস্যা নেই, কারণ সকল কৃস্টালই তাড়িত তরঙ্গে স্বচ্ছ।’

পরবর্তীকালে আচার্য বসু ১ সে.মি ও ২.৫ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে বিদ্যুৎ রশ্মি নিয়েও বিশদ গবেষণা করেছেন। তার কৃৎকৌশলগত দক্ষতা চমকপ্রদ এর প্রমাণ পাওয়া যায়, মাইক্রোওয়েভ উৎপাদক, উদঘাটক (detector), দর্পণ, দ্বি-প্রিজম দিকধর্মী সংযোজক (two prism directional couplers), পোলারিমিটার, বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র (spectrometers), ডাই-ইলেকট্রোমিটার, রেকর্ডার প্রভৃতি জটিল যন্ত্র নির্মাণ সাফল্যে। গবেষণার জন্য কী ধরণের যন্ত্রের প্রয়োজন সবই তার জানা ছিল। এ যথাযোগ্য কারণেই তাকে মাইক্রোওয়েভ সদৃশ ’অপটিকসের’ জনক বলা হয়। তাকে সলিডস্টেট উদঘাটকেরও প্রবর্তক রূপেও চিহ্নিত করা যায় এবং সে অর্থে এটি করতে গিয়ে তিনি ডোপিং প্রতিভাসও আবিষ্কার করেন। স্পষ্টতই তিনি তার সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রগামী ছিলেন।

বাংলা জানেন কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণার সাথে অতটা পরিচিত নন এমন পাঠকদের জন্য আচার্য বসুর প্রথম গবেষণা পত্রটির বাংলা অনুবাদ এখানে পরিবেশ করছি।  প্রবন্ধটির শিরোনাম, দ্বি-প্রতিসরণ কৃস্টাল কর্তৃক বিদ্যুৎ রশ্মির পোলারায়নের বর্ণনা

একটি সাধারণ আলোক রশ্মিগুচ্ছ (বীম) আইসল্যান্ড স্পার কৃস্টালের ওপর অপতিত হলে রশ্মিটি কৃস্টালের ভেতর দিয়ে অতিক্রমণের পর দ্বিপ্রসারিত bifurcated হয় এবং অতিক্রান্ত রশ্মিদুটি পরস্পরের সমতলে পোলারায়িত হয়। বর্তমান গবেষণাটির উদ্দেশ্য হলো, প্রকৃতিজাত পদার্থ খুঁজে বের করা যার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গটি অতিক্রান্ত হলে পোলারায়িত হবে। এই শ্রেণির পদার্থ পাওয়া গেলে ইলেকট্রিক রশ্মিও সাথে আলোর সাদৃশ্য আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। দুটি ঘটনাকেই অবিকল বলে গণ্য করা যেতে পারে, যদি একই নমুনাটি দৃশ্যমান আলোক ও ইলেকট্রিক রশ্মি উভয়কেই পোলারায়িত করে।

যেহেতু ইলেকট্রিক তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তুলনায় অনেক বড়, তাই মনে হতে পারে তাড়িত তরঙ্গকে পোলারায়িত করতে হলে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত কৃস্টালের তুলনায় অনেক বড় মাপের কৃস্টালের প্রয়োজন হবে। আমি কিন্তু সফল হয়েছি মোটামুটি প্রমাণ আকারের কৃস্টাল ব্যবহার করে ইলেকট্রিক রশ্মির পোলারায়ন করতে। আর এটি করতে আমি সমর্থ হয়েছি ইলেকট্রিক তরঙ্গের দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৫ মিলিমিটারে হ্রাস করে। এসব পরীক্ষণ থেকে দেখতে পেয়েছি যে, কতিপয় কৃস্টাল দ্বি-প্রতিসরণ উৎপাদন করে, এবং অতিক্রান্ত বীমসমূহ পোলারায়িত হয়। এমন কি তেমন সূক্ষ্ম যন্ত্র ব্যবহার না করেও আমি গত বছর এসব ঘটনার চিহ্ন ধরতে সফল হয়েছি। পরে অবশ্য যন্ত্রটির অনেক উন্নতি ঘটিয়েছি; ফলে এখন পোলারায়ন ঘটনা সুনিশ্চিতভাবেই ধরা যায়।

কৃস্টালে দ্বিপ্রতিসরণ ক্রিয়া উদ্ঘাটনের সাধারণ আলোক পদ্ধতি দুটি আড়াআড়ি নিকল প্রিজমের (Nicolls) ওপর দ্বিপ্রতিসরণ গড়নকে প্রতিক্ষেপন (impose) করতে হয় । কৃস্টালটির মধ্যবর্তীন (interposition) অবস্থান সাধারণভাবে দৃষ্টক্ষেত্রকে উজ্জ্বলতর করে। এটি ডি-পোলারায়ন প্রভাব (depolarization effect) নামে পরিচিত। আর এটিকেই বিবেচনা করা হয় দ্বি প্রতিসরণ পদার্থের অভীক্ষা রূপে। পোলারাইজার বা অ্যানালাইজার সমতলের সাথে কৃস্টালের প্রধান সমতল সমস্থানিক অবস্থায় চলে যায় (কোইনসাইড করে যায়) তখন কোন ডি-পোলারায়ন দৃষ্ট হয় না। কৃস্টালের অপটিক অক্ষ যদি আপতিত রশ্মিও সমান্তরাল হয় তখনও দৃষ্টি ক্ষেত্র অন্ধকার থাকে।

পোলারায়িত ইলেকট্রিক রশ্মি নিয়ে পরীক্ষণকালেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। একটি সমান্তরাল বীম প্রথমে একটি গ্রেটিং দিয়ে পোলারায়িত করা হয়। একই ধরণের গ্রেটিং বিশ্লেষক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুটি গ্রেটিং আড়াআড়ি রাখা হয়, এবং নিরীক্ষণীয় কেলাসটি মাঝখানে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। গ্রাহক যন্ত্রটি আসলে কোহেরারেই পরিমার্জিত রূপ; এর সাথে অবশ্য একটি ভোল্টায়িক সেল এবং একটি গ্যালভানেমিটার অবশ্য সংযুক্ত থাকবে। ক্ষেত্রের উজ্জ্বলতা নির্দেশিত হবে গ্যালভানোমিটার শলাকার ক্ষেপণ দেখে।