জান্নাত মিতুর গদ্য ‘তবু সে শিশুটিই রবে’

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২১

হ্যালো, জি নমস্কার, কে সাম্যদা বলছেন? দাদা আমি মিতু বলছিলাম... জি দাদা, নাহিন ভাই আপনাকে আমার কথা বলেছেন। দাদা, আমি একটু দেখা করতে পারি?

ওপাশ থেকে হেভি কনফিডেন্টলি রেসপন্স দিচ্ছিলো। কিন্তু নাম বলার সাথে সাথে বলে উঠলেন, ও হ্যাঁ মিতু, হ্যাঁ হ্যাঁ চলে এসো।
আসলে কিন্তু সে কিচ্ছুটি চিনতে পারেনি আমাকে। খুব চিনে ফেলার ভান করছিল।
হু। তো বলছিলাম আমার দাদার কথা। একটা অদ্ভূত মানুষ। ছোট্ট মানুষ। বয়সটা বেড়েছে যদিও, চুলে পাক ধরেছে, তবুও দাদা আমাদের বয়সী। সে আমার মতোই রেগে গিয়ে চিল্লাপাল্লা করে। সে আমার মতোই চারপাশের সবাইকে খোঁচায়, পচানি দেয়, ক্ষ্যাপায়, হাসায়... আনন্দ দেয়... আনন্দে রাখে... আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। আনন্দে বাঁচতে শেখায়। না-না, এতগুলো গুণ আমার নেই। আমি সমৃদ্ধ নই দাদার মতো।

মাঝে মাঝে আমার মতিভ্রম হয়। মাঝে মাঝে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ডিপ্রেসনে ডুব দিই। বা দৃষ্টিভঙ্গি দুর্বল হয়ে পড়ে। ভুলভাল কাজকারবারে ব্যস্ত হয়ে যাই। আমার এই দাদা তখন আমাকে গপ্পো শোনান। চে গ্যেভারার গপ্পো, লেনিনের গপ্পো, স্ট্যালিনের গপ্পো, শিবদাশ ঘোষের কথা, হায়দার ভাইয়ের কথা। আমি শুনি। শুনতে থাকি। আমার চোখের সামনে ঘটনাগুলো ভাসে। যেন একটা সিনেমা চলছে। চলছে ঘটনাগুলো। আমি ওই সময়ে চলে গেছি। বাতাস আমার চোখ। আমি ভেসে ভেসে ঘুরে ঘুরে দেখছি ঘটনাগুলো। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে গেছি। আরও কত গেছি। আরও কত কত কি!

দাদা আমাকে সবসময় কোনো না কোনোভাবে পচানি দেয়। দাদা আমাকে গল্পের হাসিঠাট্টার ছলে অপমান করে। আমাকে কথায় কথায় কিভাবে যেন প্রেরণা দেয়। বেঁচে থাকার প্রেরণা নয়, একজন আত্মমর্যাদাবান মানুষ হবার প্রেরণা। ভুল না করার প্রেরণা, সঠিক কাজ করার প্রেরণা। পরশু সে আমাকে নতুন একটা প্রেরণা দিলো, আত্মবিশ্বাসী হবার প্রেরণা। দ্বিধাদ্বন্দে না ভোগার নির্দেশ। দাদা আমার রাজনৈতিক আদর্শ নয়, আসলে একজনকে রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য যে পরিমাণে রাজনৈতিক আদর্শিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তার কিচ্ছু নেই আমার। আমি অনেক পিছিয়ে আছি।

তিনি আমার আদর্শ নন। আমি জাফর ইকবালের অন্ধ ভক্ত ছিলাম। আমি আরও কিছু মানুষের অন্ধভক্ত ছিলাম। দাদার অন্ধভক্ত ছিলাম না। কিন্তু পরম আস্থা ছিল, আছে। ভেঙেছে কিছু মুহূর্তের জন্য। ভাঙার মতো ঘটনা ঘটেছে, তবু ধরে রেখেছি, আস্থা ভাঙতে হয় না। ধৈর্য ধরে দেখতে হয়। ভুল শোধরানোর জন্য সময় দিতে হয়, সুদীর্ঘ সময়। সাম্যদার প্রতি অন্ধভক্তি নাই। প্রচুর ভালোবাসা আছে। রাগ আছে। অভিমান নাহ্, একদম রাগ, মহা ক্ষিপ্ত আছি। অনেক বিষয়ে বলিনি তারে। ছোট ছোট রাগের বিষয়ে চিল্লাপাল্লা করেছি। কিন্তু বড় বড় রাগের বিষয়ে জানাইনি। থম মেরে বসে আছি। কবে জানাবো জানি না।

আমার ১৭ বছরের জীবনে কারোর প্রতি এত মারাত্মক রাগ পুষে রেখে নরমাল থাকিনি। তার বেলায় থাকছি। কারণ এই মানুষটার সাথে অকারণে চিল্লাইতে ভাল্লাগে। সে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টায়ে কাঁচুমাচু করে। ভাল্লাগে। আমার পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্যের তিনটে দৃশ্য হলো, সুমনার ন্যাকামি, আম্মার অফিস থেকে এসে খেতে বসে তৃপ্ত চেহারা, আর আমার চিল্লানি-বকা খেয়ে দাদার ঠোঁট উল্টায়ে অভিমান। কিন্তু অনেক বড় যে রাগ জমে আছে, তা বলিনি। তার বিরুদ্ধে তার সীমাবদ্ধতাগুলো দেখিয়ে অভিযোগ করতে মন চায় না, মায়া হয়। কেমন গম্ভীর হয়ে যায় সে। আমার সহ্য হয় না। আমার দাদার গম্ভীর মুখ আমি দেখতে চাই না। আমার মায়া লাগে তার ওপর রাগ করতেও। মনে হয়, ছোট্ট মানুষটা!, ভুল করেছে, তা বলে রাগ করবো? ওটুকু করলে কি হয়? কত লোকে তো করে। দাদার তো কোনো খারাপ দিক নেই। একটু দুটো অন্যায় সে করলে কি হয়? ও ঠিক হয়ে যাবে। নিজে নিজে বুঝে যাবে। আমি বলে দিলে খুশি হবে, কিন্তু তবু বলবো না। দাদা ভুল করেছে তা বলতে ইচ্ছে করে না।

এটাকে কি বায়নেস বলে? তাহলে তাই। দাদা অনুপমকে ভালোবাসে না। সে ভালোবাসে কবীর সুমনকে। সে মৌসুমী ভৌমিকের গান শোনে। দাদা আমার কাছে আমার দেখা সবচে রুচিশীল মানুষ। দাদা অসাধারণ আবৃত্তি পারে। তার একটা মোটামুটি ধরণের আবৃত্তি শুনে আমি খুব কষ্টে চোখের পানি আটকেছি। যেন সে দেখতে না পায়। কেন জানেন? কাঁদছি দেখলে তো সে বুঝে যাবে যে সে কত দারুণ আবৃত্তি করেছে। সে বুঝে যাবে, আমি মুগ্ধ হয়ে তার আবৃত্তি শুনেছি। আমি তো তাকে সেটা বুঝতে দেব না। আমি তো স্বীকারই করি না সে ভালো আবৃত্তি করে। সবসময় পচাই। বলি, ছিহ্, কবিতার বারোটা বাজিয়ে দিলেন দাদা। কী বাজে আবৃত্তি। বুঝতে পারছেন তার সাথে আমার সম্পর্কটা? দাদার কণ্ঠটাও মায়াময়। এক দু’লাইন করে গান গায়। সুর হয় না। কিন্তু কণ্ঠের জন্য শুনতে ইচ্ছে করে, অসীম সময় ধরে। দাদা একটা এমন মানুষ, যে দাদাকে না পেলে আমি অপূর্ণ হয়ে থাকতাম। হয়তো ভবিষ্যতে অনেক বড় বড় মানুষদের সঙ্গ পাবো, দাদার চে অনেক অনেক অনেক বড় মাপের শুদ্ধ মানুষ হবেন তারা, কিন্তু, আমি সাম্যদা আরেকটা পাব না। কেউ এত জ্বালাবে না, রাগাবে না, ক্ষ্যাপাবে না, বকবে না, পচাবে না।

আমাদের অরবিন্দ স্যারের সাথে আমার দেখা হলে সে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করে, কিরে, সে পাগলটা কেমন আছে? পড়াশোনা করে তো ঠিকমতো?
দাদা ইয়া লম্বা একটা ছোট্ট শিশু। যে কিনা ম্যাচুরড এনাফ, যার কিনা প্রভাবিত করতে পারার তীব্র ক্ষমতা আছে। শোধরাতে পারার তীব্র ক্ষমতা আছে। সে তার চারপাশের মানুষগুলোকে অসম্ভব ভালো রাখতে পারে। আমি খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গেলে তার দেয়া একটা চিঠি পড়ি। পড়ে আমি একদম ঠিকঠাক হয়ে যাই। সাধারণ একটা চিঠি, অথচ প্রত্যেকটা বাক্য কি শক্তিশালী দিক-নির্দেশনা দেয় জীবনের। জীবনকে উপভোগ করতে শেখা যায় ওটা পড়লে। চারপাশের সবকিছুকে মমতার চোখে দেখা যায়। সৌন্দর্যবোধ তৈরি হয়। সাম্যদা আমাকে শিখিয়েছিল, অভিযোগ করা সহজ, বিরক্ত হওয়া ঘৃণা করা সহজ, কিন্তু শুধরে দেয়া কঠিন, মমতার দিয়ে সবকিছুকে দেখাটা কঠিন, ধৈর্য ধরে ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা কঠিন। সাম্যদাকে আম্মু খুব হিংসে করে। তার কথা, আমার মেয়ে তার দাদার কথা যতটা শোনে ততোটা যদি আমার কথা শুনতো, ইশ, কি সুখই না হতো আমার।

না গো মা, তোমার মেয়ে তার দাদার সব কথা শুনে চলতে পারেনি। পারলে আজ সে ভুলহীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন পারফেক্ট মানুষ হয়ে যেত। কেন এত কথা লিখলাম? মানুষটার জন্মদিন আজ। ঠিক দুই বছর আগে ২০১৬ সালে তার জন্মদিনে তাকে একটা কফিমগ উপহার দিয়েছিলাম। সাতদিন পর গিয়ে দেখি. সে সেটাকে ভেঙে ফেলেছে। আর এরপর অ্যাশট্রে হিসেবে ব্যবহার করছে। এত্ত রাগ হয়েছিল না। চেঁচিয়েছিলাম, অ্যাজ য়্যুজুয়াল হ্যা হ্যা করে হেসেছিলো সে। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনেও আর জন্মদিনে কিচ্ছু দেব না। প্রতিজ্ঞা বলবৎ আছে। শুভ জন্মদিন বলবো কিনা ভাবছি। নাহ্, বলবো না। সাম্যদাকে সবসময় খোঁচাতে হবে। পচাতে হবে। ভালোকিছু বলা যাবে না। সে ভালোবাসা বোঝে না। ঠাট্টা করে। ক্ষেপিয়ে দেয়। তার সাথে ঝগড়া ছাড়া আর কিচ্ছু হতে পারে না। এই যে এত কথা লিখেছি, সে পড়ে বলবে, কিসব ইমোশনাল কথাবার্তা। আবেগি কথা। বস্তপচা... ধ্যাৎ! তবে জন্মদিনে শুভ/অশুভ একটা কামনা করি। বয়সটা বাড়বে তার। চুল বাকি সবকটা পেকে সাদা হবে। সেদিনও দেখবো, বিকেলবেলায় লাইব্রেরিতে দাদা সামনে বই নিয়ে ফোঁকলা দাঁত বের করে হাসছে। সামনে লাইব্রেরির সদস্য একগাদা পিচকি পাঁচকা বসা। তারা তাকে দাদা ডাকছে না, দাদু ডাকছে।

আমি ঠিক দাদার মতো কোরে মুখে হাত দিয়ে বসে তাকিয়ে দেখবো, সেই দাদা আজ দাদু হয়ে গ্যাছে। তার সামনে আমার অতীতগুলো বসে ঠিক আমার মতো কোরে দাদুর গপ্পোগুলো শুনছে। সেদিন দাদা আমার দাদু হবে। তবু সে শিশুটিই রবে।