জাহিদ সোহাগের গল্প ‘আমাকে গুলি করলে ১টা গুলিও মিস হবে না’

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২৩

কখনো এমন হয়, সামান্য কিছুর জন্য খুনোখুনি করতে ইচ্ছে করে; যেন এই ইচ্ছা সূঁচের সামান্য ছিদ্রের ভেতর দিয়ে অনায়াসে টেনে নেবে উটের কাফেলা। আমি সহ্য করি। নিজেকে সংযমের যাঁতাকলে পিষতে পিষতে শেষ করে ফেলতে চাই। কেন আমি নির্বিষ নই? আমিও কেন প্রবৃত্তির অন্ধকার ছেনে ছেনে বাঁচতে পারি না? কে আমার ছুরিকে শুধু আপেল কাটতে বলে? কে আমাকে প্রতারিত করে, লাঞ্ছিত করে, বাঁচে- তুলে ধরে নিজের ময়ূর? আমি কেবল ঘাড় গুজে, আপোষ করে বেঁচে থাকি। আমার সামনে কোনো সুদিন নেই। কোনো বিপ্লব প্রতি-বিপ্লব নেই। কোনো গৃহযুদ্ধ নেই সন্ত্রাসে তুলে নেব আগ্নেয়াস্ত্র। কারণে অকারণে মানুষের খুলি উড়েয়ে দেব তরমুজের মতো। শুধু গুলি। ঠা ঠা গুলি। আমার ক্রোধ, আমার ঘৃণা, আমার ঈর্ষা- সব বন্দুকের নলের ভেতর দিয়ে, পুরুষের বীর্যের সিম্ফনীর মতো, বেরিয়ে যাবে। এভাবে লাভ করবো আমি নির্বাণ। প্রশান্তি। অথচ সব্জিওয়ালা আমার দিকে ছুড়ে দেয় স্কচটেপ লাগানো দশটাকার নোট, যেন আমি তার হাতে দিয়েছি মরা ইঁদুরের নাড়িভুড়ি, যেন সে আমার কানের নিচে ঠাস করে থাপ্পর দিতে পারে অনায়াসেই, ফুটপাতের অন্য সব্জিওয়ালা তার সামান্য ইশারাতেই আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে মুহূর্তেই, যেন সে সরকার দলের কোনো পাণ্ডা, অনায়াসে পুলিশের মুখের উপর প্রস্রাব করতে পারে লুঙ্গি উচিয়ে। আমি চুপ থাকি। ওর কুমড়ো কাটার ছুরির দিকে আমি চেয়ে থাকি। যেন এতেই এক কোপে ওর কণ্ঠনালি থেকে ছিটকে রক্ত এসে লাগবে আমার মুখে। সম্ভব হলে সেই রক্ত চেটে খেয়েও দেখতে পারি। আমি চুপ থাকি। আমার অপরাধ স্বীকার করে তাকে পাঁচশ’ টাকার নোট দেই। সে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। অপ্রয়োজনে সিগারেট কিনি, ফোনে টাকা রিচার্জ করি। কন্ডোম কিনবো কিনা ভাবি। তাকে দশ টাকা দেই। দশ টাকায় কেনা কাচামরিচ ইচ্ছে হয়ে ড্রেনে ছুড়ে ফেলি, পায়ে পিষে দেই। হঠাৎই চারপাশে মাইক জেগে ওঠে। তীব্র তীক্ষ্ম বেসুরো। যেনো তারা আজান শেষে লাঠি হাতে নেমে আসবে রাস্তায়। নামাজ পড়ানোর জন্য। সন্ধ্যায়, ভাঙাচোরা রাস্তার ভেতর দিয়ে, আজানের উচ্চকণ্ঠ প্রতিযোগীতার ভেতর আমি হাঁটি, দাঁড়িয়ে থাকি, বিমূঢ়। আমার ঘরের দরোজা ক্রমশ দূরে দূরে সড়ে যায়। ঘরে ফিরে নিজেকে একাকিত্বে নিক্ষেপ করার স্থান নেই। আমাকে হাসতে হয়। সুখি হতে হয়। রতিক্রিয়ার সময় আমি সব্জিওয়ালর মুখ মনে করার চেষ্টা করি। ক্যানেস্তারার মতো বাসটার ভেতরে গরমে সেদ্ধ হওয়ার কথা মনে করতে চাই। অফিস বাসা, অফিস বাসা, অফিস বাসা, অফিস বাসা- এমন রেসের লাইন দেখতে চাই। আমাকে ঘুমুতে হবে ঘুমের ওষুধ খেয়ে। পেইন কিলার খেয়ে। আমি বাঁচতে বাঁচতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি শহরের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমার উদ্যম খুইয়ে ফেলেছি। মানুষ আমার কাছে সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক প্রপঞ্চ। আমি মানুষের খুলি উড়িয়ে দিতে চাই। আমার গ্যালাক্সির আন্তসম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলতে চাই। পৃথিবী টাল খেতে খেতে আছড়ে পড়ুক কোনো সূর্যের গায়ে। পৃথিবীপোড়া ছাই শুধু অনিবার্য হোক পৃথিবীর ভাগ্যে। কখনো ভাবি, আমি সত্যিই কাউকে খুন করতে চাই? আমার মা বলতেন সবকিছু মেনে নিতে। কেউ গালি দিলে, কেউ থুতু দিলে যেন মেনে নেই, প্রতিবাদ না করি, জবাব না দেই, চোখ তুলে না তাকাই। শৈশবের সেই অভ্যাস আমার রয়ে গেছে। আমি থুতুবষ্টির ভেতর ভিজতে ভিজতে বেঁচে আছি। কোনো মতে বেঁচে থাকাটাই আমার জীবনের সারকথা। আমি এই আমাকে আমার পায়ের নিচে চেপে রেখে তার চামড়া খুলে ফেলতে চাই। আমার মস্তিষ্ক, আমার অভ্যাস, ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলতে চাই, আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চাই। আমি দুই টাকার জন্য রিকশাওয়ালার সঙ্গে হাতাহাতি করতে চাই। ছিনিয়ে নিতে চাই যে কারো যোনিজঙ্ঘা। পুলিশের মাথার উপর প্রস্রাব করতে চাই। বিচারকের অ-োকোষ ছিঁড়ে শূন্যে উড্ডীন কাককে খাওয়াতে চাই। রাষ্ট্রক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে ক্যান্টনমেন্টের সামনে বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই। আমি সামান্য থেকে সর্বোচ্চকে দিয়ে ফেলতে চাই ঘুষি। অথচ আমার হাত ক্রমশ গুটিয়ে আসে। আমার ঘাড় আরো নিচু হয়ে আসে। হাঁটতে হাঁটতে আমি নিজের পা ছাড়া আর কিছু দেখি না। এই পা-জোড়া দেখলে আমার কেবল পালাতে ইচ্ছে করে। এমন নামতে থাকা সন্ধ্যার ভেতর, বাতি-লণ্ঠন জ্বেলে ওঠা ভিড়ের ভেতর আমি কোথাও এসে আমাকে খুইয়ে ফেলতে চাই। যেখানে কোনো গর্ত চলে গেছে নিরেট নিশ্চিহ্নের ভেতর। আমি কেনো এভাবে গুটিয়ে থাকি? কেনো ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে কারো নাকের উপর ধাম করে ঘুষি মারি না? মনে মনে এর উত্তর খুঁজে বের করি-

 

ক. যাকে ঘুষি দেবো সে আমার চেয়েও শরীরপ্রধান, হয়ত সে- ধরি, ক্ষমতাসীন দল, ‘বা. ভে. পা.’- মানে ‘বাংলাদেশ ভেড়াক্রান্ত পার্টি’র সব্জি বিক্রেতা সমিতির কলিমুদ্দিন লেনের সহ-দপ্তর সম্পাদক। বা এমন কোনো নেতার অনুসারি।
খ. সে খুন করলে পুলিশ প্রথমে তাকে পালাতে সাহায্য করবে, মোটিভ নষ্ট করবে, নিরপরাধ কয়েকজনকে ধরে হাজতে ঢুকাবে, তাদের অত্যাচার করে টাকা হাতিয়ে নেবে, কলিমুদ্দিন লেনের কোনো নেতার ব্যক্তিগত/রাজনৈতিক শত্রু/প্রতিপক্ষকে হত্যা মামলায় ফাঁসাবে। শেষে এমন অবস্থা হবে যে, আমি খুন হইনি। সব ‘বা. ছা. পা.’- মানে ‘বাংলাদেশ ছাগলপালন পার্টি’র ষড়যন্ত্র বা মিডিয়ার সৃষ্টি, বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, আমরা দেখছি।

 

একটি অসহায়ত্ব-
আমার পরিবারের কেউ থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা নেবে না, সাধারণ ডায়রিও না, ঘুরতে ঘুরতে মামলা হলেও খুনি অজ্ঞাতনামা। পরিবারের কারো কণ্ঠ উচ্চকিত হলে তাকে পিষে ফেলবে বুটের তলায়। নারীরা হবে ধর্ষিত। তারা এমনভাবে বেঁচে থাকবে যেন আমি কখনো ছিলাম না।

 

পুলিশ কি পার্টির কর্মী?
-হু, পার্টি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, বিশেষত ছাত্র সংগঠনের, সঙ্গে স্থানীয় এমপি/মন্ত্রীর ডিও লেটার। খুব প্রমিনেন্ট হলে টাকা লাগবে না, নইলে অন্তত ৮-১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হবে। ঢাকায় পোর্টিংয়ের জন্য আরো ১০ লাখ ঘুষ। থানার বড় কর্তাদের মাসিক সেলামি আছে। এত চাপ। পার্টির বাইরে এক পা সেও ফেললে তছতছ।

 

সবাই তছনছ। ওই এমপি মন্ত্রীও তছনছ। শুধু অনুগত থাকো। তিনটি বাক্যের মধ্যে আড়াইটি বাক্যে দলের আদর্শের কথা বলো- বলা প্রয়োজন না হলেও বলো। আর দু’হাতে লুটে নাও, যা তোমার নয়, এমনকি জোছনাও।

 

কে আমি?
-আমি মো. জসিমুদ্দিন, এমএ, বাবা মো. জালালউদ্দিন বিএ, মা রহিমা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র। পরিবারে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই। কে কী ভোট দেয় তাও অজ্ঞাত- অবশ্য ভোট দেবার আগেই কাস্ট হয়ে যায় কখনো। ঢাকায় বেসরকারি (পড়ুন : বেদরকারি) চাকরি করি। শখ করে পানিতে বরফ গুলে খাই।

 

আমাকে থাপ্পর দিকে চকরির মতো ঘুরতে পারি।
আমাকে লাত্থি দিলে দেয়ালে ছিটকে পড়তে পারি।
আমার বুকে ছুরি চালালে খুব বেশি বাধা দিতে পারি না।
আমাকে গুলি করলে ১টা গুলিও মিস হবে না।
আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলে ১টাও চাকরি পাবো না।
এছাড়া বাড়তি আছে মেরুদণ্ডের ব্যথা, টনসিল, ইনসোমেনিয়া।

 

আমার কোনো বন্ধু পুলিশে নেই- না, আছে। আমার কোনো বন্ধু রাজনীতিতে নেই- না, আছে। আমার কোনো বন্ধু প্রশাসনে নেই- না, আছে। তারা আছে, যেমন আমি আছি নীল তিমির সঙ্গে।

 

এই পর্যন্ত এসে এই গল্প মানে বাংলাদেশের গল্প থেমে যায়। শব্দ সংখ্যা কম হলে যার যা ইচ্ছেমতো ঘটনা যুক্ত করতে পারেন: পরকীয়া, ধর্ষণ, ব্যাংক লুট, ছাগলের সঙ্গে ভেড়ার আঁতাত, বুদ্ধিজীবী, সা রে গা মা সংস্কৃতিকর্মী, ট্রাম্প-পুতিন, দলীয়/জাতিগত চেতনা, লাশ লাশ লাশ...বা লাশ নয়, হাওয়া...