জীবনের অধরা কাছিম

মুয়ীন পারভেজ

প্রকাশিত : মার্চ ১৫, ২০১৯

‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ‘বাছাই কবিতা’ বা ‘নির্বাচিত গল্প’ নামের বইগুলা খুব বেশি পড়া হয় না কখনও; একজন কবি বা কথাশিল্পীরে আমি সমগ্রভাবে পাইতে চাই। কথাখান খুব সুন্দর কইরা ব্যাখ্যা করছেন শঙ্খ ঘোষ। ‘এই শহরের রাখাল’ বইতে জীবনানন্দ সম্পর্কে লেখতে গিয়া তিনি ভাবেন ‘সময়ের সমগ্রতা’র কথা। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে জীবনানন্দের সেইসব কবিতাই বাইছা নিছিলেন বুদ্ধদেব বসু, যে-কবিতাগুলা রোম্যান্টিক, রহস্যাতুর বা হৃদয়সংবেদী; আর ‘এ কালের কবিতা’ সংকলনে জীবনানন্দের সেইসব কবিতারেই গুরুত্ব দিছিলেন বিষ্ণু দে, যে-কবিতাগুলা দেশকালসচেতন বা বুদ্ধিবৃত্তিক। ফলে দুই সংকলনেই আমরা পাইছি আসলে খণ্ডিত দুই জীবনানন্দরে। তাই, ২০১৮ শালে প্রকাশিত হইলেও, এবারের বইমেলায় আগামী প্রকাশনীর স্টলে কাজল শাহনেওয়াজের ‘গল্পসমগ্র’ পাইয়া আমি যারপরনাই খুশি! তার ‘কাব্যসমগ্র’ও পাইছিলাম, কিন্তু পাতায়-পাতায় ভুল বানানের ছড়াছড়ি দেইখা মন দইমা গেছিল একেবারে। স্টলের সামনেই দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়তেছিলাম ‘ব্যাঙনি’। বইখান কিনি নাই, তবে বইমেলা থেইকা বাইর হওয়ার সময় বারবার মনে হইতেছিল, পুরা এস্টেডিয়ামের মাঠ য্যান আষাঢ়ের ডোবা আর এক মায়াবী ‘ব্যাঙনি’ আকুল হইয়া ডাকতেছে আমারে!

‘গল্পসমগ্র’তেও দেখলাম ভুল বানানের মোচ্ছব। তবু কইলজারে শক্ত কইরা কিইনা নিছি এই বই। বাংলা ভাষার ধনুকে একখান নতুন শব্দশর যোজনা করছিলেন কাজল: ‘শে’। না, ভুল বানান না এইটা। ইংরেজিতে পুংবাচক ও স্ত্রীবাচক সর্বনাম বুঝাইতে ‘হি’ ও ‘শি’ লেখা হয়, বাংলায় সে-তরিকা নাই। কাজলই প্রথম স্ত্রীবাচক সর্বনাম ‘শে’-র উদ্ভাবক। নতুন এই শব্দের বিএস দাগ বাড়াইয়া দিছে বাংলা ভাষার তফসিল। কিন্তু নতুন খত্যেন মাইনা নিতে বড় অনীহা বাঙালির, তা না হইলে এতদিনে সাহিত্যের দরবারে সরবে অভিষিক্ত হইত ‘শে’। প্রিয় কবি-প্রাবন্ধিক-অনুবাদক এহসানুল কবির ‘শে’ ব্যবহার কইরা লেখছিলেন চমৎকার একখান কবিতা, মনে পড়ে। আইচ্ছা, জীবনানন্দের আগে ‘সাদা’ শব্দের বানান ‘শাদা’ ভাবতে পারছিলেন আর কেউ?

সনাতন কাঠামোতে গল্প লেখেন না কাজল; মানে নিটোল সুন্দর, সূচনা-সমাপ্তিসহ, নিদ্দিষ্ট কোনও ভাব্যব্যঞ্জনায় মূর্ত—এমন গল্প লেখেন না। ভাষা-আঙ্গিক লইয়া অনেকেই নিরীক্ষা করেন, কিন্তু পইয্যবেক্ষণের সূক্ষ্মতা, রসবোধ, বেতের মতন ভঙ্গিমাসক্ষম গইদ্য আর জীবনের অপার বিচিত্র রহস্যের আলো-আঁধারির খেলা—এই চাইরখান গুণ বা বৈশিষ্ট্য খুব কম গল্পের মইধ্যেই একত্রে পাওয়া যায়। কাজলের ‘কাছিমগালা’ তেমনই শত-শত বছরের মাটির মতন বহুস্তরময় এক গল্প যার সূচনাবিন্দু আছে, পরিসমাপ্তি খুঁইজা পাওয়া কঠিন। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘সমুদ্র’ গল্পের কথা হয়ত মনে পড়বে কারও-কারও, শহীদুল জহিরের ‘ডলু নদীর হাওয়া’ বা সমকালীন আহমেদ মুনিরের ‘গোলাপ ও মোহনলাল’ গল্পের কথাও। কাজলের সব চাইতে বড় সম্পদ বোধহয় তার ভাষা, সরীসৃপের মতন সর্বত্রগামী ভাষা। নৌকার খোলে উল্টাইয়া রাখা সারি-সারি হলদে বা হলদে-সবুজ কাছিম দেইখা গল্পকথকের মনে হয় ‘ভাবনা কেন্দ্র থেকে খুব দূরে কী যেন একটা অনুভাবনা চিঁ চিঁ করে কেন্দ্র মাকে ডাকছে। ইচ্ছা করছে মগজটাকে খুলে উল্টে দেই’। ‘সার সার চিৎকারে রাখা কী জিনিস’ পইড়া শুরুতে ধন্দে আছিলাম, ভাবতেছিলাম, না, হইলেও ত হইতে পারে এইটা, কিন্তু ক্রমশ নীচের দিকে আইসা খোলাশা হইল কথাখান, ‘কাছেই চিৎকরা খোল থেকে’ দেইখা।

কত কম আয়ু কৌশলী মানুষের আর তিনশো বছরের আয়ু লইয়া চিররহস্যের তলায় ডুইবা থাকে কাছিমেরা! কাজল যখন নিসর্গবণ্ননার দিকে যান তখন মনে পড়ে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর কথা, এমনকী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’তে মাছ ধরার দৃশ্যে চরাচরব্যাপ্ত নিঃশব্দতার কথাও, যদিও আলাদা প্রত্যেকের ক্যানভাস। চা-খানার কোলাহলে ধরা যায় না বাইদ্যানির মতন এমন চকিত ইশারাময় গল্পের রূপ, দরকার হয় নিভৃতি, মাঝেমইধ্যে বই আর চোখ বন্ধ কইরা ভাবনার একটুখানি অলস অবসর, যখন বলতে থাকেন কাজল:

‘‘অ’ একটি বিচিত্র বহুবর্ণিল ধ্বনি। শুধু ধ্বনি নয়, এর সঙ্গে জড়ানো রয়েছে বহু প্রজন্মের অধ্যাত্ম অভিজ্ঞতা। গভীর রাতে যে কাকটি ‘অওঅ-’ স্বরে নিজের কাকবিস্ময় প্রকাশ করে, সেই কাকই দিনের প্রথম ভাগের কর্কষতাকে নির্ভর করে অন্য একটি ‘অ’ দিয়ে প্রয়োজন মেটায়। আমি ভাবতে চাই এভাবে যুবকের আর্তনাদের মধ্যে ‘আ’, বালকের প্রতিবাদের মধ্যে ‘ই’ বিভিন্ন স্বরূপে প্রকাশিত।’’

এক অপার্থিব মরমি কলমের অধিকারী কাজল, যিনি নিঃসন্তান দম্পতির একান্ত গোপন সূক্ষ্ম খুনশুটিরেও দিতে পারেন অজন্তার রহস্যমহিমা।

লেখক: কবি

একুশে বইমেলা ২০১৮