
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষার গতিপ্রকৃতি
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : আগস্ট ২৪, ২০২৫
যখন ব্রিটিশ শাসকরা ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগের ঘোষণা দিলেন বর্ণহিন্দুরা তা মেনে নিলেন না। কারণ বাংলার জমিদার, আইনজীবী, চিকিৎসক, বিভিন্ন পেশার অন্যান্য মানুষরা প্রায় সবাই ছিলেন বর্ণহিন্দু। বাংলা ভাগ হলে জমিদাররা তাদের জমিদারী হারাবেন। পূর্ব বাংলার মুসলমানসহ অন্যরা মামলা মোকদ্দমার কাজে আর কলকাতায় যাবেন না। ফলে আইনজীবীদের আইন-ব্যবসার ক্ষতি হবে। কলকাতা কেন্দ্রিক সকল পেশার মানুষদের জন্যই বাংলা ভাগ ছিল দুঃসংবাদ। ফলে বর্ণহিন্দুরা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। সরকার বর্ণহিন্দুদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বঙ্গভঙ্গ রদ করলেন। বঙ্গভঙ্গ যখন রদ করা হয় তখন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। তিনি বাংলার হতাশ মুসলামানদের সান্ত্বনা জানাতে ঢাকায় এলেন। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান নেতৃবৃন্দ ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কিছু দাবি-দাওয়া নিয়েই তারা গিয়েছিলেন।
প্রধান একটি দাবি ছিল, পূর্ব বাংলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হোক। ভাইসরয় এই দাবির পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দিলেন। কলকাতার বা পশ্চিমবঙ্গের বর্ণহিন্দুদের দিক থেকে ঢাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপত্তি উঠেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যরা সরাসরি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করার ব্যাপারে জোর দাবি জানিয়েছিলেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পর লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার রবার্ট নাথানকে সভাপতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি’ নামে তেরো সদস্যের একটি পর্ষদ গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হবে বলে কমিটি প্রস্তাব করে।
নাথান কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে আবাসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, ঢাকার সাতটি মহাবিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তুর্ভুক্ত হবে। পূর্ব বাংলার বাকি মহাবিদ্যালয়গুলি থাকবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে যেসব মহাবিদ্যালয় থাকবে শুধু সেগুলোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন হবে। সেই সময়ে ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজ দুটিই ছিল পাঁচ মাইল ব্যসার্ধের মধ্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে তার পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের বাইরে আর কোনো মহাবিদ্যালয়কে আওতাধীন করতে দেওয়া হয়নি তার পেছনে একটি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। রমেশচন্দ্র মজুমদার এ ব্যাপারে তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘পূর্ববঙ্গের ঢাকা শহরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। মুসলমানেরা এতে খুশি হলেন বটে, কিন্তু হিন্দুদের মনে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। সাধারণত যারা রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকতেন, তারাও এবার এই প্রতিবাদ আন্দোলনে যোগ দিলেন। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন রাসবিহারী ঘোষ ও গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি আরও লিখেছেন, ‘ক্রমেই এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ হিন্দুদের এই বলে আশ্বাস দিলেন যে, তাদের এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। কারণ ঢাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার ক্ষমতা ও অধিকার ঢাকা শহরের দশ মাইল পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।’ বর্ণহিন্দুদের খুশি রেখেই স্যাডলার কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে সরকারি আইনের আওতায় ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো। আহমদ ছফা লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হতো তার কোনো কারণ খুঁজে তিনি পাননি। তবে একটি কথা সত্যি, গোটা ভারত উপমহাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার তখন সুনাম ছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ সত্যেন বসু, কবি মোহিতলাল মজুমদার, ভাষাবিদ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। এই সমস্ত কৃতবিদ্য ব্যক্তি মনীষা এখানে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার একটি উত্তাপিত আবেষ্টনী সৃষ্টি করেছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো ছাত্র তৎকালীন অখণ্ড বাংলায় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কবি বুদ্ধদেব বসু, কবি অজিত দত্ত প্রমুখ আধুনিক কবিতার বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রেখে এসেছেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও ছিলেন, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মুহাম্মদ আবদুল হাই, আহমদ হোসেন প্রমুখ। তিরিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা বুদ্ধির মুক্তির জন্য যে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তার গুরুত্ব বাংলাদেশের মননশীলতার বিকাশে মস্ত বড় ভূমিকা রেখেছিল, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। অদ্যাবধি স্বাধীন চিত্তবৃত্তি ও মুক্তচিন্তার চর্চার কথা উঠলেই সকলে একবাক্যে শিখা গোষ্ঠীর নাম উচ্চারণ করে থাকেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ যখন সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করে চলেছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল তখন ঠিক উল্টো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে ১৯৪৭ সালের পর। পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পর পূর্ববঙ্গের পঞ্চান্নটি মহাবিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কাঠামোতে স্বতন্ত্র মহাবিদ্যালয় পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপন করা হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত অস্তিত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হলেও ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তান আমলে তা রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট বা সিনেটে সরকারি কর্মকর্তাদের পদাধিকার বলে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবেই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করা হয়।
সেখানে নানা শর্তের মধ্যে আরও বলা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কর্তৃক চার বছরের জন্য উপাচার্য নিযুক্ত হবেন। তিনি পরবর্তীকালে চার বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ পেতে পারেন। ১৯৬১ সালে অধ্যাদেশের বলে শিক্ষক ও কর্মচারীদের যে কোনো অজুহাতে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হতো। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এতে কেড়ে নেওয়া হয় এবং যে-কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতালাভের পরেই এমন ঘটনা ঘটেছিল।
নতুন অধ্যাদেশে কঠোর চাকরি বিধির কারণে শিক্ষকগণ নিপতিত হয় চরম নিরাপত্তাহীনতায়। অন্যদিকে সরকারি ছত্রছায়ায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমর্থনপুষ্ট হয়ে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন নামধারী একটি ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিভীষিকা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো হয়ে ওঠে খুন, জখম, দাঙ্গাহাঙ্গামা, লুটতরাজ, রাহাজানি, মদ-জুয়া, আর পতিতাদের আখড়া। আর ঐ সমস্তই চলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায়। শিক্ষক আবু মাহমুদের উপরেও হামলা চালায় ছাত্র নামধারী এইসব সরকারের গুণ্ডারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চুয়াত্তর শিক্ষক এর বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে তাদের প্রতিবাদের অন্যতম বিষয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুনের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও গোলযোগের মুখে সেই বছরের সমাবর্তন অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়। সেকারণে অনেক ছাত্রের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কিছু ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুজনের সনদপত্র বাতিল করে।
ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানারকম অরাজকতা দেখা দিয়েছিল তা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠার অন্ত ছিল না। তখন ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয বন্ধ করে দিতেন। বিনা বাক্যব্যয়ে শিক্ষার্থীদের হল ছেড়ে চলে যেতে হতো। পরীক্ষা তিন মাস বা ছয় মাস পর্যন্ত পিছিয়ে যেতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকবৃন্দ আগের অধ্যাদেশ বাতিল-সংক্রান্ত দাবি তুললে সরকার তা বিবেচনার আশ্বাস দেন। নতুন অধ্যাদেশে বলা হয়, সিনেটের কাছে উপাচার্যের জবাবদিহিতা থাকবে। সিন্ডিকেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সিদ্ধান্ত উপাচার্য কার্যকর করবেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় উপাচার্য যদি নিজ এখতিয়ারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তবে পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেটের অনুমোদন নেবেন। এমনকি উপাচার্য প্যানেলের জন্য তিনজন নির্বাচিত হবেন সিনেট সদস্যদের ভোটে। এই তিনজনের প্যানেল থেকে আচার্য একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। ১৯৭৩ সালের আদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় উপাচার্যকে ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী ও একাডেমিক প্রধান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কমিটির দায়িত্ব উপাচার্যের কাজে সহযোগিতা করা। তিনি সকলের সমন্বয়ে কার্য পরিচালনা করলেও তার একক এখতিয়ার অগ্রগণ্য। ১৯৭৩ অধ্যাদেশ স্বায়ত্তশাসনের নামে আসলে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে যার ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো হয়নি। উপাচার্যদের নানারকম অনিয়ম করার সুযোগ করে দিয়েছে এইরকম ক্ষমতা প্রদান।
নতুন আদেশে পদাধিকার বলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা চ্যান্সেলর হলেন। আচার্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি, যদিও তিনি একজন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র। তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূণর্ণ ভূমিকা পালনকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিনেট, সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, অনুষদ, অর্থ-কমিটি ইত্যাদি। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সিনেট সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ যার সদস্য সংখ্যা একশো পাঁচজন। ১৯৭৩ সালের আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানকারী বিভাগসমূহের প্রধানগণ ‘চেয়ারম্যান’ নামে অভিহিত হন। চক্রাকারে বা আবর্তন পদ্ধতিতে উক্ত পদে একজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করেন।
সহকারী অধ্যাপকের নীচে নন এমন শিক্ষকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তিন বছর মেয়াদকালের জন্য উপাচার্য কর্তৃক বিভাগীয় চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি বিভাগের কাজের তত্ত্বাবধান করেন। ১৯৭৩ সালে আদেশের ফলে বিভাগের সব শিক্ষক একাডেমিক বিষয়ে নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ লাভ করেছেন। কিন্তু ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ গণতন্ত্রের নামে বিশ্ববিদ্যালয়কে এতটা নির্বাচনমুখী করে তুলেছে তার ফলাফল সার্বিকভাবে ভালো হয়নি।
বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের আদেশের সুবিধা ভোগ করে থাকে। সেইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষাদানের চেয়ে বিভিন্ন পদে বসে নানারকম সুযোগ-সুবিধা লাভ এবং প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারে বেশি ব্যস্ত থাকেন। শিক্ষকরা শিক্ষাদানের চেয়ে নির্বাচন নিয়েই সারা বছর ব্যস্ত সময় কাটান। নির্বাচনকে ঘিরে পক্ষ ও প্রতিপক্ষ হয়ে সারাদিন এক পক্ষ আর পক্ষের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। খুব কম শিক্ষকই আছেন যারা সঠিকভাবে পাঠদান করেন। নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষকরা ক্ষমতাসীন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করতেই বেশি পারদর্শিতা দেখান।
ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বহু শিক্ষক দল বদল করে ফেলেন। ব্রিটিশ শাসনে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্বশাসন ছিল তখন এত ধরনের নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিল না। বিভিন্ন জনকে তুলনামূলকভাবে যোগ্যতা এবং জ্যেষ্ঠতার বিচারে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হতো। বর্তমানে এসব পদ শিক্ষকরা অলঙ্কৃত করেন জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতার জোরে। চাটুকারিতার মাধ্যমে। এইসব নির্বাচন প্রক্রিয়া শিক্ষকদের সুবিধাবাদী, ক্ষমতা-লোভি এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ আদর্শহীন করে তুলেছে। ফলে বিরাট সংখ্যক শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যয়ন, গবেষণা কিংবা পাঠদান করার আগ্রহ নেই, যা আছে তা হলো নির্বাচনমুখীতা। যা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। শিক্ষার্থীরা সনদপত্র লাভ করে নির্দিষ্ট সময় পার করে, কিন্তু জ্ঞান অর্জন করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আশির দশকের শুরুতে শিক্ষার যতটুকু পরিবেশ ছিল তা নষ্ট হয় প্রথম এরশাদের শাসনামলে, পরে নব্বইয়ের দশকে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এরশাদ তার অনুগত সন্ত্রাসীদের সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেছিলেন। সরকারী পুলিশ নিয়মিতভাবে এরশাদের সন্ত্রাসী ছাত্রদের গোলা-বারুদ যোগান দিয়ে যেতো। ছাত্রসমাজ সম্মিলিতভাবে এরশাদ বাহিনীর সবরকম সন্ত্রাসীর তৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তার ফল এই হয়েছিল যে, কিছুদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা তাদের ঘাঁটি করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। সাধারণ ছাত্ররা তাদের যে মৌলিক অধিকার আছে সেটা প্রয়োগ করতে পারলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো সন্ত্রাস থাকতে পারে না। কিন্তু দেখা যায়, শিক্ষকরাই অনেকে রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য সন্ত্রাসীদের লালন করেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগসাজশে।
মূখ্যত সরকার কিংবা বিরোধী দলের সমর্থনপ্রাপ্ত ছাত্র রাজনীতি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসের মূল উৎস। রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসকে এ কারণে লালন করতে বাধ্য হচ্ছে যে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ক্ষমতায় আরোহণ যখন রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় তখন সব ধরনের মানবিক মূল্যবোধহীন রাজনীতি, জাতি এবং সমাজের জন্য কী ভয়াবহ ফল বয়ে অনতে পারে বাংলাদেশ হলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ছাত্রদের অবশ্যই রাজনীতি করতে হবে, সেটা বৃহত্তর গণস্বার্থের রাজনীতি।
বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকদেরই লেখাপড়ার সঙ্গে সংযোগ নেই, ব্যস্ত তারা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে। হাসিনার শাসনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হয়ে উঠেছিল তাই সন্ত্রাস সৃষ্টির অন্যতম কারখানা। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বহিরাগত রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের কক্ষ দখল আরম্ভ হয়। প্রশাসনের কিছুই করার থাকে না এক্ষেত্রে। নব্বইয়ের দশক থেকে সে প্রবণতা বাড়তেই থাকে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির মদদে। বছরের পর বছর তারপর থেকে একই রকম ঘটনা ঘটে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা ছিল জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার, কিন্তু হয়ে উঠলো গুণ্ডামি করার জায়গা। এ নিয়ে যেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাথাব্যথা নেই, মাস গেলে বেতন চান তারা।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই লেখাপড়াও হয় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তবুও দরকার তাদের দুটি কারণে। প্রথমত: শিক্ষকদের মাস গেলে বেতন এবং নানা রকম বৈধ-অবৈধ সুবিধা পাওয়া। দ্বিতীয়ত: ক্ষমতায় যে রাজনৈতিক দলটি থাকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হবে, এবং যে ক্ষমতায় যেতে চায় তাদেরও পাল্টা সন্ত্রাস করে ক্ষমতায় যেতে হবে। বিভিন্ন ছোট দলগুলোকেও তখন টিকে থাকার জন্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেছে নিতে হয়। সব পক্ষেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষকরা যুক্ত থাকেন। স্বভাবতই অধ্যাপনার চেয়ে এইসব সন্ত্রাসীদের লালন করা শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় নিজেদের ভবিষ্যত ঠিক রাখতে।
কথাগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখেই শোনা যায়। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় এসব নিয়ে লেখালেখিও হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গালিব আহসান খান একটি বই প্রকাশ করেছেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: রাজনীতি ও বিবিধ প্রসঙ্গ’ এই শিরোনামে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখাগুলো নিয়ে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত। সেখানে দেখা যায় নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষকরা কী ধরনের দিনযাপন করছে। পরিণামে কতরকম অনিয়ম চলছে এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তিনি দেখিয়েছেন, শিক্ষকরা এখন নীল গোলাপী আর সাদা দলে বিভক্ত। বিভক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক হিসেবে। শিক্ষকরা সেটা করছেন কোনোরকম আদর্শের কারণে নয়। বরং নিজেদের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। শিক্ষক হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভে তাঁরা পাঠদান বা গবেষণাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না। বরং শিক্ষক হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছেন সরকারি দলের বা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকাকে।
শিক্ষকরা সেজন্য বিশেষ দলের অন্ধ সমর্থক হয়ে ওঠেন। দলীয়করণের আওতায় নিয়ে আসেন গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে, সেই সঙ্গে শিক্ষাধারাকে। তিনি লিখেছেন, ‘দলীয়করণ যা ঘটে তা হলো, কোনো একটি দল একজন ব্যক্তিকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে কেবল সেই ব্যক্তি ঐ দলের সদস্য বলে। এখানে মেধা ও যোগ্যতাকে খাটো করা হয়-এবং এটা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য অকল্যাণকর হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে তারা ‘দলাদলি’ করে, ‘গোষ্ঠীবাজি’ করে। শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর চেয়ে দলাদলি বা গোষ্ঠীবাজি কাজে বেশি লিপ্ত থাকে বলেই পত্রপত্রিকা তা লিখতে বাধ্য হয়। দলাদলির রূপ এমন আকার নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নাকি রাজনৈতিক দলাদলির প্রতিষ্ঠান তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষক রাজনীতিকে ঘিরে শিক্ষকরা কত দূর নীচে নামতে পারেন বা তারা কতটা শিক্ষকের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে পারেন তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে বহুবার।
এমনও বলা হয়েছে, ‘শিক্ষকরা কলা ও মূলা পাবার রাজনীতি বেশি পছন্দ করেন’। কথাগুলো যে পত্রিকায় মিথ্যা লিখেছে তা নয়। শিক্ষকরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক মত ক্লাস নেন না কিংবা ঠিকভাবে পাঠদান করার প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যান না শিক্ষার্থীরা তখন তার ভুক্তভোগী হয়। কারণ শিক্ষকদের মনোযোগ নেই শিক্ষার্থীদের প্রতি কিংবা নিজেকে শিক্ষক হিসেবে প্রস্তুত করার দিকে। সর্বক্ষণ তার দৃষ্টি থাকে কলা আর মূলার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান এর ফলে কতটা অবক্ষয়ের পথে যাচ্ছে তা দেখার দরকার তার নেই। কারণ দলবাজি করে তিনি সবরকম সুবিধা পাচ্ছেন, পদোন্নতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন কিংবা বাড়তি উপার্জন সবকিছুতেই দলবাজি কাজ দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ষাটের দশকে যেসব অরাজকতা চলতে আরম্ভ করেছিল, আহমদ ছফা লিখেছেন তা দেখে বিবেকবান মানুষ শিউরে উঠতেন। তিনি মন্তব্য করেন, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে পরবর্তীকালে যা আরম্ভ হয়েছিল, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে তা দেখলে মনে হবে, ষাটের দশক ছিল সত্যযুগ। আগে সন্ত্রাসীদের সামাজিকভাবে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। এখন সন্ত্রাসীদের প্রতি সামাজিক মূল্যায়নের পদ্ধতিটাও ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সন্ত্রাস চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করে, দেখা যায় সেই শিক্ষার্থী পরে মন্ত্রীর গদীতে বসেছে। কিংবা জাতীয় সংসদের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীদের খাওয়ার দাম শোধ করতে হয় না। ক্লাসে না গেলে বা ক্লাস না করলেও চলে। অনেক সময় সে সবার সঙ্গে পরীক্ষায় না বসলেও বছর শেষে তার কৃতকার্য হওয়া আটকে থাকে না।
শিক্ষার্থী শিক্ষকের দয়া আশা করে না, শিক্ষক শিক্ষার্থীর দয়ার জন্য অপেক্ষা করে। বিশ^বিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সন্ত্রাসের নায়কদের সঙ্গে কানে কানে কথা বলে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেন। বিশ^বিদ্যালয় যেহেতু সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র, দেশের সকল স্থান থেকে সন্ত্রাসীরা তাড়া খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভয়ারণ্যে এসে আশ্রয় নেয় বা আত্মগোপন করে থাকে। কেউ তাদের কিছু করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এমন কতিপয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সহাবস্থান করতে করতে অনেক শিক্ষকের মুখের ভাবে সন্ত্রাসী চেহারা ফুটে ওঠে। ফলে যেখানে সন্ত্রাস রাজত্ব করে সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা একেবারেই চলতে পারে না।
যা বলা হলো তার অনেকটাই গত সালের নব্বইয়ের দশকের কথা। বর্তমান শতকে তা আরো ভয়াবহরূপ লাভ করেছে। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীরা আর এখন সন্ত্রাসী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট সংখ্যক শিক্ষকরাও এখানে সন্ত্রাসী। সেই সন্ত্রাস চলে নানা ঘটনায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ধরনের শিক্ষক নির্বাচনকে ঘিরে। গালিব আহসান খান বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষক রাজনীতির ভয়াবহ একটি চিত্র তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে শিক্ষকদের সেই রাজনীতি এতটাই সর্বগ্রাসী যে, যারা শিক্ষক রাজনীতিতে জড়াতে চান না তারাও শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। তিনি লিখেছেন, কখনো এমনও হতে পারে যে ভালো না লাগলেও অনেক কিছু বাধ্য হয়ে করতে হয়। ঠিক একইভাবে এটা সম্ভব যে, শিক্ষক রাজনীতি ভালো না লাগলেও কখনো ঘটনাস্রােতের আবর্তে শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারেন। না হলে তিনি তার ন্যায্য পাওনাটা থেকে বঞ্চিত হবেন। কারণ শিক্ষক রাজনীতি কেবল অযোগ্যদের সুবিধা দিচ্ছে তাই নয়, সত্যিকারের যোগ্যদের বঞ্চিত করছে। রাজনীতি এড়িয়ে সত্যিকারের শিক্ষক হতে চাইলে তাকে বিপদে পড়তে হতে পারে। যা স্বাভাবিক নিয়মে তার জন্য হবার কথা সেটাও ঘটবে না। তিনি নানাভাবে অপমানিত হবেন। সবচেয়ে আদর্শবান যোগ্য শিক্ষকটি তখন ভাবতে বাধ্য হন তার কি তাহলে কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেয়া দরকার? শুধু সমর্থন দিলেই হবে না, সক্রিয়ভাবে প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণ চালাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে তাকে তিনি কারো না কারো পক্ষে একনিষ্ঠ। সরকারের দলের সঙ্গে থাকতে পারলে সবচেয়ে লাভজনক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশির ভাগ দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত, সরকারের পক্ষ নিয়ে তারা গুণ্ডামি করেন, বলা বাহুল্য শিক্ষাদান যে তাদের মূল লক্ষ্য নয়। সারাদিন নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন, ক্লাস নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ক্লাস নেবেন কি-যিনি শিক্ষকের আদর্শ বহন করেন না, শিক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নন, তিনি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে কীভাবে সাহায্য করবেন? বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার জায়গা-রাজনৈতিক দলের দাসত্ব করে জ্ঞানচর্চা হয় না। বিশ্বের কোথাও হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যারা জ্ঞানচর্চা করেছেন তারা ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা-প্রকৃতির মানুষ। প্রতিক্ষণ তারা জ্ঞান অন্বেষণে কিংবা অধ্যয়ন আর গবেষণায় ডুবে থাকতেন। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বড় একটা অংশ সদা ব্যস্ত থাকে সরকারের বা নিজ দলের পক্ষে বক্তৃতাবাজি করতে। কখনোই তারা সেটা রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে কিংবা জনগণের স্বার্থে করেন না, করেন নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিপত্তির জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করবার মতন যোগ্যতা মেধা পর্যন্ত নেই। ফলে তারা পেশীশক্তি প্রদর্শনেই পারদর্শী। মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তারা যুক্তি, তথ্য দেয়ার চেয়ে-উচ্চস্বরে কিংবা গায়ের জোরে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চান। তার মত মেনে না নিলে বিরোধীদের ভয় দেখান।
শিক্ষকরা বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে আসেন মাস গেলে বেতন পাবেন বলে। শিক্ষকতা বা অধ্যয়ন তাদের লক্ষ্য নয়। বরং তাদের আরো লক্ষ্য থাকে নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত সুবিধালাভ। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় একবার লেখা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ ‘হালুয়া-রুটির পেছনে ছোটেন’। হালুয়া-রুটির জন্য নীল, গোলাপী বা সাদা পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠতে হয়। শিক্ষক হবার চেয়ে কে কতো বড় নীল গোলাপী সাদা উঠতে পারছে তার প্রতিযোগিতা চলে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার নামে কী হচ্ছে তা বুঝতে আর অসুবিধা হয় না। সুবিধাভোগী শিক্ষকরা এসব অভিযোগ খুব জোরালোভাবে অস্বীকার করতে চান ঠিকই, কিন্তু আসলে তা আর সম্ভব হয় না। শিক্ষকদের মধ্য থেকেই নানারকম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক শরীফ উল্লাহ ভুঁইয়া। তিনি ইঙ্গিতে বলতে বাধ্য হন, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ প্রবর্তনের পর থেকে আইনটির যে সমস্ত সমালোচনা হচ্ছে তা হলো, এ আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের ক্রমাগত রাজনীতিকীকরণ বা দলীয়করণের পথে নিয়ে গেছে। শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, ‘শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ ও দলাদলি’ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘দলীয়করণ’ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে।