তরুণ প্রজন্ম ও কোরআনের খণ্ডিত আমল-সংস্কৃতি

আফসানা বেলা

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২০

তাওরাতের ভাষা ছিল হিব্রু। আর কোরআানের ভাষা আরবি। আল্লাহতায়ালা তাঁর বাণী সর্বদা কোনো একক নির্দিষ্ট ভাষায় পাঠাননি। নবিদের আবির্ভাব কোনো নির্দিষ্ট স্থান ও কালে হয়। আর তাদের কাছে বাণীও আসে তার গোত্রের ভাষাতেই। শেষ নবির (স.) মাতৃভাষা আরবি ছিল। তাই আল্লাহর পাঠানো বাণী সেই মাতৃভাষাতেই গ্রন্থিত হলো। সেই ভাষায় ওহি এলো যা নবি নিজে বুঝতেন, ও তখনকার সম্প্রদায় বুঝতো। অর্থাৎ কোরানের বা আল্লাহর কথার মূল উদ্দেশ্যই হলো বোঝানো।

নবিজির যুগে `পড়া` মানেই `বুঝা` ছিল, অন্তত অর্থ বোঝা আর বারবার পড়ুন মানে সেই বোঝা শব্দেরই গভীর মর্ম অনুধাবন করা, ধারণ করা। হযরত উমরের ভাষা ছিল আরবি। তবুও তিনি সূরা বাকারা বুঝতে আট বছর কাটিয়েছেন। কোরআন দেয়া হয়েছে আমি কোন পথে চলব, কীভাবে চলব— সেটা বোঝার জন্যই, তাই প্রতিটি মুসলিমের উপর কোরআনি জ্ঞান ফরজ। যদি কোরআন না বুঝে ঝারা মুখস্ত করা হয়, বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়তে থাকা হয়, সেখানে সওয়াবের ব্যাপার আছে (একটা হাদিসে প্রতি হরফপাঠে দশ নেকির উল্লেখ আছে); তবে, পাঠের মূল ব্যাপারই হলো ‘অনুধাবন করা’। যেখানে বুঝ নাই, সেখানে কোন পথে চলব, সেই জ্ঞান বা আমল থাকারও কথা নয়।

সাধারণত আমরা প্রথম প্রথম কোরআন থেকেই জেনে নিই না যে, নামাজ পড়তে হবে। মা-বাবার থেকে জানি। এটা ভালো। তবে মা-বাবারও উচিত, শুধু বাচ্চাদের তেলাওয়াতই না শিখিয়ে ধীরে ধীরে অর্থসহ তেলাওয়াতের দিকে ধাবিত করা। কোরআন শিক্ষা মানে কোরআন কতবার খতম দেওয়ালাম, তাও কিন্তু নয়। আমার প্রতিপালক কী বলেছেন, এটা যেন আমি নিজে কোরআন থেকে শিখে নিতে পারি, অন্তত সেই চেষ্টায় থাকা, সেটার জন্য মন তৈরি করে দেয়া অভিভাবকদের কাজ। তাহলেই আমরা আমলদার তরুণ জাতি তৈরি করতে পারবো।

কোনো হুজুরকেও আপনি যদি বলেন যে, কোরআন শিখতে চাই; তিনি নিশ্চিত বুঝবেন যে, আপনি কোরাআন তেলাওয়াত শিখতে চান। কোরানের অর্থ বোঝার সাধ আপনি যে আপনার মনের অতলে লালন করছেন, এটা হুজুরকে বুঝাতে দুই-দশ বাক্য আপনার খরচ করতে হবে। কারণ আমাদের সমাজে কোরাআন শেখা মানে এখনো তেলাওয়াত শেখানোই বোঝায়। অর্থাৎ, কোরআন পড়ার ব্যাপারে যতটা তাগিদ দেখা যায়, বোঝার ব্যাপারে ততটা নয়। আমি তাহলে যা পড়লাম, তা কোথায় কাজে লাগাবো? কোরআন থেকেই সাহাবারা শক্তি ও দিকনির্দেশনা পেতেন বা নিতেন। তারা ঈমানদার ও আমলদারও হয়েছেন কোরআনে লেগে থাকার কারণেই।

নবিও তো জীবন্ত কোরআনই। এই যুগেও সাহাবাদের মতো তরুন-তরুণী তৈরি হওয়া সম্ভব কোরআন থেকে প্রতিনিয়ত জ্ঞান ও হেদায়াত আহরণের মাধ্যমে। American Scholar প্রবন্ধে এমারসন বলেছিলেন, ‘জ্ঞান পরিপক্ব হয় চর্চার মাঠে।’ আর এই চর্চীয় বিষয়গুলো আমাদের মূল উৎস থেকে প্রথমে গ্রহণ করার চর্চা করতে হবে। কোরানের জ্ঞান আমাদের আমলে উদ্বুদ্ধ করবে, আর আমল কোরাআনের জ্ঞানের সত্যতা ও শক্তির নিশ্চয়তাবোধ তৈরি করবে আমলকারীর মধ্যে। সাহাবিদের যুগে কোরআন পাঠ, বোঝা ও আমল একসাথেই চলতো। আর এ-যুগে সব কিছুর বিচ্ছেদ ঘটেছে— যে পড়ে সে বোঝে না, যে বোঝে সে আমল করে না, আর যে আমল করে সে তার ইচ্ছেমতো নির্বাচিত আমল করে।

কোরআন না বুঝে পড়ার কারণে আমাদের তরুণদের মধ্যে আমলের প্রয়োজনীয়তার খণ্ডীকরণ ও আমলের সামাজিকতা সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে। যেমন: রোজার মধ্যে সবার সামনে একটু পানি খেয়ে দেইখেন, সবাই যে চাউনি দেবে, আপনার ভস্ম হয়ে যাওয়ার দশা হবে। অথচ কারো নামাজ পড়ার সময় চলে যাচ্ছে দেখেও বন্ধু-বান্ধুবীরা সেই চাউনি কিন্তু কেউ আপনাকে দেবে না। পর্দা বলতে যা বোঝায় (ছেলেদের বা মেয়েদের ক্ষেত্রে) আপনি সেটা পালন না করলেও কিন্তু সেটা ভাবার কোনো বিষয়ই হবে না। বরং এক্ষেত্রে s/he is jolly and smart বলেই গণ্য হবে।

আমি বলছি না যে, রোজার মধ্যে সবার সামনে যেয়ে কুড়মুড় করে খাবেন বা কে নামাজ পড়ল বা কি করল না সেটা নিয়ে তার সাথে মারামারি করতে যাবেন। কথাটা হচ্ছে যে, আমরা selective piety বা নির্বাচিত ধার্মিকতা রোগে আক্রান্ত। তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, এই জেনারেশনে ধার্মিকতাও সামাজিকতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে ফাঁক-ফোকরে (যা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতে পারে)। আমরা প্রায়ই শালীনতা, সভ্যতা, এমনকি ধার্মিকতাও ‘কেমন দেখা যায়’ দিয়েই মাপি। রোজার মধ্যে পানি খাওয়া ব্যক্তিটির উপর ‘ওহ আল্লাহ’ চাউনি দেয়াটা সেই ‘কেমন দেখা যায়’ এরই অংশ। তবে এটাও ভাবা দরকার যে, বেশির ভাগ মানুষ যখন দ্বীন পালন করে, তখন না পালন করাটা অস্বাভাবিক দেখায়। তার মানে, দরকার এমন এক সমাজ গঠন যা দ্বীনি অনুভব ও চেতনাসম্পন্ন হবে। সমাজ অনেক সময় ব্যক্তির অনেক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। একক ব্যক্তিও গোটা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে, এমন নজিরও আছে। এটা মনুষ্য বাস্তবতা।

আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি, যখন তরুণরা দাড়ি রাখে অনেকে প্রশ্ন করে, এই অবস্থা ক্যান? মজনু হয়ে গেলা নাকি? দূর্ভাগ্যবশত তরুণদের গালে দাড়ি না থাকলেই এই প্রশ্নটা উদয় হওয়ার কথা ছিল। একজন মুসলিম তরুণের গালে দাড়ি না থাকাটাই অস্বাভাবিক, থাকাটা নয়। ভাইভা-ইন্টারভিউ বা পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় সভ্য সাজতে ক্লিন শেভ করে যাওয়া হয়তো এই কারণেই হয়। কারণ দাড়িটা ব্যাকডেটেড হিসেবেই আমাদের বেশির ভাগের মাথায় আছে। অথচ backdatedness lies in the head, not in the cheek. তবে ইদানীং বলিউডি নায়কদের খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে অনেক তরুণই দাড়ি রাখছে। তার মানে, মানুষ বিজয়ী সংস্কৃতিকেই অনুসরণ করে। আবার হলিউড-বলিউডে বোরকা বা হিজাবের চল যদি কোনো কারণে বাড়ে তো আমাদের মধ্যেও তাহা বাড়িবে নিশ্চিত। অর্থাৎ, সমাজ বা ব্যক্তি অনেক সময় কায়েমি সংস্কৃতিকেই ফলো করতে ইচ্ছুক হয়।

তাই, ইসলামি জীবনকে যদি বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিজয়ী করা যায় তবে দ্বীনের সব হুকুম পালন হয়ে উঠবে সহজ ও স্বাভাবিক। ইসলামি সংস্কৃতির চিহ্ন হিসেবে দাড়ি রাখা, বোরকা-হিজাব পরা বা টাখনুর উপরে কাপড় পরা (পুরুষরা) নিয়ে মোটেও হীনমন্য বোধ করা উচিত নয়। বরং প্রতিটি জায়গায় কনফিডেন্সের সাথে ইসলামিক সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়া উচিত। এটা তরুণ-তরুণীদেরই করতে হবে ঘরে, অফিসে, রাস্তায় সর্বোপরি সমাজে। অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষরা যদি হীনমন্য না হয়, আপনি আমি কেন হবো?

তবে ধর্মীয় প্র্যাক্টিস করতে হবে আল্লাহর খুশির জন্য, নিজেকে আরও তাকাওয়াবান হওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য। ব্যক্তিগতভাবে নিয়ত হবে আল্লাহর। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে মিলে সমাজ হবে এমন যেখানে ফরজ ইবাদত পালন না করাটা আসলে লজ্জাজনক, মানুষের চোখে কী বেশি সভ্য হিসেবে বিবেচিত, তা না করা নয়। তবে সমাজে যদি ইবাদতের কায়েম থাকে তাহলে তা সঠিক নিয়ত ও কর্মবান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। কে বিয়ে করলো, দেখতে কেমন লোককে করল, তার বয়স কত, কততম করল, আর যে করলো না সে কার কারণে করল না, কবে করবে (কিউরিসিটি টু বি কনটিনিউড) এই যে এত এত জানার আগ্রহ এই একই আগ্রহ ও আলোচনা যুবকরা যদি দ্বীন জানার কাজে লাগাতো, গবেষণায় কাজে লাগাত, তবে আমাদের তরুণ গোষ্ঠী হতে পারতো উন্নত আখলাক ও আগুয়ান চিন্তার মানুষ। কোরআন বুঝের সাথে সম্পৃক্ত না থাকার কারণে আমাদের সঙ্গীদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তুও সস্তা হয়ে গেছে। যা মুসলিমদের আখলাকের সাথে মানান সই নয়।

আমরা অন্যের সুন্নত পালন নিয়ে যতটা চিন্তিত, নিজের সকল ফরজ পালন নিয়ে বা হারাম থেকে বাঁচা নিয়েও এত চিন্তিত থাকি না (গীবত মানে, পরচর্চায় লিপ্ত থাকি)। এ যেন অপরের নামাজ হলো কিনা এইটার ছিদ্রান্বেষণ করতে যেয়ে নিজের নামাজ বরবাদ করার আহাম্মকি। বা বলা যায়, টুপির ফযিলতের কথা শুনে লুঙি দিয়ে টুপি বানানো, অথচ ওদিকে ছতরের ফরজ ছুটে যায়! কেউ যদি বিয়ে করতে চায় সেক্ষেত্রে আমরা বাধা দেই। যদি একজন যুবক মনে করে তার বিয়ে করা প্রয়োজন, বিশেষ করে কোনো ছাত্র, তাহলে আমরা কী কী বলা বাদ রাখি তাকে? নিজের পরিবারই কী আগে বাধা দেয় না? খাওয়াবে কী? রিযিকও যেন মানুষের হাতে! তারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিয়ে করতে পারে এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত সেই বিবাহিত কাপল প্রেম করতে পারে যেমন বিয়ের আগে করছিল। অথচ আপনি বিয়ে ছাড়া প্রেমের নামে যেটা করবেন সেটা খুবই স্বাভাবিক লাগে আমাদের কাছে। বিয়ে করলেই `নট-প্র্যাক্টিকেল`।

অপরের ব্যাপারে নাক না গলানো, অপরের ছিদ্রান্বেষণ না করে নিজের ত্রুটি অন্বেষণ, নিজের হিসাব নিজে আগে নেয়া, এমনকি নিজের দ্বীনদারির অহংকার না করা, আসলে কোনো অহংকারই না করা, পরের জীবনে দ্বীন কায়েমের চেয়ে নিজের জীবনে দ্বীন কায়েম যে আগে দরকার, এই বোধ অনেক দ্বীনি চেতনার মানুষের ভেতরেও থাকে না। যে অভিভাবকরা যুবক ছেলেমেয়েদের তাদের প্রতি আচার-আচরণ বা চলাফেরা পছন্দ করেন না, তারা ফ্ল্যাশব্যাকে চেক করবেন যে সন্তানকে যখন আপনার সময় দিয়ে দ্বীন বুঝানোর কথা ছিল তখন আপনি কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। সন্তানের সাথে মিথ্যা বলে তাকে মিথ্যা না বলার পরামর্শ দেয়া শিক্ষার কোনো পদ্ধতি নয়, দ্বীনি শিক্ষার তো নয়ই। বাচ্চারা পরামর্শ গ্রহণ করে কম, দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বেশি। সন্তান কান্নাকটি করলে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে নিজেও মোবাইলে ব্যস্ত থাকবেন আর যখন যুবক বয়সে তাদের পাঁচবার ডাকবেন ছয়বারের সময় কান থেকে ইয়ার-ফোন খুলে জিজ্ঞেস করবে, কী? তখন ক্যামন লাগবে আপনার?

তাই অভিভাবক হওয়ার পাশাপাশি রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বও। আজকের এই বাচ্চারাই, যাদের নৈতিক শিক্ষা, আদব-অখলাক থেকে দূরে রাখা হচ্ছে, আগামীকাল ‘তরুণ প্রজন্মের সমস্যা’র জন্ম দেবে। আবার, যে অভিভাবকরা ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন তারা হালাল উপার্জন নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন না বা ফজরের নামাজ ছুটে গেলেও কিছু বলতে শোনা যায় না। অর্থাৎ ফরজ ওয়াজিব সুন্নতের গুরুত্ব বুঝে বা মেনে সন্তানদের সে অনুযায়ী আমলে উৎসাহী করেন না। বরং যে বিষয়গুলো সামাজিক প্রথার সাথে বেশি সম্পর্কযুক্ত সেগুলোতেই বেশি জোর দিয়ে থাকেন। তাই বলা যায়, ইসলামের বুঝসমৃদ্ধ তরুণ জাতি গড়ে তুলতে হলে আগে অভিভাবকদের এক্ষেত্রে নিজেদের প্রতি বিশেষ জোর দিতে হবে।