তানভীর রাতুলের দর্শনগদ্য ‘ফিলিয়া’

প্রকাশিত : মে ০১, ২০২২

ফিলিয়া বলতে বোঝানো হয়েছে শুধুমাত্র কোনো একজনের তার বন্ধুদের প্রতি এবং পরিবারের সদস্যদের, ব্যবসায়িক অংশীদারদের এবং বৃহত্তর দেশের প্রতিও এক ধরনের স্নেহপূর্ণ সম্মান বা বন্ধুত্বপূর্ণ অনুভূতিকে। ইরোসের মতো ফিলিয়া সাধারণত (কিন্তু সর্বজনীনভাবে সবসময় নয়) কারো প্রিয়জনের (ভালো) গুণাবলির ওপর নির্ভরশীল। ইরোস ও ফিলিয়ার মধ্যে এই মিলটি আশ্চর্যের সাথে ভাবায় যে, আকাঙ্ক্ষার প্রেম ও বন্ধুত্বের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য কি তাহলে যৌন সম্পৃক্ততা— আর বাস্তবে যে পার্থক্যগুলি অনুভব করা যায় তা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট কিনা। ইরোসে যৌনতার গুরুত্ব হ্রাস করার কারণেই ইরোস ও ফিলিয়ার মধ্যে পার্থক্য টানা কঠিন হয়ে ওঠে।

ইরোসের কামনাময় অনুরাগ ও আবেগপূর্ণ আকুল আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে ফিলিয়া অন্যের প্রতি স্নেহ-আদর ও গুণগ্রাহিতা বা প্রশংসা করে প্রকাশ করে। গ্রীকদের জন্য ফিলিয়া শব্দটি শুধু বন্ধুত্বই নয়, বরং পরিবার এবং নাগরিকতার সঙ্ঘ— একজনের রাজনৈতিক সম্প্রদায়, কর্মক্ষেত্র বা চাকরি ও চারিত্রিক শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্যকেও অন্তর্ভুক্ত করে। অ্যারিস্টটল তার নীতিশাস্ত্রের বইয়ে যেরকম ব্যাখ্যা করেছেন, ফিলিয়া একজনের প্রতিনিধি বা অন্যজনের নিজের স্বার্থেই অনুপ্রাণিত হতে পারে । এ ধরনের অনুপ্রেরণামূলক পার্থক্যগুলি অন্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে উদ্ভূত হয়। কারণ বন্ধুত্ব তখনই সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয় যখন একধরনের কর্মকাণ্ডের সংযোগ বা যোগাযোগ বজায় থাকে। অথবা একজনকে অন্যজনের চরিত্র ও মূল্যবোধ আনন্দদায়ক বা আকর্ষণীয় মনে হয়। বা অন্যজনের নিজেদের ভেতরকার আকর্ষণীয় গুণাবলির কারণে। এ বিষয়টি ঘটে একজনের নিজস্ব স্বার্থ নির্বিশেষে। এখানে উল্লেখ্য যে, যদি সেই আকর্ষণীয় আচরণ-অভ্যাসগুলোর পরিবর্তন হয়, তবে সেইসূত্রে বন্ধুত্বেরও অবস্থান্তর বা বদল হওয়ার কথা। বন্ধুত্বের ইংরেজি ধারণাটি মোটামুটিভাবে অ্যারিস্টটলের ফিলিয়ার ধারণার আদলে গড়া। অ্যারিস্টটল যেমন নিজেই তার রচিত অলঙ্কারশাস্ত্র গ্রন্থে লিখেছেন, যে জিনিসগুলো বন্ধুত্বের কারণ হয় তা হলো: দয়া বা উদারতা; এবং তা প্রশ্ন ছাড়াই করা; এবং কার্যসম্পন্ন হওয়ার পরেও জাহির বা প্রচার না করা।

অ্যারিস্টটল সঠিক বন্ধুত্বের জন্য মানুষ কী ধরনের জিনিসগুলো খোঁজে তা বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন ফিলিয়ার জন্য সঠিক ভিত্তিটি উদ্দেশ্যমূলক বা বিষয়গত, মানে, লক্ষ্যবস্তুসম্পর্কিত বা একটা নির্দিষ্ট অভিলক্ষ্য আছে: অন্য মানুষের মেজাজ বা স্বভাব একজনের নিজের মত, যারা একজনের প্রতি কোন ক্ষোভ পোষণ করে না, একজন যা সন্ধান করে যে অন্যজনের চাওয়াটাও সমান, যে সংযমী এবং ন্যায়পরায়ণ, যে অন্যজন একজনের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা করে যথাযথ ঠিক সেভাবেই যেভাবে একজন অন্যজনকে করে, এবং ইত্যাদি প্রভৃতি। যারা ঝগড়াটে, পরচর্চাকারী, আক্রমনাত্মক আচরণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যারা অন্যায্য ইত্যাদি ইত্যাদি, তাদের কাছ থেকে ফিলিয়াসুলভ মনোভাব নির্গত বের হতে পারে না, তাদের কাছে এমন আবেগ আশা করা যায় না। সেরা চরিত্র বা চারিত্রিক গুণাবলিগুলোই সর্বোত্তম ধরণের বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে এবং সেটা থেকে প্রেমও। প্রকৃতপক্ষে, কীভাবে ফিলিয়ার উপযোগী বা যোগ্য ভালো চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়, সেটাই হলো অ্যারিস্টটলীয় নীতিশাস্ত্রের আখ্যানবস্তু বা মূলভাব। সবচেয়ে যুক্তিবাদী ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই সবচেয়ে সুখী মানুষ; আর সেইজন্য, বন্ধুত্ব, যেটা কিনা দুজন ভাল এবং সদগুণে সমানভাবে বিরল বা অসাধারণ ব্যক্তির মধ্যে ঘটে, সেটার সর্বোত্তম রূপ ধারণে বা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম ও বন্ধুত্ব বজায় রাখার যোগ্য। অনুমান করা যায় যে, এই ধরনের অ্যারিস্টটলীয় সমতুল্য যুক্তিবাদী এবং সুখী মানুষদের মধ্যকার প্রেমটা পূর্ণাঙ্গভাবেই নিখুঁত হবে,আর এখানে সমতুল্যতা নৈতিকভাবে সর্বোত্তম থেকে অপসারিত হওয়া চেনাশোনা পরিমণ্ডল বা বৃত্তের নিম্নমানের ক্রমানুসারে সাজানো। অ্যারিস্টটল এই ধরনের ভালোবাসাকে এক ধরণের অনুভূতির আধিক্য হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

নিম্নমানের বন্ধুত্ব অন্যের সঙ্গ থেকে প্রাপ্ত আনন্দ বা উপযোগের উপর ভিত্তি করেও হতে পারে। একটি ব্যবসায়িক বন্ধুত্ব কার্যকারিতা বা উপযোগিতার উপর ভিত্তি করে তৈরী— মানে অনুরূপ ব্যবসায়িক স্বার্থের পারস্পরিক আদান-প্রদানের উপর নির্ভরশীল; ব্যবসা শেষ হলে `বন্ধুত্বেরও অবসান ঘটে। এটি সেই বন্ধুত্বের মতো যা অন্যের সঙ্গ থেকে প্রাপ্ত আনন্দের বা মুনাফার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়, অন্যজনের নিজের মধ্যে যেসব উপভোগ্য গুণাবলি আছে সেটার কারণে নয়। বরং তার কর্ম বা কৌতুক থেকে আনন্দের প্রবাহ হয়, সেটার কারণে

অ্যারিস্টটলীয় প্রেমের সর্বোচ্চ রূপের প্রথম শর্তই হলো একজন মানুষের নিজেকে ভালোবাসা। অহংবোধের ভিত্তি ছাড়া, একজন অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং স্নেহ প্রকাশ করতে পারে না। এই ধরনের আত্ম-প্রেম তাৎক্ষণিক আনন্দের অন্বেষণ বা ভিড়ের মুগ্ধতার উপর নির্ভর করে না, এ ধরনের আত্মপ্রেমকে তাই `আনন্দবাদী` বা ফূর্তিবাজ ও মহিমান্বিত প্রচার বলা যায় না। বরং এটা একজনের মহৎ উন্নতচরিত্র এবং নৈতিক উতকর্ষসম্পন্ন বা নীতিবান সাধনার প্রতিফলন, যা প্রতিফলিত জীবনের চিন্তাশীল অন্বেষণে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। একজনের অন্যদের সাথে বন্ধুত্বের প্রয়োজন "যেহেতু একজনের উদ্দেশ্যই হলো উপযুক্ত `কর্ম` বা আচরণ নিয়ে চিন্তা করা... আনন্দদায়কভাবে বেঁচে থাকা... আলোচনা এবং চিন্তাভাবনায় অংশ নেয়া", যেমনটি ঠিক গুণী একজন মানুষ এবং অন্যজন বন্ধুর জন্য প্রযোজ্য। নৈতিকভাবে গুণী মানুষটি তার নীচের মানুষদের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্য; তিনি বিনিময়ে সমান ভালোবাসা দিতে বাধ্য নন, যা আসলে বোঝায় যে প্রেমের অ্যারিস্টটলীয় ধারণাটি অভিজাত বা পরিপূর্ণতাবাদী: সমস্ত বন্ধুত্বের মধ্যে অসমতা মানেই হলো প্রেমও সমানুপাতিক হওয়া উচিত। অর্থাৎ একজন অন্যজনের চেয়ে যত বেছি ভালো তার তত বেশি ভালোবাসা উচিত। যদিও সবারটা সমান নাও হতে পারে, তথাপি অ্যারিস্টোটেলীয় প্রেম এবং বন্ধুত্বের একটি শর্তই হলো পারস্পরিকতা বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। যদিও পিতামাতার ভালোবাসায় একতরফা স্নেহার্দ্রতা জড়িত থাকতে পারে।

লেখক: ড. এস. তানভীর রাতুল; এফআরএসএ, এফআরএসএল
অধ্যাপক, স্কুল অব হিস্টোরি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচার (ইতিহাস, ভাষা ও সংস্কৃতি)
পরিচালক, সেন্টার ফর নিউ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং
লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়