দেবাশীষ তেওয়ারীর স্মৃতিগদ্য ‘তিন কন্যা’
প্রকাশিত : মার্চ ০৮, ২০২১
এক.
মহাখালী রেললাইন ধরে হাঁটছি, প্রচণ্ড মন খারাপ। মালেশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ভর্তি বাবত মায়ের সারা জীবনে জমানো প্রায় পুরোটা টাকা দিলাম। ভিসা হলো, কিন্ত ওয়ারিশে সূত্রে পাওয়া এক টুকড়ো জমি বিক্রি করা গেল না। জমির কাগজপত্র বৃটিশ আমলে আমাদের নামে হলেও পাকিস্তান আমলে সেই জমি শত্রু সম্পত্তি হয়ে ছিল। বিক্রি করতে গিয়ে জানা গেল, এ জমি বিক্রি করা যাবে না।
মানে টিউশন ও বিমানভাড়া জোগার না করতে পারার জন্য ভিসা ক্যানসেল। টাকাটাও আর ফেরত পাওয়া যাবে না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো, কানে কিছু শুনছি না। ট্রেনের প্রচণ্ড হুইসেল শুনছি কিন্তু রেললাইন ধরে যে হাঁটছি, সে খেয়াল নেই। একটা হেচকা টানে রেললাইন থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো বছর বিশ একুশের গার্মেন্টসে কাজ করা বরিশালের মেয়ে নাজমা, আর সেকেন্ডের মধ্যে ট্রেনটা বহুদূর চলে গেল।
দুই.
এক ইন্ডিয়ান ও এক পাকিস্তানি পরিচিতকে নিয়ে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের জন্য আইফেল টাওয়ারের নিচে। তুষার ঝরছিল। আঙ্গুরের রস পান করছিলাম, পাশেই ছিল এক যুগল, ছেলেটা আইরিশ মেয়েটা ফ্রেঞ্চ। লোকজন খালি হতে শুরু করলে ছেলেটা আমাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ইউ ফাকিং পাকী! ইউ ইউএন্ড ইউ আর ফাকিং পাকীস! আমি যেহেতু পাকী না, গালিটা আমার গায়ে নেইনি, না শোনার ভান করলাম। একবার, দুইবার... তারপর
পাকিস্থানির পক্ষে দাঁড়ালাম, আমরাও তুমুল ঝগড়া করলাম, হাতাহাতি হলো, হাল্কা উত্তমমধ্যমও হলো। পুলিশ এলো।
আমাদের দাঁড় করিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল পুলিশ, প্রথম গালি কে দিয়েছে?
আমার বয়ফ্রেন্ড।
প্রথম হাত কে উঠিয়েছে?
আমার বয়ফ্রেন্ড।
এই বিদেশি ছেলেগুলোর কোনো দোষ আছে?
না, সব দোষ আমার বয়ফ্রেন্ডের।
যদিও পুলিশ ওর ডাকে এসেছিল, অভিযোগ ওর বিরুদ্ধে লিখে নিয়ে আমাদের দুই দলের দুই দিকে চলে যেতে বলল। মেয়েটা বলল, ও আসলে এতটা রেসিস্ট না। এলকোহল পেটে পড়লে ও এমনই করে, কিছু মনে করিস না। পুলিশের জরিমানা খেলে সোজা হয়ে যাবে। ভালো থাকিস, বলে সবার সামনেই বিদায়ী চুমু খেল। যেতে যেতে ওকে ফেসবুকের আইডিটা দিয়ে গেলাম।
তিন.
একরাতে বার্লিনে শেষ বাস মিস করে পায়ে হেঁটে মধ্যরাত্রে বাসায় ফিরছি। ব্রিজের উপড় একদল যুবক, কাছে আসতে কানে ঢুকলো এরকম মাকড় আমি টিপে টিপে একাই একশো মেরে ফেলতে পারবো, জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে।
আর আগানোর সাহস পেলাম না, একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পুলিশ কল করবো কিনা ভাবছি, মাথা আধা ন্যাড়া করা একটা পাংক মেয়ে সাইকেল নিয়ে আমাকে ক্রস করে সামনে চলে গিয়ে ফের ফিরে আসলো, তুই সামনের আবাসনে থাকিস না? এই মাতালগুলোকে ভয় পাচ্ছিস? চল আমার সাথে।
আমিও সাথে সাথে চললাম।
লেখক: কবি