নাটক ও নাট্যকলা: দীর্ঘ পথ চলা

পর্ব ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০

নাট্যকার ইস্কাইলাস মানবিক আবেগ অপেক্ষা জগতের নৈতিক নিয়ম প্রতিপাদনের দিকেই অধিক দৃষ্টি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, মানুষের পাপে জগতের নীতিনিয়ন্ত্রিত সামঞ্জস্য ক্ষুণ্ণ হয়। পাপ থেকে পাপেরই জন্ম হয় এবং দোষী ও নির্দোষ উভয়েই দুঃখ ভোগ করে। জীবন দর্শনের দিক থেকে ইস্কাইলাসের প্রবণতা ও আগ্রহ ছিল ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি। ইস্কাইলাস মহৎ ও নৈতিক আদর্শস্থাপনে প্রয়াসী ছিলেন। যদিও ইস্কাইলাস নাটক দ্বারা মানুষের মনকে ধর্মের পথে পরিচালিত করার কথা বলেছিলেন, বাস্তবে তাঁর নাটক অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটাই করেছে। সেই সঙ্গে তিনি অবশ্য মানুষের মৌলিক মর্যাদাবোধের প্রতিও আনুগত্য দেখিয়েছেন। ইস্কাইলাসের সাথে সফোক্লিসের চিন্তার পার্থক্য খুব সামান্য। কিন্তু ইউরিপিডিসের সাথে পার্থক্য ছিল ব্যাপক। সফোক্লিসের কাছে ঈশ্বর বা নিয়তির যেমন গুরুত্ব, তেমনি মানুষেরও। দুটোকেই তিনি সমান মর্যাদা দিয়েছেন। মানুষের নিজস্বতা ও নিয়তি; এ দুয়ের টানাপোড়েনেই মানুষের জীবনকে দেখেছেন সফোক্লিস। সফোক্লিসের নাটকে মানুষের পতন ও বিপর্যয় পূর্ব থেকেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। অপর পক্ষে ইউরিপিডিস ঈশ্বর ও নিয়তির চেয়ে মানুষকে ও মানবিক মর্যাদাকে অধিকতর মূল্য দিয়েছেন। ঈশ্বর, নিয়তি বা ধর্ম সম্পর্কে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। ইউরিপিডিস ধর্ম, যুদ্ধ ও নারী-সমাজ সম্বন্ধে সমসাময়িক যুগের ধারণাকে কঠোর আঘাত করেছিলেন। বিয়োগান্ত বা শোকগাথা নাটককে তাঁর আগের লোকদের চেয়ে বাস্তব জগতের অনেক কাছাকাছি এনেছিলেন ইউরিপিডিস। তাঁর নাটকে সামান্য হলেও নিচু-শ্রেণীর জীবন এসেছে। এথেন্সে সামগ্রিকভাবে যে নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা দেখা দিয়েছিল, নাটকে তার রূপায়ণে তিনিই ছিলেন অগ্রদূত।

নাট্যকার য়্যারিস্টফেনিস ইউরিপিডিস সম্পর্কে যে-সব ইতিবাচক অভিযোগ তুলেছিলেন তা হলো; তিনি প্রচলিত দেবদেবীদের মানেন না। ইউরিপিডিস সম্পর্কে দীর্ঘ অভিযোগে য়্যারিস্টফেনিস বলেন, তিনি নিজের মতো করে সব দেবতা খাড়া করেছেন। ইউরিপিডিসের নাটক দেখে ছেলে-ছোকরারা বখে যাচ্ছে। ব্যায়াম, খেলাধূলা আর লড়াই ছেড়ে তারা শুধু কে-কী-কেন এই সব প্রশ্ন করতে শিখেছে। তারা শুধুই তর্ক করে, দোষগুণ বিচার করে কিন্তু নিয়ম কানুন মানতে চায় না। সাধারণ মানুষের জীবন থেকে তিনি তাঁর নাটকের মালমশলা এমনকি গানের সুর জোগাড় করেছেন। অভাব অনটন ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে লোককে সজাগ করাই তাঁর লক্ষ্য। নাটক সম্পর্কে প্লেটোর ভয় তাহলে অমূলক ছিল না। ইউরিপিডিসের নাটক দেখে লোকের মন অধর্মের পথে গেছে, য়্যারিস্টফেনিস নিজেই এই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। নারী স্বাধীনতার পক্ষে মিডিয়া নাটক লেখার জন্য ইউরিপিডিসকে দেশ ছাড়া করা হয়েছিল। আসলে ইউরিপিডিসের ছিল যুক্তিবাদী মন। কিন্তু এ ব্যাপারে ইউরিপিডিসের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন য়্যারিস্টফেনিস।

নাট্যকার য়্যারিস্টফেনিস সম্পর্কে বলা হয় যে, তিনি মানুষের কেমন হওয়া উচিত নয় তাই চিত্রিত করেছেন তাঁর নাটকে। তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু তিনি নিয়েছেন সমসাময়িক রাজনৈতিক, সামাজিক ঘটনা ও সমস্যা থেকে, তারপর তাকে গড়ে তুলেছেন কল্পনা দিয়ে। মানুষের ভণ্ডামি, মিথ্যাচার, লোভ ও দুর্বলতা নিয়ে নির্মম ব্যঙ্গ ও পরিহাসই তাঁর নাটকের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল। য়্যারিস্টফেনিস প্রকৃতই অত্যন্ত শক্তিশালী নাট্যকার ছিলেন। ব্যঙ্গ নাটক বা কমেডির ভুবনে যতোরকম কলাকৌশল আছে তিনি তাঁর নাটকে প্রায় সবগুলোই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। সমকালীন অসাধু ও অযোগ্য বহু রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মচারীকে তিনি তাঁর নাটকে কাঠোর সমালোচনা করেছেন। এরজন্য তিনি বহু শক্তিশালী শত্রু সৃষ্টি করেন। বিশেষ করে ভেক নাটকে রাজনীতিবিদ ক্লিওনকে বিদ্রুপ ও সমালোচনা করার জন্য এথেনীয় পরিষদের বিচারে নাট্যকারকে মোটা অংকের অর্থ জরিমানা দিতে হয়েছিল। নাট্যকার উক্ত নাটকে সমকালীন এথেন্সের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর গভীর উদ্বেগের কথাটা গোপন রাখেননি। এমনকি সঙ্কট উত্তরণের জন্য পথ নির্দেশের ইঙ্গিত দান থেকেও বিরত হননি। তিনি নাটকের বিভিন্ন সংলাপে ক্লিগোনিসের মতো ডিমাগগদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। যারা একগুঁয়ে যুদ্ধোন্মাদ, শান্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উদাসীন, অতি-গণতন্ত্রী, এথেন্সের বর্তমান অভ্যন্তরীণ সঙ্কটময় পরিস্থিতি অনুধাবনে যারা অনিচ্ছুক কিংবা অপারগ তাদের সমালোচনা করেছেন।

য়্যারিস্টফেনিসের ভেক নাটকের কিছু সংলাপের দিকে তাকালে নাট্যকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি স্পষ্ট হবে। যেমন রাজনীতিবিদ ক্লিগোনিস সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘লোকটা আকারে ক্ষুদ্র কিন্তু নির্বুদ্ধিতায় পাহাড়ের মতো বিশাল ও নিরেট। তার মুখে কখনও শান্তি ও শুভেচ্ছার ললিত বাণী শোনা যায় না। সে বিশ্বনিন্দুক, যুদ্ধবাজ, শান্তি-বিরোধী, যেখানেই কাজিয়াফাসাদ সেখানেই তার মারমূর্তি নিয়ে সে উপস্থিত। হ্যাঁ, এই হচ্ছে ক্লিগোনিস।’ নাটকের কোরাস দলপতি এর উত্তরে বলছে, ‘নগরী তার সর্বোত্তম নাগরিকদের কী হাল করেছে সে কথা কি আমি আপনাদের বলবো? ঘটনাচক্রে সেটা খুশির কথা নয় বরং চরম দুঃখের।’ দলপতি আরো বলছে, ‘জাতির যখন সত্যিকার খাঁটি মানুষদের দরকার হলো তখনি দেখা গেল যে তাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে। সদ্বংশজাত সুশিক্ষিত ভদ্র এবং নানাগুণে গুণান্বিত মানুষদের আজ তাচ্ছিল্য করা হচ্ছে, তাদের নিন্দায় লোকে মুখর; আর দুঃখের বিষয়, যতো চোর-বদমাস-গুণ্ডা, নবাগত বিদেশি, তামার পাত মোড়ানো ক্রীতদাসদের সমাদরেই এখন সবাই ব্যস্ত।’ নাটকে তাই দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ‘হে আমার অবিবেচক, নির্বোধ বন্ধুগণ, এখনও সময় আছে আপনাদের নীতি পরিবর্তন করুন। যোগ্য লোকদের ডেকে এনে কাজে লাগান।’ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের নাটকের সংলাপ এগুলো, যার মধ্যে রয়েছে তীব্র রাজনীতি, রয়েছে রাজনৈতিক প্রচার। নাটকটির মূল কাঠামো সাহিত্যনীতি বিষয়ক এক মহান বিতর্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও তার পরতে পরতে রয়েছে সেই সময়ের গ্রীক সমাজ-সভ্যতা-রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বগুলির স্পষ্ট প্রতিভাস। নাটকের উদ্দেশ্য কী বা অতীতে নাটকের মধ্য দিয়ে কী বক্তব্য প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছে সেটা জানা ও বোঝার জন্য “ভেক” নাটকটি হতে পারে একটি বড় দৃষ্টান্ত।

নাটকটির গল্প হচ্ছে, নাট্যকলার পৃষ্ঠপোষক দেবতা দিউনিসাস এথেন্সের সাম্প্রতিক নাট্যকারদের সৃষ্টিকর্মে আনন্দ ও তৃপ্তি না পেয়ে ভৃত্য জানথিয়াসকে নিয়ে হেরাক্লিসের ছদ্মবেশে পাতালপুরীতে হেডিসের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছেন। স্মর্তব্য যে, ইতিমধ্যে ইস্কাইলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিস গ্রীসের বিয়োগান্ত নাটকের তিন শ্রেষ্ঠ নাট্যকারই মৃত্যুবরণ করেছেন। দিউনিসাসের ইচ্ছা ইউরিপিডিসকে নাট্য রচনার জন্য আবার তিনি মর্ত্যে ফিরিয়ে আনবেন। পথে দিউনিসাসের সাথে হেরাক্লিসের যে বাক্য বিনিময় হয় সেগুলো এখানে খুব উল্লেখযোগ্য। হেরাক্লিস জানতে চায়, এতো কবি জীবিত থাকতে কী উদ্দেশ্যে দিউনিসাস সুদূর হেডিস পর্যন্ত কষ্ট করে যাবে। উত্তরে দিউনিসাস বলেন, আমার এমন একজন কবি চাই যিনি লিখতে পারেন। আজকাল দুরকম কবি আছেন, কেতাদুরস্ত চতুর ও মসৃণ আর মৃত। হেরাক্লিস জানতে চান, সফোক্লিসের পুত্র তরুণ ইয়োফোনের কী হলো? দিউনিসাস উত্তরে বলেন, একমাত্র ওর মধ্যেই কিছু পদার্থ আছে, তাও আবার আমি খুব সুনিশ্চিত নই। হেরাক্লিস তখন বলেন, কিন্তু কয়েকজন তরুণ কবি তো গিজগিজ করছে আর একটার পর একটা বিয়োগান্ত নাটক লিখে যাচ্ছে। বাগাড়ম্বরের দিক থেকে সেইটিই যদি তুমি চাও ইউরিপিডিস তো তাদের কাছে তুচ্ছ।
দিউনিসাস তখন উত্তর দেয়, ওরা সব চুনোপুটি। কোনো কাজের নয়। শুধু চড়ুই পাখির মতো কিচিরমিচির করতে জানে। নিজেদের শিল্পকলার ক্ষেত্রে কলংক স্বরূপ। দ্বিতীয়বার আর তাদের নাম শোনা যায় না। ওদের সারা দঙ্গলে খুঁজে তুমি একজন সত্যিকার শক্তিশালী মৌলিক কবি পাবে না যিনি একটি আকর্ষণীয় উদ্দীপক চরণ রচনা করতে পারেন। তিনি আরো বলেন, যে কবি প্রকৃত দুঃসাহসী কিছু সৃষ্টি করতে পারেন আমি এইরকম কবির কথা বলছি।

নানারকম ঘটনার পর দিউনিসাস এবং জানথিয়াস অবশেষে প্লুটোর প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হয়। সেখানে দিউনিসাস আবিষ্কার করেন পাতালপুরীর প্লুটোর ভোজসভায় ট্র্যাজিক বা বিয়োগান্ত নাট্যকারের জন্য সংরক্ষিত সম্মানিত আসনে কে বসবে তা নিয়ে ইউরিপিডিস দেখা গেল ইস্কাইলাসের সঙ্গে সাংঘাতিক বিবাদে মগ্ন। বিবাদের এক পর্যায়ে প্লুটো ঠিক করলেন, এই দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তার সিদ্ধান্ত হবে একটি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। প্রতিযোগিতার পর্বে দুই নাট্যকারের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিসের বিবাদের মধ্যে আমরা সাহিত্যের সেই চিরন্তন বিবাদেরই সন্ধান পাই, আদর্শবাদ ও বস্তুবাদের বিবাদ। ইস্কাইলাস দেখিয়েছেন, জীবন যা হওয়া উচিত আর ইউরিপিডিস দেখিয়েছেন, জীবন যা হয়। দুজনের এই বাকযুদ্ধ ইউরিপিডিস ও ইস্কাইলাসের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে য়্যারিস্টফেনিসের নিজস্ব মূল্যায়ন ছাড়া আর কিছু নয়। পূর্ব যুগের দুই নাট্যকারের নাটককে মূল্যায়ন করবার জন্য ভিন্ন এক নাটক লিখে বসেছেন য়্যারিস্টফেনিস আড়াই হাজার বছর আগে। য়্যারিস্টফেনিসের সেই চিন্তাশক্তি নিয়ে ভাবতে গেলে অবাক লাগে। য়্যারিস্টফেনিসের নাটকের সেই বাকযুদ্ধে নাট্যকার ইস্কাইলাস নাট্যকার ইউরিপিডিসকে প্রশ্ন করছেন, বলতো একজন ভালো কবির কী কী গুণ থাকা দরকার? ইউরিপিডিস উত্তর দিচ্ছেন, আঙ্গিক নৈপূণ্য, নীতি শিক্ষাদানের ক্ষমতা, জনসাধারণকে উন্নততর নাগরিকে রূপান্তরিত করার দক্ষতা।

প্রাচীন গ্রীসের নাটক রচনারীতির একটি স্পষ্ট চেহারা পাওয়া যায় ইস্কাইলাস ও ইউরিপিডিসের সংলাপ থেকে। ইস্কাইলাস বলছেন, ‘দেখুন না, একেবারে সেই আদি যুগ থেকে সত্যিকার বড় কবি মাত্রই মানুষকে উপকারী ও উপযোগী কিছু একটা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। অরফিউস আমাদের শিখিয়েছেন যে হত্যা করা অন্যায়। মিউসিয়াস শিখিয়েছেন কেমন করে রোগব্যাধি সারিয়ে তোলা যায়। হেসিয়ডের কাছ থেকে আমরা শিখেছি কৃষি এবং চাষাবাদের সময় সম্পর্কিত তথ্য।’ ইস্কাইলাস সেখানে হোমার সম্পর্কে বলছেন, হোমারের রচনায় রয়েছে মূল্যবান সামরিক শিক্ষার উপকরণ। সংগঠন, প্রশিক্ষণ, সাজ সরঞ্জাম সব রয়েছে সেখানে। নিজের নাটক থিবীর বিরুদ্ধে সপ্তসুর সম্পর্কে ইস্কাইলাসের বক্তব্য, ‘ওই নাটক দেখার পর সোজা সেখান থেকে উঠে শত্রুকে নিধন করতে যাওয়া ছাড়া কারো কোন গত্যন্তর নেই।’ নিজের ‘পারসিক’ নাটক সম্পর্কে বলছেন, ‘বিজয়ের অদম্য ইচ্ছাশক্তি সম্পর্কে চমৎকার বক্তব্য আছে সেখানে। আমার সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক।’ তিনি আরো বলছেন, ‘আমি পেট্রোক্লাস ও টিউসারের মতো সিংহহৃদয় বীর সৃষ্টি করেছি, যেন সংগ্রামের ডাক এলে দর্শকবৃন্দ তাদের সঙ্গে একাত্ম হবার অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারেন।’ তারপরই ইউরিপিডিসের নাটকের সমালোচনা করে বলছেন, ‘ফ্রেইডা কিংবা স্থেনেবিয়ার মতো কুলটা দিয়ে আমি কখনো আমার মঞ্চ আকীর্ণ করে তুলিনি। এ রকম ঘটনা সত্যিই ঘটে কিন্তু কবির উচিত সে সম্পর্কে নীরব থাকা, সবার সামনে অনুকরণের জন্য মঞ্চে উপস্থিত করা নয়। বিদ্যালয়ের বালকদের শেখাবার জন্য রয়েছে শিক্ষক, প্রাপ্তবয়স্কদের শেখাবেন কবি ও সাহিত্যক। আমরা যা শেখাই তা যেন যথার্থ এবং সঠিক হয় তা দেখা আমাদের কর্তব্য।’

ইস্কাইলাসের কথা শেষ হবার পর ইউরিপিডিস নিজের রচনা সম্পর্কে এই নাটকে মন্তব্য করছেন, ‘আমার নাটকে প্রথম চরিত্রটি মঞ্চে প্রবেশ করে একেবারে শুরুতেই নাটকের পটভূমি ও উৎস পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করে দেয়। নাটক শুরু হয়ে গেলে আমি কাউকে খামোখা আলসেমি করতে দেইনি, সবাইকে খাটিয়ে নিয়েছি। মহিলা আর দাসদাসী, প্রভু, অল্পবয়সী অবিবাহিতা মেয়ে আর ধুমসী বুড়ী, সবাই সংলাপ উচ্চারণ করেছে।’ নিজের নাটক সম্পর্কে ইউরিপিডিস আরো বলছেন, ‘আমি তাদের শিখিয়েছি কীভাবে দেখতে হয়, পর্যবেক্ষণ করতে হয়, ব্যাখ্যা দান করতে হয়। আমি তাদের শিখিয়েছি যেন কখনো হুট করে বাইরেরটা দেখে কোনো স্থির ধারণা না করে বসে, যেন প্রথম সবচাইতে খারাপটাই সন্দেহ করে। আমি লিখেছি চেনা জানা সাধারণ বিষয় নিয়ে, যেসব বিষয় সম্পর্কে দর্শককূল সুঅবহিত, যেন প্রয়োজন হলে তারা আমার কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারে। লম্বা-চওড়া কথার বহর দিয়ে আমি তাদের অজ্ঞান করে দিতে চাইনি।’ নিজের নাটক সম্পর্কে ইউরিপিডিস আরো বলছেন, ‘দশর্ক শ্রোতাদের মাথা খাটাতে শিখিয়েছি, নাটকের মধ্যে খানিকটা যুক্তি ঢুকিয়েছি। জনসাধারণ আমার কাছ থেকেই শিখেছে কেমন করে চিন্তা করতে হয়, কেমন করে তাদের ঘর সংসার চালাতে হয়, কেমন করে প্রশ্ন করতে হয়?’ কিন্তু ইস্কাইলাস আবার ইউরিপিডিসের নাটকের বিরুদ্ধে অভিযাগ তুলছেন এই বলে, ‘তোমার রঙ্গমঞ্চ শুধু কানা-খোঁড়া আর ভিক্ষুকের মতো সাধারণ চরিত্রে পরিপূর্ণ।’ ‘দেবতাদের দু চোখে দেখতে পারো না তুমি’। ‘তারপর তুমি মানুষকে শিখিয়েছো সারাদিন শুধু বকুনি আর কথার কচকচিতে ডুবে থাকতে। কুস্তির আখড়াগুলি এখন খালি পড়ে থাকে। জোয়ান ছেলেপেলেরা এখন যতসব ওচাঁ জায়গায় জড়ো হয়ে বিতর্ক করা শিখছে এবং শুধু যে সেটাই শিখছে তা নয়, শুনছি সাধারণ নাবিকরা পর্যন্ত নাকি এখন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্ক করে। আমার সময় তো মুখ বুজে হুকুম তামিল করা ছাড়া তারা টুঁ শব্দটি করতো না।’

কী দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তাহলে? নাট্যকলা তার যাত্রার শুরুতেই ঈশ্বর, নিয়তি বা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের মধ্যেই নাটকের উপাদানের সন্ধান করেছে। সকল কিছুর সাথে মানুষের বাস্তব জীবন ব্যবস্থা থেকেই নিয়েছে তাদের নাটকের ঘটনা ও উপাদানসমূহকে। সফোক্লিস ঈশ্বর ও মানুষকে সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলেও তাঁর “আন্তিগোনে” নাটকে মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বেশ জোর দিয়েই বলেছেন। শাসকের বিরুদ্ধে আন্তিগোণে সেখানে বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহ করে একা নিজের আদর্শ রক্ষার জন্য। নিজের মামা ক্রেয়ন হচ্ছে তখন রাজা, কিন্তু শাসক ক্রেয়ন রাজনৈতিক স্বার্থে বিধান পাল্টাতে দেয় না। ব্যাপারটা ক্রেয়নের একার হাতে নয়, রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যেতে পারে না ক্রেয়ন। নিজের পুত্রের বাগদত্তাকে মৃত্যুর মুখে পাঠায়। শেষ মুহূর্তে আন্তিগোনে মৃত্যুবরণ করলেও পরবর্তী মানুষদের কাছে এই সত্য রেখে যায় যে, প্রয়োজনে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়তে হলে মৃত্যুকেও তুচ্ছ জ্ঞান করতে হবে। রাষ্ট্র যে শুধু একজন ব্যক্তির অধীন নয়, কতোগুলি বিধানের বন্ধনে বাঁধা; রাজা নিজে চাইলেও সে বিধান রাতারাতি উল্টাতে পারে না। মানুষ এখন জানতে পেরেছে, আন্তিগোণে একা বিদ্রোহ করে প্রাণ দিতে পারে; কিন্তু একজনের বিদ্রোহে সমাজ পাল্টায় না।। মানুষ ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে নাগরিকদের ভালোবাসা বা ঘৃণা দুটোই অর্জন করতে পারে। কিন্তু বিধান পাল্টাবার জন্য দরকার গণবিপ্লব। সফোক্লিস তাঁর সময়কালে এই গণবিপ্লব বুঝতেন না। মানুষ ইতিহাসের অনেক পথ পার হবার পর সমাজ-রাষ্ট্র পাল্টাবার জন্য গণবিপ্লবের ধারণা লাভ করেছে। মানুষ রেনেসাঁর পর কিছুটা গণবিপ্লবের চিন্তায় সচকিত হয়। কিন্তু সেই চেতনা তখনো স্পষ্ট নয়। শেক্সপিয়রের জুলিয়াস সীজার নাটকে সামান্য গণচেতনা ধরা পড়ে মাত্র, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। ফলে প্রাচীন গ্রীসের নাটকে কারোই গণচেতনা বা গণবিপ্লব আশা করার কথা নয়। নাট্যকার নিজের সমাজ বাস্তবতার বাইরে গিয়ে খুব বেশি দূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারেন না। সকলের চিন্তা প্রায়ক্ষেত্রেই নিজ সমাজকালের গণ্ডীতে বাঁধা পড়ে থাকে।

ইস্কাইলাসও তাঁর ‘শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস’ নাটকের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দেবতাদের মানুষের বন্ধু হিসাবে পেতে চেয়েছেন অন্যদিকে তেমনি দেবতাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতিত মানুষকে বিদ্রোহী হতে বলেছেন। শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস নাটক পরবর্তীকালে মানুষকে এটা বুঝতে শেখায়, মানুষ কখনো কেবলমাত্র কল্পনায় দেবতা সৃষ্টি করেনি; বাস্তবিক কারণে সেই কল্পনা এসেছে মানুষের আদলে। সেজন্য দেবতাদের চরিত্রে ন্যায় অন্যায়, কামুকতা আর বিদ্রোহ সব কিছু লক্ষ্য করা যায়। মানুষের চেয়ে দেবতাদের ক্ষমতা বা গুণগুলিকে কিছুটা বড় বা অতিরঞ্জিত করে দেখিয়েছে মাত্র। বিভিন্ন কার্যকারণ থেকে দেবতাদের সৃষ্টি। ফলে মানুষের যে ধর্মীয় জীবন, বিভিন্নভাবে যা চলে এসেছে নানা পরম্পরায়; স্মরণ রাখতে সেখানে রয়েছে মানব মনের সৃষ্টিশীলতা। মানব মনের নানা প্রশ্নের জবাব হিসেবে এসেছে তা, মানুষ নিজের সম্পর্কে জানবার আগ্রহ থেকে সৃষ্টি করেছে দেবতাদের নিজেদের সেই জ্ঞানের উন্মেষকালে। ইতিহাসের বিবর্তনে, সভ্যতার অগ্রগতিতে যার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ফলে গ্রীসের জীবনে বহু দেবতার দেখা মিললেও, কখনো তারা প্রশ্নেও উর্ধ্বে ছিল না। মানব সেবার কাজ না লাগলে দেবতারা বাতিল হয়ে যেতো। প্রমিথিউস দেবতা হিসেবে নাটকের চরিত্র হয়ে এলো, মানুষের বন্ধু হিসেবে। মানব সভ্যতার পক্ষে সে দেবতাদের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে। মানব সভ্যতার বিকাশে যে আগুনের প্রয়োজন ছিল, প্রমিথিউস সে আগুন চুরি করে এনে মানুষের হাতে তুলে দেয়। নিজে সেজন্য নানান অত্যাচারের শিকার হয়েও, ন্যায় কর্তব্য পালন করতে দ্বিধা করে না। নাট্যকার একজন স্বর্গের দেবতাকে সামনে নিয়ে এসে দর্শকদের কাছে এ কথা বলতে চায়, শত অত্যাচারেও নিজের কর্তব্য থেকে সরে দাঁড়িও না। ফলে প্রাচীন গ্রীসের নাটক যে উদ্দেশ্যহীন ছিল না সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। বরং তা গণতান্ত্রিক এথেন্সে এতোবেশি উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিল যে, শাসকরাও নাটক সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। চলবে