নামাজে মন ফেরানো

পর্ব ৭

শারিন সফি অদ্রিতা

প্রকাশিত : জুলাই ১৬, ২০২০

আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু, ওয়াত্ তইয়িবাতু— অর্থ, সকল অভিবাদন ও সম্মান আল্লাহর জন্য, সকল সালাত আল্লাহর জন্য এবং সকল ভালো কথা ও কর্মও আল্লাহর জন্য।

আমরা একজন আরেকজনকে কথার শুরুতে অভিবাদন জানাই সালাম দেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আল্লাহকে আমরা আসসালামুয়ালাইকুম বলতে পারি না। কারণ, আল্লাহ নিজেই সালাম, সকল শান্তির মালিক। তাকে আমরা বলতে পারি না, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। সেজন্য তাশাহুদের প্রথম অংশ উৎসর্গ করা হয়েছে আল্লাহকে রাজকীয়ভাবে অভিবাদন করে।

ইমাম শাফিঈ (রহ.) বলেন, আপনি যখন কোনো রাজার প্রাসাদে প্রবেশ করবেন, অন্যান্য দশজনকে যেভাবে সম্বোধন করেন, সেভাবে কিন্তু রাজাকে ডাকবেন না। আল্লাহ সুবহানাতা`য়ালা হচ্ছেন রাজাদের রাজা! আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু রাজার জন্যে সম্ভাষণ। সকল অভিবাদন, সম্মান, ভালো কথা ও কাজ কেবল মাত্র আল্লাহরই জন্যে।

আসসালামু আলাইকা আইয়্যুহান নাবীয়্যু ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু— অর্থ, হে নবি, আপনার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত বর্ষিত হোক। এখানে আমরা প্রিয় রসূলকে (সা.) আমাদের সালাম ও দুয়া দিচ্ছি। আমাদের দুয়ার কিন্তু আল্লাহর রসূলের (সা.) কোনো দরকার নেই। তিনি আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক উঁচু মাকামে পৌঁছে গেছেন। রসূলের (সা.) উপর দরূদ পাঠ করলে লাভটা আমাদেরই হয়। কারণ আমরা একবার রসূলকে (সা.) সালাম দিলে, আল্লাহ আমাদের জন্যে দশবার সালাম পাঠান। সুবহানাল্লাহ! স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম আসাটা গাঁয়ে কাঁটা দেবার মতন একটা ব্যাপার।

আমার মনে আছে, খাদিজার (রা.) জীবনী পড়ার সময় একপর্যায়ে পড়লাম, ফেরেস্তা জিবরীল (আ.) আল্লাহর রসূলকে (সা.) বললেন, আমার ইচ্ছা আপনি আমার এবং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত খাদিজাকে (রা.) সালাম পৌঁছে দেবেন। পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, সুবহানাল্লাহ, এও কি সম্ভব? আল্লাহর কাছ থেকে স্বয়ং সালাম পাওয়া? এ কোন পর্যায়ের আনন্দ আর সম্মান? আমার মতন অধম বান্দার কাছে কি কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম আসবে? নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে, তার বিনিময়ে আল্লাহ্ তার উপর দশবার দরুদ পাঠ করবেন। (সহীহ সুনান নাসাঈ হাদিস ১২৯৭)

তাশাহুদের প্রথম লাইনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহকে সাদরে সম্ভাষণ জানালাম এবং দ্বিতীয় লাইনের মাধ্যমে আল্লাহ যেন আমাদেরকে সেই সম্ভাষণের উত্তর দিলেন আমাদের দরূদ পাঠের মাধ্যমে।

আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সলিহীন— অর্থ, আমাদের উপরে এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক। এবার আমরা দুয়া করছি নিজেদের জন্যে এবং পরের অংশে দুয়া করছি আল্লাহর বাকি সমস্ত নেক বান্দাদের জন্যে। আমরা শিখছি যেন দুয়া করার সময় শুধু নিজের জন্যে না চেয়ে সবার জন্যে করি।  সলিহীন হচ্ছেন আল্লাহর খুব কাছের বান্দারা। যারা আল্লাহর পাঠানো বিধান মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাশাহুদের এই অংশটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। আমি যদি চেষ্টা করে কোনোভাবে আল্লাহর সলিহীন বান্দাদের মধ্যে একজন হতে পারি, তাহলে পৃথিবীর ১.৯ বিলিয়ন মুসলিমরা যে যখনই নামাজে তাশাহুদ পড়বে, সেটা আমার জন্যে দুয়া হিসেবে গণনাত করা হবে।

কল্পনা করা যায়, গোটা বিশ্বের মুসলিমরা দিনের মধ্যে পাঁচবার করে আমার জন্যে দুয়া করবে! এর মধ্যে না জানি আল্লাহর কত প্রিয় বান্দারা আছেন, আল্লাহর বন্ধু আছেন। তাদের সবার দুয়া পাওয়া যাবে যদি আমি সলিহীন হতে পারি। এটা আমাদের সবার জন্যে আল্লাহর প্রিয় বান্দা এবং সলিহীন হবার চেষ্টা করার পথে বিশাল এক অনুপ্রেরণা।

আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশ্হাদু আননা মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসুলুহু— অর্থ, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। তাশাহুদের শেষে এসে আমরা আবারো আল্লাহর সামনে নিজেদের দাসত্ব স্বীকার করছি। যদি এমন হয়ে থাকে যে, আল্লাহর ছাড়া অন্য কাউকে খুশি করার জন্যে এতক্ষণ নামাজ পড়েছি এবং জীবন গড়ছি স্রেফ নিজেকে নাহলে অন্যকে খুশি করতে, তাহলে এখানে এসে এটা আবার মনে করিয়ে দিলো যে, নিজের ইচ্ছা-লালসা, সোসাইটি, রেপুটেশন— সবকিছুর থেকে আল্লাহ বড়। আমরা নিজেই সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা নত করবো না, আবার নিজেই নামাজ শেষ করে আল্লাহকে বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুর সামনে মাথা নত করে ফেলি।

তাশাহুদের দ্বিতীয় লাইনে আমরা রসূলের (সা.) উঁচু মাকাম সম্পর্কে ধারণা পাই। কিন্তু এই অভাবনীয় চমৎকার মানুষটিও সবার আগে নিজেকে আল্লাহর দাস বলে স্বীকার করেন। এবং আমরাও তারই সাক্ষ্য দেই। যেই মানুষটাকে আল্লাহ মনোনীত করেছেন শেষ নবি হতে, যে আল্লাহর সাথে সশরীরে দেখা করে এসেছেন সাত আসমানের উপর থেকে, তারও আল্লাহর সামনে কোনো ক্ষমতা নেই। সেখানে আমি আর আপনি কোথায় আছি বলুন? চলবে