নিতির গল্প

উপন্যাস ৩৯

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০২০

শোভন কন্টাকটরের কাছ থেকে একটা মুখবন্ধ খাম পেল। সামনে দূর্গাপূজা। শোভনের জন্য কন্টাকটরের উপহার। শোভনের মনে অসীম কৌতূহল। কত আছে? খামটা খুলে দেখল। নতুন একশো টাকার নোটের একটা বান্ডিল। দশ হাজার টাকা! প্রায় বেসিকের সমান! শোভনের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চাকরির শুরুতেই এই! পরে না জানি আরো কী চমক অপেক্ষা করছে! প্রথম মাসে বেতন পেয়ে এত খুশি হয়নি সে, এই খামটা তাকে যত খুশি করল। টাকাটার একটা সদ্ব্যবহার করতে হবে। কী করা যায়, কী করা যায়? শোভনের মনের মধ্যে ভাবনাটা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। অনেকদিন ধরে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। বুয়েট পড়ার সময় সিনথিয়ার সাথে দারুণ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মাঝে মাঝে সিনথিয়ার বাসায় যেত। আঙ্কেল-আন্টি চাকরি করতেন, বাসা ফাঁকা থাকত। দুজনের অনাবৃত শরীরের স্বাদ নিতে এর থেকে ভালো সুযোগ আর হয় না। শরীরের ব্যপারটা একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। সিনথিয়ার এক কাজিন অ্যামেরিকান সিটিজেনশিপ পেয়েছে। বয়সটা একটু বেশি। বাংলাদেশে থাকতে বিয়ে করেছিল। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সিনথিয়ার জন্য দামি দামি গিফট পাঠাত। হঠাৎ সিনথিয়া ওকে বিয়ে করে অ্যামেরিকা চলে গেল। তারপর থেকে শরীরটা যা চাচ্ছে, তা পাচ্ছে না।

চাকরি পেয়েছে কয়েকমাস হলো। বাড়িতে বিয়ের ব্যপারে কানাঘুঁষা চলছে। এর মধ্যে নিতি এসে গেল। মেয়েটাকে ঠিক বুঝতে পারে না শোভন। অন্য মেয়ে হলে এতদিনে পটে যেত। শোভন ছিপ ফেলে বসে আছে। নিতি টোপ গিলছে না। নিতি যে ধাতের মেয়ে, বাড়াবাড়ি করলে সুতো ছিঁড়ে যাবে। কী করা যায় এখন? হঠাৎ ম্যাসেজ পার্লারের কথা মনে পড়ল। আগে হাতে টাকা থাকত না, যাবার সুযোগ তৈরি হয়নি। আজ যখন মওকা মেরে দশ হাজার পকেটে চলে এলো, তখন না গেলে হয়? শোভনের তলপেটের নিচে শিরশির করে উঠল। বাইকটা হাঁকিয়ে একটা বড় শপিং সেন্টারে সামনে চলে এলো। পার্কিংয়ে বাইকটা রেখে লিফটে চড়ে টপ ফ্লোরে উঠে এলো। আহা, এতদিন পর! জিভে জল চলে আসছে শোভনের। নারী দেহের স্পর্শ পেতে শরীরটা মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। শোভন পার্লারের রিসিপশন থেকে ক্যাটালগটা চেয়ে নিল। ওয়েল ম্যাসেজ, ক্রিম ম্যাসেজ, আয়ুর্বেদা ম্যাসেজের মতো অনেক অনেক প্রকারের ম্যাসেজ আছে। আজ প্রথম দিন। সর্বনিম্ন টাকার প্যাকেজটাই গ্রহণ করল। ফুল বডি থাই ট্রাডিশনাল ম্যাসেজ। হাফ এন আওয়ার। দুই হাজার টাকা। কাউন্টারে টাকাটা দিয়ে রিসিট সংগ্রহ করল। একটা ভীতি, একটা সঙ্কোচ, একটা অজানা রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে তার জন্য। কী জানি কী হয়!

রিসিপশন থেকে একটা তরুণী তার সঙ্গ নিল। তাকে একটা রুমে নিয়ে গেল। রুমটি খুব একটা বড় নয়। সিঙ্গেল মেডিকেল বেডের মতো একটা বেড রয়েছে রুমটির সেন্টার পয়েন্ট। রুমের কর্নারে একটা ড্রেসিং টেবিল রাখা আছে। তারপাশে একটা রাউন্ড আলনা রয়েছে। বেডের ঠিক সেন্টারে একটা আর্টিফিসিয়াল পদ্মফুল রাখা। রুমের মোমদানিতে প্রজ্জ্বলিত মোমবাতি। একটা হালকা রঙিন বাল্ব জ্বলছে। বালিশের উপরে টাওয়ের ভাঁজ করে রাখা। রুমে এসি চলছে। অ্যাটাস্ট বাথরুম আছে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর অন্য একজন তরুণী রুমে ঢুকল। ছিমছাম চেহারা। শরীরে মেদ নেই। চুল খোঁপা করে বাঁধা। পরনে স্ট্রিস কাপড়ের জিন্স। গায়ে গোলগলা টাইট টি শার্ট। উন্নত স্তন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মেয়েটি শোভনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, টাওয়েলটা পড়ে নিন, আমি একটু আসছি।

শোভন জামা-কাপড় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রেখে অনাবৃত হয়ে টাওয়েলটা পড়ল। মেয়েটি মিনিট খানিকের মধ্যেই ফিরে এলো। শোভনকে বলল, উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ুন।

শোভন বাধ্য ছেলের মতো শুয়ে পড়ল। মেয়েটি শোভনের মাথার পজিশন ঠিক করে দিল। পায়ের পাতায় নরম হাত দিয়ে আলত ভাবে ম্যাসেজ শুরু করল। মেয়েটির নরম হাত শোভনের শরীরে শিহরণ তুলছে। সমস্ত শরীরে একটা শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত উপরে উঠতে শুরু করল। পায়ের পাতা থেকে গোড়ালি, গোড়ালি থেকে জানু হয়ে হাত নিতম্বে এসে ঠেকল। টাওয়েলটা আলুথালু হয়ে গেছে। ক্রমশ পিঠ, ঘাড়, হাত, মাথায় মেয়েটির হাত ঘুড়ে বেড়াতে লাগল।

এতক্ষণ তরুণীটি নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন বেডের উপর উঠল। শোভনের পিঠের উপর হাটু গেঁড়ে বসে ম্যাসেজ করতে থাকল। মেয়েটি ঘামছে। বাইরে শীত পড়েছে, রুমে এসি চলছে, তারপরও মেয়েটি ঘামছে। দ্রুত শ্বাস পড়ছে। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটির যথেষ্ট পরিশ্রম হচ্ছে।

এতক্ষণ রুম নীরব ছিল। তরুণীটি কথা বলে উঠল, আপনি এর অগে কোথায় ম্যাসেজ নিতেন?
নিতাম, অনেক জায়গাতেই নিয়েছি।
না, আপনি এর আগে ম্যাসেজ নেন নি। এমন শক্ত হয়ে শুয়ে আছেন। মেয়েটি মৃদু হেসে উঠল।
তোমার কী করে মনে হলো আমি ম্যাসেজ নিইনি? শোভনের তীর্যক প্রশ্ন।
নিলে এমন আঁটোসাটো হয়ে থাকতেন না। মেয়েটির মুখে এখনো বিদ্রুপ মেশান হাসি? আবার বলে উঠল, এবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ুন তো।

শোভন এতক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। তরুণীটির কথায় চিত হয়ে শুল। মেয়েটির হাতে জাদু আছে। আঙুলগুলো খুব দ্রুত চলছে। চঞ্চলা হরিণীর দু`হাতের দশটা আঙুল শোভনের বুকে পেটে অবিশ্রাম ছুটে চলছে। শোভনের উত্তেজনা চরমে উঠেছে। মেয়েটি বুঝে উত্তেজনা কমানোর ব্যবস্থা করল। যেন আগুনে জল পড়ল। শোভনের শরীর শীতল হয়ে এলো। চোখ বুঁজে এলো। ঘুম ঘুম পেল। মেয়েটি টিস্যু এনে শুভ্র ফেনিল পরিষ্কার করে দিল। শোভন কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘুমিয়ে পড়ল।

হঠাৎ মেয়েটির ডাকে ঘুম ভাঙল, কী হলো, আপনি যে ঘুমিয়ে পড়ছেন?
শোভন ধরফর করে চোখ মেলে মাদকতা ভরা দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকাল। তরুণীটির মুখটা বড় শান্ত লাগছে। মোলায়েম দৃষ্টি মেলে শোভনের দিকে চেয়ে আছে। সে বলল, উঠুন, আপনার সময় তো শেষ। গোছল করবেন? নতুন টাওয়েল আছে।
শোভন বলল, দেখি?

শোভন সম্পূর্ণ অনাবৃত শরীরে বেড থেকে উঠে ওয়াশরুমে এলো। দরজাটা বন্ধ না করেই দাঁড়িয়ে প্রচ্ছাপ করল। কমোড ফ্ল্যাশ করে ঘরে ফিরে এলো। তরুণীটি টাওয়েল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার প্রশ্ন করল, গোছল করবেন?
শোভন বলল, হ্যাঁ।

ওয়াশরুমটা দেখে শোভনের গোছল করার ইচ্ছে হলো। ঝকঝকে তকতকে ওয়াশরুম। শুকনো মেঝে, গরম জলের ব্যবস্থা আছে, শ্যাম্পু, বডি ওয়াশের ব্যবস্থা আছে। শোভন প্রশ্ন করল, তোমার নাম কী?
শোভা?
ঢাকাতেই বাড়ি?
না, দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জ। ছোটবেলা থেকে ঢাকাতে আছি।
ম্যাসেজ পার্লারে কত দিন?
এই তো গত সপ্তাহ থেকে।
তুমি এসে আমাকে গোছল করিয়ে দাও। শোভনের কণ্ঠ স্বাভাবিক।

শোভনের আমন্ত্রণে শোভা শোভনকে অনুসরণ করে ওয়াশরুমে ঢুকল। শোভনের অনাবৃত শরীর। শোভা বডি ওয়াশ নিয়ে শোভনের গায়ে, মাথায় ফ্যানা করে বুলিয়ে দিতে লাগল। শাওয়ারটা অন করে শোভনের গায়ের সমস্ত ফ্যানা ধুয়ে দিল। বড় হবার পর শোভনকে এভাবে কেউ গোছল করিয়ে দেয়নি। শোভনের একটা ভালোলাগার অনুভূতি তৈরি হলো। মনে মনে বলে উঠল, মেয়েটি ভালো।

শোভনের দিকে একটা পরিচ্ছন্ন টাওয়েল এগিয়ে দিল শোভা। শোভন টাওয়েলটা নিয়ে আবার শোভাকে ফেরত দিল। বলে উঠল, না, এ টাওয়েল দিয়ে গা মুছব না। টিস্যু দাও।
কেন, টিস্যু দিয়ে কেউ গা মোছে?
মোছে না, আমি এখন মুছব।
আপনি ঘেন্না করছেন?
না, ঘেন্না না, তবে সবাই ব্যবহার করে?
এটা তো ভালোভাবে ওয়াশ করা। কোনও সমস্যা হবে না।
তবুও আমার ইচ্ছে করছে না। তুমি টিস্যু দাও।
আপনি কি হিন্দু? শোভা আচমকা প্রশ্ন করে উঠল।
কেন? এর সাথে হিন্দু-মুসলিমের কী সম্পর্ক?
টাওয়েল ব্যবহার করছেন না। মনে হচ্ছে আপনি হিন্দু।
টাওয়েল ব্যবহার না করলেই হিন্দু হবে? এ কেমন কথা?
অন্যভাবে নেবেন না, তবে আমার হিন্দুদের সাথে সম্পর্ক ভালো। একটা সোনার আংটি দেখিয়ে বলল, এটা আমার এক হিন্দু বন্ধু দিয়েছে। আমি হিন্দুদের বাড়ি খেয়েছি অনেক।
তোমার কোনও ঘনিষ্ঠ হিন্দু বন্ধু আছে ঢাকায়? শোভনের বিস্ময় ভরা প্রশ্ন।
হ্যাঁ, একটা ছেলে ছিল, অই অংটিটা দিয়েছিল, কয়েকমাস হলো সে বাড়িতে গেছে, এখন দেখা হচ্ছে না। আরেকটা মেয়ে বন্ধু আছে।
কী নাম?
রিমি। একসাথে পড়ি?
আপনি পড়াশোনা করেন?
হ্যাঁ। কেন করব না? শোভার চোখ বিস্ফোরিত!
কোথায়? শোভন প্রশ্ন করে উঠল।
সিদ্ধেশ্বরী কলেজে।
আপনি এত সব বলছেন ভয় করছে না? শোভনের কথায় কৌতুহল।
কীসের ভয়? আপনি বাঘ না ভাল্লুক? শোভা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠল।

শোভনের নিতির কথা মনে পড়ে গেল। নিতিও একই কথা বলেছিল তাকে। তবে কী তাকে গোবেচারার মতো দেখতে লাগে? কোন ভয় করে না তাকে দেখে? ভয় করবেই বা কেন? ভয় করা কি ভালো?

শোভন হাত বাড়িয়ে দিলে শোভা এগিয়ে এল। শোভাকে আলিঙ্গন করল সে। আলিঙ্গনরত অবস্থায় একটা কিস করে মানিব্যাগ খুলে দুইশো টাকা টিপস্ দিয়ে শোভন রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

বেশিরভাগ ছেলেরা মেয়েদের সামনে বড্ড নির্লজ্জ হয়ে যায়। নিজেকে অনাবৃত করতে একটুও দ্বিধা করে না। নিজেদের অনাবৃত শরীর মেয়েদের কাছে দেখানোর মধ্যে একটা মাদকতা টের পায়। মেয়েদেরকে কাছে টানতে চায় এভাবে। কতটা নির্লজ্জ হতে পারে একজন কামুক পুরুষ, সে হয়তো নিজেও জানে না।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া একজন নারীতে ছেলেদের মন কোনভাবেই তৃপ্ত হতে চায় না। এ ব্যপারে মেয়েরা বেশ শক্ত। তারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জানে। অকারণে যেখানে সেখানে নিজেকে মেলে ধরতে চায় না। মেয়েরা জানে সে চাইলেই একজন ছেলের সঙ্গ পাবে, এজন্য তাদের চাওয়াটা সীমাবদ্ধ করে রাখে। নিজেদের চারপাশে একটা অদৃশ্য গণ্ডি টেনে দেয়। হিসাব করে পা ফেলে।

ছেলেরা চাইলেও, মেয়েরা না চাইলে ছেলেরা এগিয়ে যেতে পারে না। এজন্য ছেলেদের একটা মানসিক অতৃপ্তি থাকে। এই অতৃপ্তি থেকেই ছেলেদের চরিত্রে একটা বালখিল্য আচরণ তৈরি হয়। একটা গায়ে পড়া স্বভাব। ব্যাপারটা যেন এমন, ছেলেরাই প্রপোজ করবে, তারাই ডেসপারেট হবে, তারাই মেয়েদের বাঁধার প্রাচির ভেঙে এগিয়ে যাবে। এই মানসিকতা থেকে ছেলেমেয়ে কেউই বেরিয়ে আসতে পারে না। ছেলেরা নির্লজ্জ, বেপরোয়া হয়ে যায়, অন্যদিকে বেশিরভাগ মেয়ের মনের ইচ্ছা মনেই মারা যায়, প্রকাশ পায় না।

পূজা উপলক্ষে রাধাকে একটা নতুন ড্রেস কিনে দিল সুনন্দ। কত বছর পর পূজাতে নতুন জামা হলো ওর। আটপৌরে পোশাকেই পূজা কাটত রাধার। নতুন পোশাকে ভালোবাসার ছোঁয়া লেগে আছে। এ পোশাক দাম দিয়ে কেনা যায় না। এ যে অমূল্য উপহার। রাধার মন যেন আনন্দে নাচতে লাগল। নিতি পূজায় বাড়ি চলে এসেছে। টিউশনি থেকে যে টাকাটা পেয়েছিল তা দিয়ে নিপুর জন্য শার্ট, বাবার জন্য হাফহাতা ফতুয়া, আর মায়ের জন্য কিনেছে একটা তাঁতের শাড়ি। নিজের জন্য কেনার মতো কোন টাকা আর অবশিষ্ট ছিল না। এতে একটুও মনকষ্ট হচ্ছে না তার। বরং একটা সুখানুভূতিতে হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। প্রিয়জনের জন্য কোন কিছু কিনলে যতটা আনন্দ হয়, নিজের জন্য কিনলে বোধহয় ততটা হয় না। চলবে