নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রয়াণে কবিদের শোকগাথা

ছাড়পত্র ডেস্ক

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৬, ২০১৮

মঙ্গলবার না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলা ভাষার খ্যাতিমান কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তার এই প্রস্থানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কবিরা লিখেছেন শোকগাধা। সেখান থেকে কয়েকটি ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশে—

আবু হাসান শাহরিয়ার, কবি
‘সবাই বলছে, ছবির মানুষ ছবির মধ্যে থাকলে
সেইটে শোভন হয়।
আমার প্রশ্ন, সবাই মানে কারা?
তিন তিরিক্ষে দশ বসিয়ে নিজেকে দেয় ফাঁকি,
পাওনাদারের ভয়ে
নিজের ডাকেই চমকে ওঠে, কাউকে দেয় না সাড়া,
তারা?’

চলে যাওয়ার জন্য বড়দিনই বেছে নিলেন `কলকাতার যিশু`র স্রষ্টা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি আর নেবেন না `কবিতার ক্লাস`। নষ্ট ক্ষমতাকে আর দেখবেন না `উলঙ্গ রাজা`র দৃশ্যে। অমলকান্তির রোদ্দুর হতে চাওয়া নিয়েও আর লিখবেন না কবিতা।
বড়ো শূন্যতা! অভিবাদন, হে প্রণম্য।

 

হামিদ কায়সার, কথাসাহিত্যিক
‘দিদি আসুন ময়দা ঠাসুন আজকে রবিবার
মোহনভোগের সঙ্গে লুচি চমবে চমৎকার!’
মনে আছে কবিতার ক্লাস বইয়ের এ-দুটি লাইন? যারা কবিতা লেখেন তাদের জন্য অবশ্য পাঠ্য ‘কবিতার ক্লাস’। কী আনন্দ নিয়ে যে একদা পড়েছিলাম ছন্দ শেখার এ-বইটি। আজ চলে গেলে কী হবে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, চিরদিন থাকবে তার কবিতার ক্লাস, থাকবে সব কবিতা এমনকি স্মৃতিগদ্যের সেই অনুপম বই, যার নামটি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।
শ্রদ্ধা, কবি তোমাকে!

তুষার গায়েন, কবি
ঋজু, দীর্ঘ এবং তাঁর কাব্যভঙ্গির মতোই একহারা ব্যক্তিত্বের কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যাকে শুধু কবি হিসেবে নিয়ে, বরং ছন্দ শিক্ষাদানের সহজগম্য, গভীর রসবোধসম্পন্ন এবং কার্যকরী গুরু হিসেবে তরুণ কবিরা মেনে এসেছেন বহু দশক ধরে— যাদের ভেতর আমি নিজেও একজন, তিনি অমলকান্তি রোদ্দুর হয়ে মাঠের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে রৌদ্র-ছায়ার এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে চলে গেলেন শেষমেশ সূর্যাস্তের দেশে।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, আপনি আমার অন্তর-গহীনের প্রণাম গ্রহণ করুন!

শ্রেয়া চক্রবর্তী, কবি
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল... ক্লাসে আবৃত্তি করতো যে মেয়েটি সে বুঝিয়ে দিয়েছিল কবিতার আসলে কোন মৃত্যু নেই। কবির মৃত্যু আছে। জীবিত সময় অতিক্রান্ত যে সকল মহাপুরুষ তাদেরও আছে। যেমন মৃত্যু আছে আমাদেরও। কিন্তু সে সকল মরণশীলতা কি এক? আর চেতনা? কেবল সেই কি মৃত্যোত্তীর্ণ?

আশরাফ রোকন, কবি
`ও খোকা তুই ঘুড়ি উড়া`
কে আর বলবে এমন দীক্ষাবাক্য!
কবিতার ক্লাস থেকে বিদায় নিলেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তার আত্মার শান্তি কামনা।

আশিক আকবর, কবি
`কবিতার ক্লাশ` বইটির জন্যে বাঙালি অনেক কবির প্রাথমিক প্রিয় ছন্দের শিক্ষক হয়ে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অনেক আগেই মৃত্যু বরণ করেছিলেন। গতকাল তা সবাই জেনেছে। অমলকান্তি ও অন্যান্যদের সাথে বাঁচবার লড়াইয়ে থাকবেন তিনি। আর ছন্দের শিক্ষক হিসাবে তিনি এখন অমর।
টিচার, আমি আপনার কাছ আরো কিছু শিখবো। আরো আপনাকে পড়ে।

সোহেল হাসান গালিব, কবি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর `কবিতার ক্লাস` বইটা আমার হাতে এসেছিল ক্লাস সেভেনে। জন্মদিনে আমার এক ভাই বইটা গিফট করেছিলেন, স্পষ্ট মনে আছে। কিশোর বয়সে ছন্দ শেখার দারুণ প্রেরণা ছিল বইখানা। শুধু খেয়ালের বশে ছন্দ মেলানোর জন্য দুটো সমিল পঙ্‌ক্তি বিচিত্র ঢঙে লেখা— সারাদিন এইসব নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা— কী অদ্ভুত একটা সময় ছিল!
একেকটা ছন্দ দিয়ে দুচার লাইনের একটা পদ্য বানাতাম আর বাবাকে দেখাতাম ঠিক আছে কিনা। সেই হাতিরপুলের বাসায়, জানালার পাশে, কামিনী গাছের নিচে— আমার সবচে পাঠমগ্ন দিনগুলি...
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমার প্রিয় কবি ছিলেন না কখনোই। কিন্তু এই কবির নাম উচ্চারিত হলেই সেই ঘরের মধ্যে, বিশাল জানালার পাশে এক চিলতে কাগজ নিয়ে আঁকিবুকি করা কিশোর বয়সটা ফিরে আসে। কী আশ্চর্য ব্যাপার!