পরিবেশ বিনাশের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নাটককে বহুকাল ধরে রাজনৈতিক নাটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু নাটকটির আর একটি বিশেষ দিক সমালোচক বা নাট্য-নির্দেশকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ এ নাটকের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক-পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ঘোষণা করেছেন। নাটকের বহু সংলাপে খুব স্পষ্ট করে প্রকৃতিকে বিনাশের বিরুদ্ধে নিন্দা করা হয়েছে। নাটকটি প্রধান দুটি চরিত্র রাজা আর নন্দিনী। রাজা প্রতিনিধিত্ব করছে পরিবেশ ধ্বংসের পক্ষে আর নন্দিনী তার বিরুদ্ধে কথা বলছে। নন্দিনী বিশ্ব নাটকে সেদিক থেকে এক অদ্বিতীয় চরিত্র, নন্দিনীর মধ্যে মানবিক গুণাবলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির ছন্দ। নন্দিনী এ নাটকে প্রকৃতির প্রতীক হিসেব উপস্থাপিত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা নাটকের এক বিরাট দিকপাল। যার ছোট বড় সব নাটকে রয়েছে প্রকৃতির বর্ণনা এবং ষড়ঋতুর কথা। সবগুলো  নাটকেরই গানে গানে ফুটে ওঠে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই গান যান্ত্রিক জীবন থেকে দর্শককে নিয়ে যায় প্রকৃতির কোলে। বিশেষ করে তাঁর বসন্ত, প্রকৃতির প্রতিশোধ, ঋণশোধ প্রভৃতি নাটকে প্রকৃতির বর্ণনার চমৎকার নিদর্শন মেলে এবং একই সাথে প্রকৃতির প্রতি মানুষের দায়-দায়িত্বে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। বসন্ত নাটকে প্রকৃতির প্রতি মানুষের যে দান তার কথাই কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেন নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথের নাটকের এই এক বিশেষত্ব, কোনো নাটকেই তিনি প্রকৃতিকে হারিয়ে যেতে দেন না। জীবন দর্শনে ঠাসা নাটকগুলোতে পর্যন্ত হঠাৎ হঠাৎ প্রকৃতি তার পাখা মেলেছে।

রক্তকরবীর মতো রাজনৈতিক নাটকে দেখা যাবে, প্রকৃতির প্রবাহ রক্ষা করার জন্য তিনি যন্ত্র সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কখনো যন্ত্রযুগের বাড়াবাড়িকে সমর্থন দিতে পারেননি। খনি থেকে সম্পদ তুলে এনে তা দিয়ে মানুষের প্রাচুর্যকে বাড়িয়ে তোলা কখনো তাঁর সমর্থন লাভ করেনি। রবীন্দ্রনাথ এসবের অশুভ দিক সম্পর্কে ছিলেন তীব্র সচেতন। রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকে দেখা যায় যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে আক্রোশ এবং রক্তকরবী নাটকে লক্ষ্য করা যাবে খনিজ সম্পদ আহরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বর্তমানে প্রকৃতিকে বিনাশ করে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে তা দিনের পর দিন ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লক্ষ কোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রকৃতি বিবর্তনের ধারায় যে স্বাভাবিক রূপ লাভ করেছিল, গত একশো বছরে বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণের ফলে তাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারাবিশ্ব তাই আজ পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নেমে পড়েছে।

মানুষের প্রকৃতি বিরুদ্ধ কিছু করার ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। যখন পরিবেশ নিয়ে তেমন কোনো চিন্তাভাবনা সভ্যসমাজে দেখা যায়নি, রবীন্দ্রনাথ তখনই সে প্রশ্নটিকে জোরালোভাবে সামনে এনেছিলেন। যন্ত্রসভ্যতার অগ্রগতির মধ্যেই তিনি দেখেছিলেন পরিবেশ বিনাশের কারণ। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যন্ত্রপ্রযুক্তির উন্নয়নের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন আহরণ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রকৃতির সম্পদকে ইচ্ছামতো ভোগ করার জন্য প্রকৃতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। যন্ত্রবিদরা প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়গুলোকে রোধ করার কথা ভাবছে। মুক্তধারার নাট্যকার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল প্রকৃতির মধ্যেই খুঁজতে চেয়েছেন; যন্ত্রের কাছে নয়। রক্তকরবী নাটকে বিজ্ঞানের অহংকারে প্রকৃতির শরীর ব্যবচ্ছেদ করার বিরুদ্ধে নাট্যকারের প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। নাটক কোনো শ্লোগান নয় কিংবা নয় কোনো প্রবন্ধ। নাটক হচ্ছে কোনো বিষয়বস্তুর নাটকীয় প্রকাশ। সেজন্য নাটকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনাকে খুঁজে পেতে হলে সেটা শিল্পের রঙে পেতে হবে। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের মনস্তত্ত্ব এবং নাট্য-ঘটনার সমাজ রাজনীতির ভিতর দিয়েই তা প্রকাশ পেয়েছে।

রক্তকরবী এবং মুক্তধারার বিষয়বস্তু সরাসরি পরিবেশে বিনাশের বিরুদ্ধে। প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাঁধা দেয়ার গল্প মুক্তধারা, রবীন্দ্রনাথ ঝরনার মুক্তধারাকে বাঁধবার পক্ষে নন। রক্তকরবী নাটকে দেখা যায় মুনাফার লালসায় খনিজসম্পদ আহরণ করা হচ্ছে; সেখানে শক্তিমানদের লোভের প্রকাশ ঘটছে। মুক্তধারা নাটকে যুদ্ধবাজ শাসকদের চিত্র ফুটে উঠেছে, যারা প্রকৃতিকে বিনাশ করছে নিজেদের স্বার্থে। রক্তকরবী প্রবলভাবে রাজনৈতিক নাটক কিন্তু নাটকের মূল দ্বন্দ্ব খনির সাথে মাঠের। মাঠের কৃষকদের জোর করে ধরে এনে খনির কাজে লাগানো হচ্ছে। সুরঙ্গ খুড়ে মাটির নিচে সোনার তাল খুঁজতে গিয়ে শ্রমিকরা বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে। ভীষণ কষ্টকর খনির কাজ কিন্তু রাজকর্মচারীদের ভয়ে শ্রমিকদের মুখটি খুলবার জো নেই। রাজার লোকরা নন্দিনীকেও ধরে এনেছে সেখানে। নন্দিনী এ নাটকে একই সাথে দুটি সমান্তরাল চরিত্র হয়ে দেখা দেয়। একই সাথে মানবী আবার প্রকৃতির উপমা। নন্দিনীকে দেখে রাজা মুগ্ধ হয় নিজের করে পেতে চায়। রাজার সে চাওয়া প্রেম বা শারীরিক কোনো চাহিদার জন্য নয়। নন্দিনীর প্রতি রাজার আকর্ষণ হচ্ছে মাধ্যকর্ষণ শক্তির টানের মতো প্রাকৃতিক। রাজার প্রতি নন্দিনীর কোনো ঘৃণা নেই কিন্তু মাটি খুঁড়ে রাজার সোনা আহরণ তার পছন্দ নয়। প্রকৃতির কাছেই নন্দিনী বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। রাজাকে সে প্রযুক্তির বাড়াবাড়ির হাত থেকে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই রক্তকরবী-র নাট্য পরিচয় দিচ্ছেন এভাবে যে, ঘটনাস্থানটির প্রকৃত নামটি কী সে-সম্বন্ধে ভৌগলিক মতভেদ থাকা সম্ভব। কিন্তু সকলেই জানেন এর নাম যক্ষপুরী। পণ্ডিতরা বলেন, পৌরাণিক যক্ষপুরীতে ধনদেবতা কুবেরের স্বর্ণ সিংহাসন। কিন্তু এ নাটকটি একেবারে পৌরাণিক কালের নয়, একে রূপকও বলা যায় না। যে-জায়গটার কথা হচ্ছে সেখানে মাটির নিচে যক্ষের ধন পোঁতা আছে। তারই সন্ধান পেয়ে পাতালে সুরঙ্গ-খোদাই চলছে, এইজন্যেই লোকে আদর করে এর যক্ষপুরী নাম দিয়েছে। তিনি নাট্যপরিচয়ের অন্যত্র লিখছেন, এই নাট্যের ঘটনাজালের মধ্যে নন্দিনী নামক একটি কন্যা তেমনিভাবে এসে পড়েছে। মকররাজ যে-বেড়ার আড়ালে থাকে, সেইটেকে সেই মেয়ে টিকতে দেয় না ঝুঝি।

রক্তকরবী নাটকে রাজনীতি আছে, শাসকদের দ্বারা মানুষকে দলিত করার কথা বারবার এ নাটকে ঘুরে ফিরে এসেছে, এসেছে ধর্মের শোষণের রূপটিও। তা সত্ত্বেও পরিবেশ রক্ষার কথাটি জোর পেয়েছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। প্রকৃতি যা মানুষকে সহজভাবে দেয় তার বাইরে জোর করে কিছু নেয়াটাকে সমর্থন করেননি নাট্যকার। তিনি বলেছেন তাতে পৃথিবীর ধ্বংস বয়ে আসবে। রক্তকরবী নাটকে যেমন কিশোর নন্দিনীকে বলছে, ‘সমস্তদিন তো কেবল সোনার তাল খুঁড়ে আনি। তার মধ্যে একটু সময় চুরি করে তোর জন্য ফুল খুঁজে আনতে পারলে বেঁচে যাই।’ রবীন্দ্রনাথ সহজ থেকে ফুল ছিঁড়ে আনতে দোষ দেখেন না, কারণ তা প্রাণের ঐশ্বর্যে মণ্ডিত। পাশাপাশি লোভের বশবর্তী হয়ে সোনার তাল খুঁড়ে আনায় রবীন্দ্রনাথ দেখছেন পৃথিবীর বিনাশ। দরকারের অজুহাতে, উন্নতির প্রশ্ন তুলে সোনা খুঁড়ে আনতে রবীন্দ্রনাথের বিন্দুমাত্র সম্মতি নেই। সেজন্য অধ্যাপকের সংলাপে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন সে নন্দিনীকে বলে, ‘দরকারের কথা বললে, ঐ চেয়ে দেখো। আমাদের খোদাইকারের দল পৃথিবীর বুক চিরে দরকারের-বোঝা-মাথায় কীটের মতো সুরঙ্গর ভিতর থেকে উপরে উঠে আসছে। এই যক্ষপুরে যা-কিছু ধন সব ঐ ধুলোর নাড়ির ধন; সোনা। কিন্তু সুন্দরী, তুমি যে-সোনা সে তো ধুলোর নয়, সে যে আলোর। দরকারের বাঁধনে তাকে কে বাঁধবে।’ মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে দরকার রবীন্দ্রনাথ তাকে সমালোচনা করেছেন। ভোগবাদীরা প্রয়োজন সম্বন্ধের অতীত যে চিত্ত তাকে তারা দেখতে পায় না। সূর্যের আলো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা দেয়, সোনা তা দিতে পারে না। খনির ধন লুট করতে গিয়ে আমাদের কিছু দরকার মেটে বটে, তা আবার মানবজাতির বিনাশ বয়ে আনে। যক্ষপুরে সোনার তালের ভিতরে নন্দিনীর হঠাৎ আগমনকে অধ্যাপক মনে করেন, দেয়ালের ফাটল দিয়ে আসা আচমকা আলো।

নন্দিনী এখানে প্রকৃতির রূপক। সে প্রাণের যাদুতে সকলকে মাতিয়ে তোলে, দরকার দিয়ে নয়। মানুষের দরকার কী করছে? অধ্যাপককে বলা নন্দিনীর ভাষায়, ‘সমস্ত শহর মাটির তলাটার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পাতালে সুরঙ্গ খুদে তোমরা যক্ষের ধন বের করে আনছ। সে যে অনেক যুগের মরা ধন, পৃথিবী তাকে কবর দিয়ে রেখেছিল।’ নন্দিনী মিথ্যা বলেনি। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ব্যবহার ঘটে এই সময়ে। গত চার হাজার বছরে মানুষ প্রকৃতি থেকে যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করেছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি সম্পদ লুট করা হয়েছে গত দুশো বছরে।  অধ্যাপকও নন্দিনীর সাথে একমত হয়ে নিজেদের সমালোচনা করে বলছেন, ‘আমরা যে সেই মরা ধনের শব-সাধনা করি। তার প্রেতকে বশ করতে চাই। সোনার তালের তালবেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে।’ পৃথিবীকে হাতের মুঠোর মধ্যে আনার চেষ্টার বিরুদ্ধে নাট্যকার। পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় আনতে গিয়েই যতো যুদ্ধ বিগ্রহ এবং বিজ্ঞানের নেতিবাচক সব আবিষ্কারে ধরণী পরিপূর্ণ। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের জন্যই দরকার বিপুল অর্থ ও সম্পদের। সেজন্যই দরকার বেশি বেশি সোনা আহরণ করা। নাট্যকারের প্রতিনিধি নন্দিনী সেজন্য অধ্যাপকের সমালোচনা করে বলছে, ‘তোমাদের খোদাইকর যেমন খনি খুদে খুদে মাটির মধ্যে তলিয়ে চলেছে, তুমিও তো তেমনি দিনরাত পুঁথির মধ্যে গর্ত খুঁড়েই চলেছ।’ পণ্ডিতরা যেভাবে নিজেদের জ্ঞানের অহংকারে পৃথিবীর সম্পদ লুট করে পৃথিবীর বিনাশ ঘটাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হয়েছেন নন্দিনীর সংলাপের ভিতর দিয়ে। পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার মানুষের কল্যাণে নয়, শাসকদের স্বার্থেই কাজ করে চলেছে। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ পণ্ডিতদের পুঁথির মধ্যে ডুবে থাকাকে ব্যঙ্গ করেছেন।

নাটকে অধ্যাপকও নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং দোষ স্বীকার করে বলেন, ‘জান নন্দিনী, আমিও আছি একটা জালের পিছনে। মানুষের অনেকখানি বাদ দিয়ে পণ্ডিতটুকু জেগে আছে। আমাদের রাজা যেমন ভয়ংকর, আমিও তেমনি ভয়ংকর পণ্ডিত।’ রবীন্দ্রনাথ টের পাচ্ছিলেন পণ্ডিতদের জ্ঞান পৃথিবীর জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের স্বার্থকে গিলে খাচ্ছে। সেজন্য রবীন্দ্রনাথ সারা পৃথিবীর জ্ঞান ভাণ্ডারকে সমালোচনা করে বসেছেন, যারা মানুষের কল্যাণ বাদ দিয়ে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে খনিজসম্পদ আহরণে ব্যস্ত। রবীন্দ্রনাথ এর মধ্যে সুদূর ভবিষ্যতের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেজন্য এই নাটকে অধ্যাপক অনুশোচনায়দগ্ধ মন নিয়ে নন্দিনীর কাছে জানতে চায়, ‘নন্দিনী, একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করি যক্ষপুরীকে তোমার ভয় করছে না?’ নন্দিনী জানতে চায় ভয় কেন করবে। অধ্যাপক উত্তর দেয়, ‘গ্রহণের সূর্যকে জন্তুরা ভয় করে, পূর্ণ সূর্যকে ভয় করে না। যক্ষপুরী গ্রহণলাগা পুরী। সোনার গর্তের রাহুতে ওকে খাবলে খেয়েছে। ও নিজে আস্ত নয়, কাউকে আস্ত রাখতে চায় না।’ যক্ষপুরী থেকে নন্দিনীকে পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেয় অধ্যাপক। বলে, ‘যেখানকার লোক দস্যুবৃত্তি করে মা বসুন্ধরার আঁচলকে টুকরো টুকরো করে ছেঁড়ে না, সেইখানে রঞ্জনকে নিয়ে সুখে থাকোগে।’ রবীন্দ্রনাথ যক্ষের ধন আহরণকে দস্যুবৃত্তির সাথেই তুলনা করেছেন। ধনীদের সেই দস্যুবৃত্তির ফল টের পাচ্ছে বর্তমান পৃথিবী। জলবায়ুর পরিবর্তনে পুরো বিশ্ব এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। সারা বিশ্বজুড়ে এখন ব্যাপক হৈ চৈ চলছে পরিবেশ রক্ষার জন্য।

যক্ষপুরীর রাজা এবং অধ্যাপক দুজনেই জ্ঞানপাপী। দুজনেই যক্ষের ধন আহরণের খারাপ পরিণতি জেনেও তার ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। দুজনেই রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতির বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ পরিবেশ বিনাশকে আলাদা কোনো ঘটনা বা সমাজ বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। পুঁজিবাদের রাহুগ্রাসের অংশ হিসেবেই দেখেছেন। ব্যাপারটা শুধু দু-একজনের চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। বিরাট চক্র এর সাথে জড়িত; মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের সাথে এর সম্পর্ক। সাধারণ মানুষ-শাসক এবং প্রশাসন সবাই যেন জালের মধ্যে আটকে আছে। জালের মধ্যে যে আটকে আছে তার প্রমাণ গত বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো সেখানে পরিবেশ বিনাশের ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। সব জেনেশুনেও তারা সরে আসতে পারছে না পরিবেশকে ধ্বংস করার পথ থেকে। কারণ সকলেই তারা নিজেদের মুনাফা এবং ভোগবিলাসীতাকেই অতিরিক্ত প্রাধান্য দিচ্ছে। নিজস্ব তৈরি মুনাফার জালে নিজেরাই আটকা পড়েছে। রক্তকরবী নাটকে সেই জাল ছিঁড়ে বের হয়ে আসবার কথাই রবীন্দ্রনাথ বলছেন। রক্তকরবী নাটকের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দেন বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র এবং রাজার কাজ আসলে সম্পদ বাড়িয়ে তোলা কিছু লোকের সুখ-সুবিধার জন্য। সব মানুষের কল্যাণ তাতে হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন সেখানে অবান্তর। সম্পদ বাড়াবার জন্য পৃথিবীকে ধ্বংস করতে হলেও তাদের আপত্তি নেই। বর্তমানের সুখ আর ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে তারা ব্যস্ত, ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী তাদের কাম্য নয়। রক্তকরবী নাটকে রাজা হচ্ছে সম্পদ আর ক্ষমতার প্রতীক; নন্দিনী তার বিপরীতে সৌন্দর্য আর প্রকৃতির প্রাণউচ্ছ্বলতার রূপক। রাজা আর নন্দিনীর সংলাপের ভিতর দিয়ে বারবার তা স্পষ্ট করে তুলেছেন নাট্যকার।

রঞ্জন আছে এ নাটকের নেপথ্যে, নাটকে তাকে দেখা যায় না কিন্তু তাকে অনুভব করা যায়। রঞ্জন সাহসী এবং প্রাণপ্রাচুয়ে ভরা, সে মানুষকে সম্পদের লোভে ভোলায় না; সে প্রাণের উচ্ছ্বলতায় সবাইকে মাতিয়ে তোলে। রঞ্জন হচ্ছে সাহস আর সংগ্রামের প্রতীক। নন্দিনী বারবার অন্ধকার যক্ষপুরীতে রঞ্জনকে খুঁজছে একচিলতে আলোর মতো। রঞ্জন মানুষের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু সে শক্তির প্রতীক নয়; সংগ্রামে প্রতীক। মানুষ আপনাতেই তার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। সংগ্রাম সেখানে নিত্য বা অনিবার্য। রাজা এবং নন্দিনীর সংলাপের ভিতর দিয়েই রঞ্জনের পরিচয় পাওয়া যায়। যক্ষপুরীর সবাই রাজাকে ভয় পায়; রাজার শক্তিকে, তার ভয়াবহ রূপকে। নন্দিনীর কিন্তু ভয় নেই রাজাকে। সে প্রকৃতির মতোই সরল এবং সবার প্রতিই সে উদার। রাজা থাকে বদ্ধ ঘরের ভিতর জালের আড়ালে, সেখানে যেতে সবাই ভয় পায়। নন্দিনীর কোনো ভয় নেই রাজার কাছে যেতে; সে বাতাশের মতো সর্বত্রগামী। প্রায় সে রাজার ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়, রাজাকে দরজা খুলতে বলে। নাটকে নন্দিনী খুবই ক্ষুদ্র এক বালিকা, কিন্তু তার ক্ষুদ্রতাকে রাজা অবহেলা করতে পারে না। নন্দিনীর আচরণে সে বিরক্ত হয়, ক্রুদ্ধ হয় তবে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। ঠিক যেমন প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ে বা দুর্বিপাকে পড়লে মানুষ সাময়িকভাবে বিরক্ত হয় কিন্তু প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে চলতে পারে না। প্রকৃতিই তো মানুষকে জোগায় বাঁচার রসদ।  রাজাও ঠিক তেমনি নন্দিনীর ভিতর খুঁজে পায় প্রাণের স্পর্শ। নন্দিনীকে তাই রাজা যেমন কাছে আসতে দিতে চায় না, তেমনি দূরেও সরিয়ে দিতে পারে না। রাজা নিজেই নিজের জালে আটকা পড়েছে। রাজার পদ যা চায় তাহলো সম্পদ ও শক্তিপ্রদর্শন অথচ তার ভিতরের মন চায় নন্দিনীর স্পর্শ।    

রাজার ভিতরে রয়েছে কোমল মানবিক দিক তবে তার বাইরের চেহারাটা বিকট। প্রত্যেক মানুষেরই তো হৃদয় থাকে; বাইরের পদ পদবী তাকে ভিন্ন মানুষ করে তোলে। রাজা বিকট হয়ে উঠেছে তার একার শক্তিতে নয়, শাসকগোষ্ঠীর যোগফল এবং সম্পদ তাকে বিকট করে তুলেছে। নন্দিনী প্রকৃতির মতো উদার বলেই রাজা এবং বাকিরা সবাই তার কাছে সমান। সে এক নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র। নন্দিনী রাজার কাছে আসে, দূরে পৌষের গান হচ্ছে। মাঠে ফসল পেকেছে, ফসল কাটার গান গাইছে কৃষক। নন্দিনী রাজাকে তার বদ্ধ ঘর থেকে বের করে মাঠে নিয়ে যেতে চায়। রাজাকে সে জালের আড়াল থেকে বের হয়ে আসতে বলে। নন্দিনী বলে, ‘পৌষের রোদ্দুর পাকা ধানের লাবণ্য আকাশে মেলে দিচ্ছে। তুমি বেরিয়ে এসো রাজা তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই।’ রাজা বিস্মিত হয় নন্দিনীর কথায়। জিজ্ঞেস করে, ‘আমি মাঠে যাব? কোন্ কাজে লাগব?’ নন্দিনী জোরের সাথে বলে, ‘মাঠের কাজ তোমার যক্ষপুরীর কাজের চেয়ে অনেক সহজ।’
রাজা বলেন, ‘সহজ কাজটাই আমার কাছে শক্ত। সরোবর কি ফেনার-নূপুর-পরা ঝরনার মতো নাচতে পারে। যাও যাও, আর কথা কয়ো না, সময় নেই।’ নন্দিনী রাজার কথায় চলে যায় না। সে বলে, ‘অদ্ভুত তোমার শক্তি। যেদিন আমাকে তোমার ভাল্ডারে ঢুকতে দিয়েছিলে, তোমার সোনার তাল দেখে কিছু আশ্চর্য হই নি, কিন্তু বিপুল শক্তি দিয়ে অনায়াসে সেইগুলি নিয়ে চুড়ো করে সাজাচ্ছিলে, তাই দেখে মুগ্ধ হয়েছিলুম। তবু বলি সোনার পিণ্ড কি তোমার ঐ হাতের আশ্চর্য ছন্দে সাড়া দেয়, যেমন সাড়া দিতে পারে ধানের ক্ষেত। আচ্ছা রাজা, বলো তো, পৃথিবীর এই মরা ধন দিনরাত নাড়াচাড়া করতে তোমার ভয় হয় না?’ রাজা জানতে চায়, ‘কেন, ভয় কিসের।’ নন্দিনী উত্তর দেয়, ‘পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড়গুলোকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আস তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আস।’ রাজা খুব অবাক হয়। প্রশ্ন করে, ‘অভিসম্পাত?’ নন্দিনী উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, খুনোখুনি কাড়াকাড়ির অভিসম্পাত।’
 
খনিজ সম্পদ নিয়ে, তেল-গ্যাস-কয়লার খনি নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে যে যুদ্ধ চলছে রবীন্দ্রনাথ তা বহু আগেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নন্দিনীর সংলাপের ভিতর দিয়ে রাখঢাক ছাড়াই তা তিনি উচ্চারণ করেন। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ চিন্তা কোনো খণ্ডিত চিন্তা ছিল না, তিনি সামগ্রিকভাবে বিষয়টাকে দেখেছেন। এর পেছনের রাজনীতিটাও তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি রক্তকরবী নাটকে পরিবেশ বিনাশের সামগ্রিক চিত্রটাই তুলে ধরেছিলেন। রাজনীতি বিচ্ছিন্নভাবে তিনি পরিবেশ রক্ষার কথা বলেননি। প্রযুক্তি এবং শাসকের শক্তি কীভাবে প্রকৃতিকে ভেঙেচুড়ে ফেলতে চায় তার কথা রাজার সংলাপের ভিতর দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন নাট্যকার। রাজা নন্দিনীকে বলছেন, ‘নন্দিনী, তুমি কি জান, বিধাতা তোমাকেও রূপের মায়ার আড়ালে অপরূপ করে রেখেছেন। তার মধ্যে থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমার মুঠোর ভিতর পেতে চাচ্ছি, কিছুতেই ধরতে পারছি নে। আমি তোমাকে উলটিয়ে পালটিয়ে দেখতে চাই, না পারি তো ভেঙেচুরে ফেলতে চাই।’ প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা যুদ্ধ-চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র-মারণাস্ত্রের কারণে সম্পদ তৈরি ও সম্পদ লুণ্ঠন করতে দুনিয়া দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত যদি সবুজ প্রকৃতিকে মরুভূমিও বানাতে হয় বিশ্বপুঁজিবাদের লুণ্ঠন থামবে না। মুনাফার আগ্রাসন এমনই উন্মত্ত।

শাসকশ্রেণীর কথা খুব স্পষ্ট, পৃথিবীর সব কিছু সে আপন ক্ষমতার জোরে ভোগ করতে চায়। যেখানে সম্ভব নয় সেখানে সব ভেঙেচুড়ে ফেলবে, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের মতো। নন্দিনীর প্রাণের মানুষ রঞ্জন। নন্দিনী রঞ্জনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে এভাবে, ‘দুই হাতে দুই দাঁড় ধরে সে আমাকে তুফানের নদী পার করে দেয়; বুনো ঘোড়ার কেশর ধরে আমাকে বনের ভিতর দিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে যায়; লাফ-দেওয়া বাঘের দুই ভুরুর মাঝখানে তীর মেরে সে আমার ভয়কে উড়িয়ে দিয়ে হা হা করে হাসে।’ রাজা নন্দিনীর কাছে জানতে চায়, ‘বলো আমাকে তোমার ভালো লাগে কি না’। নন্দিনী জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ ভালো লাগে’। রাজা জানতে চায়, সেটা কি রঞ্জনের মতো। নন্দিনী বলে রাজা তুমি ঘুরেফিরে কেন একই প্রশ্ন করো। রঞ্জনের সাথে আমার যে ধরনের সম্পর্ক সে-সব তুমি বোঝো না। রাজা উত্তর দেয়, ‘কিছু কিছু বুঝি। আমি জানি রঞ্জনের সঙ্গে আমার তফাতটা কী। আমার মধ্যে কেবল জোরই আছে, রঞ্জনের মধ্যে আছে যাদু।’ নন্দিনী রাজার কাছে জানতে চায়, ‘যাদু বলছ কাকে’। উত্তর আসে, ‘বুঝিয়ে বলব? পৃথিবীর নীচের তলায় পিণ্ড পিণ্ড পাথর লোহা সোনা, সেইখানে রয়েছে জোরের মূর্তি। উপরের তলায় একটুখানি কাঁচা মাটিতে ঘাস উঠছে, ফুল ফুটছে; সেইখানে রয়েছে জাদুর খেলা। দুর্গমের থেকে হীরে আনি; সহজের থেকে ঐ প্রাণের জাদুটুকু আনতে পারি নে।’ পুঁজিবাদের কাছে মানুষের সুকোমল মনের চাহিদার চেয়ে সম্পদের মূল্য বেশি। রাজা সেটা খুব ভালো করেই বোঝে। সত্যিকার অর্থে রাজা জ্ঞানপাপী। জেনেশুনেই জালের মধ্যে আটকে রয়েছে সে নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য।

নন্দিনী রাজার কথা শুনে বলে, ‘তুমি তো নিজেকেই জালে বেঁধেছ, তার পরে কেন এমন ছটফট করছ বুঝতে পারি নে।’ রাজা উত্তর দেয়, বুঝতে পারবে না। আমি প্রকাণ্ড মরুভূমি, তোমার মতো একটি ছোট্ট ঘাসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি ক্লান্ত। তৃষ্ণার দাহে একটা মরু কত উর্বরা ভূমিকে লেহন করে নিয়েছে, তাতে মরুর পরিসরই বাড়ছে, ঐ একটুখানি দুর্বল ঘাসের মধ্যে যে প্রাণ আছে তাকে আপন করতে পারছে না।’ রাজার কথায় সভ্যতার দ্বান্দ্বিক দিকটা ধরা পড়ে। যান্ত্রিক সভ্যতা লুণ্ঠন করতে করতে নিজেদের শুষ্ক করে ফেলেছে। লুণ্ঠনের চিন্তায় বেড়ে উঠতে গিয়ে কোমল ইন্দ্রিয়গুলোকে মেরে ফেলছে। কথাটা এখানে মানুষ ও পৃথিবী দুই রূপক অর্থেই এসেছে। প্রকৃতিকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলছে মানুষের সম্পদের লোভ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা না করতে পেরে পৃথিবী ক্রমশই তপ্ত হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ রক্তকরবী লেখেন উনিশশো চব্বিশ সালে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাই সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ পরিবেশবিদদের কাছে। মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণেই প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। বহুজন বলতে চাইছে, করোনা ভাইরাসের আক্রমণের মূল কারণে পরিবেশকে ধ্বংস করা। রবীন্দ্রনাথ এই সত্য প্রত্যক্ষ করেছেন আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে। ক্রমাগত উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বন্যা হচ্ছে। খরা দেখা দিচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে। বহু কিছু থেকে পৃথিবী রিক্ত হয়ে পড়ছে।

নন্দিনী রাজাকে বলে, ‘তুমি যে ক্লান্ত তোমাকে দেখে তো তা মনেই হয় না। আমি তো তোমার মস্ত জোরটাই দেখতে পাচ্ছি।’ হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের উন্নতি দেখতে পাচ্ছে, প্রযুক্তির শক্তি তাকে মুগ্ধ করছে। নানা আবিষ্কারে মনে হচ্ছে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে, ভিতরে ভিতরে যে তার ক্ষয় চলছে তা কেমন করে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে। রাজা বলছে, ‘নন্দিন, একদিন দূরদেশে আমারই মতো ক্লান্ত একটা পাহাড় দেখেছিলুম। বাইরে থেকে বুঝতেই পারি নি তার সমস্ত পাথর ভিতরে ভিতরে ব্যথিয়ে উঠেছে। একদিন গভীর রাতে ভীষণ শব্দ শুনলুম, যেন কোন্ দৈত্যের দুঃস্বপ্ন গুমরে গুমরে হঠাৎ ভেঙে গেল। সকালে দেখি পাহাড়টা ভূমিকম্পের টানে মাটির নীচে তলিয়ে গেছে। শক্তির ভার নিজের অগোচরে কেমন করে নিজেকে পিষে ফেলে, সেই পাহাড়টাকে দেখে তাই বুঝেছিলুম।’ পাহাড় কাটার ফলে, অতিরিক্ত খনিজ সম্পদ আহরণের ফলে ভূমিকম্পের সম্ভাবনা যে বহুগুণ বেড়ে গেছে মৃক্তিকা-বিজ্ঞানীরাই সে কথা এখন স্বীকার করেছেন। খনিজ দ্রব্য উত্তোলনের বাড়তি চাপ পরিবেশকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। সফলতার চেয়ে এর ক্ষতির দিকই বেশি। রবীন্দ্রনাথ রূপক দিয়ে শুরু করেছিলেন, এখন আর তিনি রূপকে নেই। বাস্তবে চলে এসেছেন। বাস্তব থেকে উদাহরণ দিচ্ছেন।
পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা কী বিরাট বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা রাজার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রক্তকরবী সম্পর্কে নাট্যকার বলেছিলেন, এটা কোনো রূপক নাটক নয়। সেটা তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক দিকটাকে সামনে রেখে। কিন্তু বাস্তববাদী নাটকেও রূপক থাকে। রূপক আর বাস্তব পাশাপাশি হাঁটছে এ নাটকে। সেজন্য নাটক হিসেবে রক্তকরবী বহুগুণ ব্যাঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে, নাটকীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। নন্দিনী রাজাকে বলছেন, ‘তুমি নিজেকে সবার থেকে হরণ করে রেখে বঞ্চিত করেছ; সহজ হয়ে ধরা দাও না কেন।’ রাজা বলছেন, ‘নিজেকে গুপ্ত রেখে বিশ্বের বড়ো বড়ো মালখানার মোটা মোটা জিনিস চুরি করতে বসেছি। কিন্তু যে দান বিধাতার হাতের মুঠির মধ্যে ঢাকা, সেখানে তোমার চাঁপার কলির মতো আঙুলটি যতটুকু পৌঁছয়, আমার সমস্ত দেহের জোর তার কাছ দিয়ে যায় না। বিধাতার সেই বদ্ধ মুঠো আমাকে খুলতেই হবে।’ বিধাতার বদ্ধমুষ্ঠি খুলতে হবে স্বর্ণ লাভের জন্য, খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য। রাজা সেজন্য আরো বলছে, ‘সৃষ্টি কর্তার চাতুরী আমি ভাঙি। বিশ্বের মর্মস্থানে যা লুকানো আছে তা ছিনিয়ে নিতে চাই, সেই-সব ছিন্ন প্রাণের কান্না। গাছের থেকে আগুণ সৃষ্টি করতে হলে তাকে পোড়াতে হয়।’ রাজার কথায় আবার সেই ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা এসে যাচ্ছে। মানুষের দরকার আগুন আর আগুনের জন্য দরকার জঙ্গল পুড়িয়ে ফেলা, গ্যাস উত্তোলন করা, কয়লা বের করে আনা। নন্দিনী এ নাটকে প্রকৃতির নানা প্রতীক। সেজন্য রাজা বলছেন, ‘নন্দিনী তোমার ভিতরেও আছে আগুন, রাঙা আগুন। একদিন দাহ করে তাকে বের করব, তার আগে নিষ্কৃতি নেই।’ সবকিছু দখল করার আগ পর্যন্ত কারোরই নিষ্কৃতি নেই এই সমাজ ব্যবস্থায়। সেই দখলের পরিণাম নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। নন্দিনী রাজার কাছে জানতে চায়, ‘কেন তুমি নিষ্ঠুর?’ রাজার কথা, ‘হয় আমি পাব, নয় নষ্ট করব। যাকে পাই নে তাকে দয়া করতে পারি নে। তাকে ভেঙে ফেলাও খুব একরকম করে পাওয়া।’ রাজা এরপর নন্দিনীর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘পালাও তুমি, পায়রা যেমন পালায় বাজপাখির ছায়া দেখে।’ রাজার ক্রোধ নন্দিনীকে কখনোই ভীত করে না। সে বলে, ‘আচ্ছা যাই, আর তোমাকে রাগাব না।’ রাজা তখন আবার ভিন্ন পথ ধরে। নন্দিনীকে কাছে ডাকে, ‘শোনো শোনো, ফিরে এসো তুমি। নন্দিনী! নন্দিনী!’ নন্দিনী ফিরে এসে রাজার কাছে জানতে চায় কেন সে আবার তাকে ডেকেছে। রাজা তখন বলে, ‘সামনে তোমার মুখে প্রাণের লীলা, আর পেছনে তোমার কালো চুলের ধারা মুত্যুর নিস্তব্ধ ঝরনা। মরণের মাধুর্য আর কখনো এমন করে ভাবি নি। সেই গুচ্ছ গুচ্ছ কালো চুলের নীচে মুখ ঢেকে ঘুমতে ভারি ইচ্ছে করছে। তুমি জানো না, আমি কতো শ্রান্ত।’ রাজার দুই ভিন্ন চরিত্র। রাজা নিষ্ঠুর তবে কখনোই খলনায়ক হয়ে উঠতে পারছে না। মহাভারতের সেই পুরানো কথা, কোনো মানুষই সম্পূর্ণ ভালো বা সম্পূর্ণ মন্দ হতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের নাটকের সব রাজারা সৃষ্ট হয়েছে প্লাটোর ‘দার্শনিক শাসক’-এর চিন্তা থেকে। সকল রাজারাই সেখানে রাজর্ষি, ব্যতিক্রম শুধুমাত্র তাসের দেশ। রাজা তাই শাসক আবার দার্শনিক।  

রাজা পূর্ববর্তী এসব কথা বলবার আগেই নন্দিনী বিশুপাগলের কাছে রাজার সাথে নিজের তুলনা করেছে এভাবে, ‘ও যেন হাজার  বছরের একটা বট গাছ, আমি একটা ছোট্ট পাখি। ওর ডালের একটি ডগায় কখনো যদি একটু দোল খেয়ে যাই নিশ্চয় ওর মজ্জার মধ্যে খুশি লাগে।’  নন্দিনীর এ বক্তব্য সত্য। নন্দিনীর মধ্যকার প্রাণপ্রাচুর্য এবং তার সহজ হবার রহস্যটা রাজা বুঝতে পারে না। রাজা আসলে নন্দিনীকে জানতে চায়, সে কথাটা নন্দিনীকে বলে ফেলে। নন্দিনী বলে, ‘জানবার কী আছে? আমি কি তোমার পুঁথি।’ রাজা উত্তর দেয়, ‘পুঁথিতে যা আছে সব জানি, তোমাকে জানি নে।’ বিশ্বকে প্রকৃতিকে সামগ্রিকভাবে বুঝতে পারা এত সহজ নয়। রাজার সমস্যা এখানে মার্কসের ভাষায় তার অস্তিত্বের সাথে প্রজাতি সত্তার। রাজার প্রজাতি সত্তা বেঁচে আছে, সে চায় প্রাণের ছোঁয়া। কিন্তু অস্তিত্বের চাপে পড়ে রাজাকে হতে হয় নিষ্ঠুর এবং লোভী। দুয়ের দ্বন্দ্ব নিয়ে রাজা পুরো নাটকে বেড়ে ওঠে। নন্দিনীর সাথে রাজার সাক্ষাতের পর অস্তিত্ব ও সত্তার দ্বন্দ্বে রাজা দিশেহারা হয়। রাজার প্রজাতি সত্তা নন্দিনীর স্পর্শ চায়, অস্তিত্বের প্রশ্নে সে নন্দিনীকে ভয় দেখায়। রাজা নন্দিনীকে বুঝতে না পরলেও নন্দিনী রাজা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের স্বভাব কিছু দিনের মধ্যেই স্পষ্ট বুঝতে পারে। রাজাকে তাই সে সরাসরি বলে, ‘ভয় দেখাবার ব্যবসা এখানকার মানুষের। তোমাকে তাই তারা জাল দিয়ে ঘিরে অদ্ভুত সাজিয়ে রেখেছে। এই জুজুর পুতুল সেজে থাকতে লজ্জা করে না!’ রাজা বলে, ‘কী বলছ নন্দিনী?’ নন্দিনী আরো একটু স্বর উঁচিয়ে রাজাকে বলে, ‘এতদিন যাদের ভয় দেখিয়ে এসেছ তারা ভয় পেতে একদিন লজ্জা করবে। আমার রঞ্জন যদি থাকত তোমার মুখের উপর তুড়ি মেরে সে মরত, তবু ভয় পেত না।’ রাজা রেগে যায়। রেগে গিয়ে বলে, ‘তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। এতদিন যা কিছু ভেঙে চুরমার করেছি তারই রাশকরা পাহাড়ের চুড়ার উপরে তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেখাতে ইচ্ছা করছে।’ ‘ডালিমের দানা ফাটিয়ে দশ আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে যেমন তার রস বের করে, তেমনি তোমাকে আমার এই দুটো হাতে; যাও যাও, এখনি পালিয়ে যাও, এখনি।’

নাটকের শেষে এসে রাজার প্রজাতি সত্তা জেগে ওঠে এবং অস্তিত্বের সঙ্কট কেটে যায়। রাজা বুঝতে পারেন ভুল চক্রে তিনি আটকে ছিলেন। প্রশাসন যন্ত্র রাজাকে সামনে রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছে। রাজা যখন বদ্ধ ঘরে স্বর্ণপুরীর ঐশ্বর্য্য দেখে বিরক্ত চিকিৎসক তখন প্রশাসন যন্ত্রকে বলে রাজার রোগের প্রতিকার হচ্ছে বড় রকমের একটা ধাক্কা। হয় অন্য রাজ্যের সঙ্গে, নয় নিজের প্রজাদের মধ্যে উৎপাত বাধিয়ে তোলা। রাজা নিজেকে বিরাট শক্তির অধিকারী ভাবলেও সে প্রশাসন যন্ত্রের জালের মধ্যেই আটকে ছিল। প্রশাসন যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে গেলে, রাজার সৈন্য এবং প্রশাসন কেউই তাকে মানতে চায় না। প্রশাসন বলে রাজার প্রতি কর্তব্যের অনুরোধেই রাজাকে ঠকাতে হয়, রাজাকে ঠেকাতেও হয়। রাজা সকলের জন্য কল্যাণকর কিছু করতে চাইলে প্রশাসন মেনে নেবে না। প্রশাসনযন্ত্র রাজাকে ঠকায়, সর্দারের ছলাকলায় রাজা রঞ্জনকে না চিনতে পেরে হত্যা করে। কিন্তু রাজা নন্দিনীকে কথা দিয়েছিল রঞ্জনকে সে মুক্ত করে দেবে। নন্দিনী যখন রাজার ঘরে প্রবেশ করে রঞ্জনের মৃতদেহ দেখতে পায় এবং রাজাকে বলে এই তো রঞ্জন। রাজা বুঝতে পারে প্রশাসন যন্ত্র মিথ্যা বলে তাকে ঠকিয়েছে। রাজা চীৎকার করে ওঠে, ‘ঠকিয়েছে। আমাকে ঠকিয়েছে। আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।’ রাজার প্রশাসন যন্ত্র, মানে তার আমলাতন্ত্র তাকে এতদিন ধরে ঠকিয়েছে, এখন আর মানছেই না  রাজাকে। নন্দিনী রাজাকে বলে, ‘রঞ্জনকে জাগিয়ে দাও, সবাই বলে তুমি জাদু জান, ওকে জাগিয়ে দাও।’ রাজা বলে, ‘আমি যমের কাছে যাদু শিখেছি, জাগাতে পারি নে। জাগরণ ঘুচিয়ে দিতে পারি।’ রাজা প্রবল আক্ষেপ নিয়ে বলতে থাকে, ‘আমি যৌবনকে মেরেছি, এতদিন ধরে আমি সমস্ত শক্তি নিয়ে কেবল যৌবনকে মেরেছি। মরা যৌবণের অভিশাপ আমাকে লেগেছে।’ রবীন্দ্রনাথ যে-কথা বলেছেন বহু বছর আগে, খনিজ সম্পদ আহরণের সেই অভিশাপ এখন টের পাচ্ছে সারাবিশ্বের মানুষ। করোনা ভাইরাস যেন বিরাট এক ধাক্কা সেখানে।

রক্তকরবী নাটক হিসেবে যে চিরায়ত তাই নয়, নন্দিনী চরিত্রটি বিশ্বনাটকে এক অনবদ্য সৃষ্টি। নন্দিনীর মতো নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র বিশ্বনাটকে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না। নন্দিনীর কারো প্রতি রাগ নেই, অভিমান নেই, ঘৃণা নেই, ইর্ষা নেই, ভয় নেই, সংকোচ নেই আবার সে দুর্বিনীত নয়। কিন্তু সে সংগ্রামী। মৃত্যুকে তুচ্ছ করতে জানে। মুক্তির সংগ্রামে বিশুর মতো সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায়। বিশু হচ্ছে নন্দিনীর কাছে রঞ্জনের উল্টো পিঠ যে দিকটাতে আলো পড়ে না। বিশু সংগ্রাম করার জন্য আলোড়িত হয় নন্দিনীর সংস্পর্শে। বিশুকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সর্দার তখন নন্দিনীকে বলে, ‘বিশুর বিপদ ঘটিয়েছ তুমি।’ নন্দিনী বিশু সম্পর্কে চন্দ্রাকে বলে, ‘হবে, তা হবে। আমার সঙ্গে এসেই বিপদে পড়েছে। তোমাদের কাছে নিরাপদে থাকত।’ চন্দ্রা রাগে নন্দিনীর কাছে জানতে চায়, ‘তবে কেন আনলি ওকে ভুলিয়ে সর্বনাসী!’ নন্দিনী তখন খুব শান্তভাবে বলে, ‘ও-যে বললে, ও মুক্তি চায়।’ নন্দিনী পরে আবার বলে, ‘আমি তো ওর সব কথা বুঝতে পারি নে, চন্দ্র। ও কেন আমাকে বললে, বিপদের তলায় তলিয়ে গিয়ে তবে মুক্তি।’ মুক্তি পেতে গেলে বিপদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে রবীন্দ্রনাথ নন্দিনীর সংলাপের ভিতর দিয়ে সেই সত্যটা জানিয়ে দেন। নন্দিনী সহজ কিন্তু সংগ্রাম বিমুখ নয়। বন্দী দশা থেকে মুক্তি তার কাছে সবচেয়ে আকাঙিক্ষত বিষয়।

যক্ষপুরীর প্রত্যেকটি মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহজ। প্রকৃতির মতো সকলের প্রতি তার সমান দরদ। নন্দিনী রঞ্জনকে চায়, রঞ্জন তাকে ভিন্ন এক জীবনের স্বাদ দিতে পারে; কিন্তু নন্দিনী রঞ্জনের জন্য বাকিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চায় না। বাকিদের নিয়েই তার রঞ্জন। বিশু যখন বলেছিল, ‘এইবার রঞ্জনের সঙ্গে তোমার মিলন হোক।’ নন্দিনী জবাবে বলে, ‘মিলনে আমার আর সুখ হবে না। একথা কোনোদিন ভুলতে পারব না যে, তোমাকে শূন্য হাতে বিদায় দিয়েছি। আর ঐ-যে বালক কিশোর, ও আমার কাছ থেকেই বা কী পেলে।’ বহুজন নন্দিনী প্রতি দুর্বল, নন্দিনী সেটা ভিতরে ভিতরে ভালোই টের পায়। কখনো সেটাকে অসম্মানের চোখে দেখে না, নিজের ভিতরে তার জন্য দম্ভ অনুভব করে না। দম্ভ নেই বলেই নন্দিনী এত সুন্দর। বরং সকলের প্রতি সৃষ্টি হয় তার মনে মমতা। সকলকে শূন্য হাতে বিদায় দিয়ে সকলের মনে কষ্ট দিয়ে সেজন্য এক রঞ্জনের সঙ্গে মিলনে সে সুখ পাবে না। নন্দিনীর মতো এমন ভাবনা ভাবতে পারে এমন চরিত্র আর কোন নাটকে পাওয়া যাবে? রঞ্জনকে হত্যা করার জন্য রাজার প্রতি তার ঘৃণা নেই। রঞ্জনের হত্যাকারী রাজাকে সঙ্গে নিয়ে তাই সে মুক্তির গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ে। কারণ রঞ্জন সংগ্রামের প্রতীক। তার মৃত্যু নেই, একবার পরাজয় হলে বারবার সে ফিরে ফিরে আসে। সংগ্রামই জীবনের বড় কথা। নাটকের শেষে অধ্যাপক তাই সংগ্রামে রাজার সঙ্গে যোগ দিতে চলে আসে। অধ্যাপক স্পষ্টই বলে, ‘পুঁথিপত্র ফেলে সঙ্গ নিতে এলুম’। পুঁথি পাঠে প্রয়োজন কী যদি মুক্তির জন্য সংগ্রামই না করবে। পুঁথিপাঠের মধ্যে জীবনকে আটকে রেখে লাভ নেই সংগ্রামে অংশ না নিলে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সম্পদ লুণ্ঠন দিয়ে নাটক শুরু করেন, লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম দিয়ে নাটক শেষ করেন। তিনি মানুষকে সত্য উচ্চারণ আর সংগ্রামে দীক্ষা দেন এ নাটকের দ্বারা। প্রশাসনের লুণ্ঠন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে মৃত্যু তা যে সম্মানজনক তা বলতে তিনি ভুলে যান না।